Advertisement
২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
Interview

বিনা শর্তে নগদই ভাল

একান্ত সাক্ষাৎকারে বললেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ এস্থার দুফলো। উপস্থিত ছিলেন তাঁর নতুন বইয়ের অলঙ্করণশিল্পী শায়ান অলিভিয়র।

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০২৪ ০৮:৪৫
Share: Save:

প্রশ্ন: অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও আপনার লেখা পুয়োর ইকনমিক্স (২০১১) বইটির কিশোর সংস্করণ পুয়োর ইকনমিক্স ফর কিডস প্রকাশিত হতে চলেছে। ছোটদের জন্য দারিদ্র নিয়ে বই লেখার কথা ভাবলেন কেন?

এস্থার দুফলো: ছোটদের জন্য বই লেখার ইচ্ছা আমার অনেক দিনের। ছোটদের জন্য দারিদ্র নিয়ে লেখা খুব জরুরি। ওরা বুদ্ধিমান, দ্রুত নতুন জিনিস শিখে নিতে পারে, অনেক খোলা মনে শোনে। অন্য দিকে, দারিদ্র বিষয়ে ছোটদের জন্য কোনও ভাল বই নেই। এই বিষয়টা ওদের কাছে পৌঁছে দেওয়া দরকার, যাতে ওরা দারিদ্র নিয়ে ভাবতে পারে, সম্ভাব্য সমাধানের পথ খুঁজতে পারে।

শায়ান অলিভিয়র: এই বইটার অন্য গুরুত্ব হল, এখানে গল্পের মাধ্যমে পুরোটা বলা হয়েছে। ঠিক ভাবে গল্প বলতে পারলে অনেক সহজে অনেক কথা অনেকের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। এস্থার বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতাকে বেঁধেছেন গল্পের সুতোয়।

প্র: অনেক প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকের কাছেও কি এই বইটা কাজের হতে পারে? তত্ত্ব, পরিসংখ্যান, জটিল বিশ্লেষণের গোলকধাঁধায় যাঁদের খেই হারিয়ে যায়, এই বই অনেক সহজে তাঁদের কাছে উন্নয়ন অর্থনীতির মূল কথাগুলো তুলে ধরতে পারে কি?

এস্থার: ঠিকই। মজার কথা হল, এক-এক ভাষায় এই বইটায় এক-এক স্তরের লেখা রয়েছে। ফরাসি ভাষায় যে সংস্করণটি বেরোচ্ছে, সেটা একই সঙ্গে শিশু এবং তাদের অভিভাবকদের জন্য লেখা, যেখানে প্রতিটি অধ্যায়ের গল্পের শেষে যে ছোট নিবন্ধ রয়েছে, সেখানে এমন কিছু কথা আছে, যা অভিভাবকদের বোঝার জন্যই। ইংরেজি সংস্করণটি মূলত কিশোরদের জন্য লেখা, ফলে অধ্যায়ের শেষে দেওয়া নিবন্ধটিও ওদের মতো করেই লেখা। বাংলায় যে সংস্করণটি বেরোবে, তাতে অবশ্য শুধু গল্পগুলোই রয়েছে।

প্র: আচ্ছা, তা হলে বাংলা সংস্করণের কথা ভাবছেন আপনারা?

এস্থার: শুধু ভাবছি না, সে বই তৈরি হয়ে গিয়েছে। হিন্দি, মরাঠির মতো আরও কিছু ভারতীয় ভাষাতেও অনুবাদ হচ্ছে বইটি।

প্র: দারিদ্র বিষয়ে মূল কথাগুলো কি সবার বোঝার মতো করে বলা সম্ভব?

এস্থার: অবশ্যই সম্ভব। আমি মনে করি, দারিদ্র বিষয়ে প্রায় সব কথাই সবার বোঝার মতো করে বলা যায়। সে ভাবেই কথাগুলো বলা উচিত। কথাগুলো সবার বোঝা প্রয়োজন, বিশেষত দরিদ্রদের। কিন্তু, বাস্তব হল, বেশির ভাগ কথাই সে ভাবে বলা হয় না। আমি মনে করি, কেউ যদি উন্নয়ন অর্থনীতির তত্ত্বের মূল কথাগুলো এক জন সাধারণ ভাবে বুদ্ধিমান মানুষের বোঝার মতো করে বলতে না পারেন, সেটা তাঁর সমস্যা। কিন্তু, সে ভাবে যে বলতেই হবে, তাতে কোনও সংশয় নেই।

শায়ান: আমি কখনও অর্থশাস্ত্র নিয়ে লেখাপড়া করিনি। অথচ, এই বইটার অলঙ্করণ করতে গেলে তো আমায় বিষয়টা বুঝতেই হত। তাতে কিন্তু আমার কোনও সমস্যা হয়নি। এটা ঠিক যে, এই অলঙ্করণের কাজের আগে দীর্ঘ সময় আমি এস্থার ও অভিজিতের (নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়) সঙ্গে থেকেছি। তাতে বিষয়টা বুঝতে সুবিধা হয়েছে। তার পরও এস্থার খুব কাছ থেকে আমার এই কাজটা দেখেছেন, মতামত দিয়েছেন অত্যন্ত গভীর ভাবে। একটা উদাহরণ দিই— ছবি আঁকতে আঁকতে এস্থারের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছিল, এক জন মা যখন নিজে না খেয়ে সন্তানের পাতে সেই খাবারটা তুলে দিলেন, তার পর সন্তানের খাওয়ার সময় তিনি কোন দিকে তাকাবেন? সেই থালার দিকে; না কি অন্য দিকে, যাতে মনে হয় যে, নিজের না-খাওয়ার বেদনার কথা তিনি সন্তানকে জানতে দিতে চান না? সব তত্ত্বকথা থেকে বেরিয়ে এসে এটাই তো দারিদ্রের আসল ছবি, তাই না?

প্র: পুয়োর ইকনমিক্স নাম কেন, তার একটা চমৎকার ব্যাখ্যা সেই বইয়ে ছিল, এই সংস্করণেও আছে। সে কথাটা কি এক বার উল্লেখ করবেন?

এস্থার: এই নামটার দুটো মানে। এক হল, এটা ‘পুয়োর’-দের বিষয়ে ‘ইকনমিক্স’-এর আলোচনা— দরিদ্র ও দারিদ্রের অর্থনীতি। অন্য দিকে, দরিদ্র মানুষ বিষয়ে অর্থনীতিতে যেমনধারা আলোচনা হয়, সেটার গুণগত মান বিষয়ে আমার বেশ সন্দেহ আছে। সেখানে দরিদ্রদের সম্বন্ধে অনেক রকম নেতিবাচক ধারণা আছে, তাদের প্রায় কেরিকেচার করে তোলা আছে। আমরা সেটা থেকে বেরোতে চেয়েছি। পুয়োর ইকনমিক্স ফর কিডস-এ আরও একটা সুবিধা আছে— এখানে অনেকগুলো চরিত্র, তারা কেউ সাহসী, কেউ ভিতু, কেউ মুখচোরা, কেউ আবার নিজের কথা বলতে ইতস্তত করে না। তাদের মধ্যে কেউ মজার চরিত্র, কেউ রাগী, কেউ দুঃখী। কিন্তু সবাই গরিব, এবং সবার মধ্যেই এক আশ্চর্য কল্পনাশক্তি রয়েছে, যাতে ভর করে তারা দারিদ্র থেকে বেরিয়ে আসার পথের সন্ধান পায়। এরাই কিন্তু সত্যি চরিত্র। গরিবরা এ রকমই। তাঁদের সবাইকে একই ছাঁচে ঢেলে দেখলে মস্ত অন্যায় হয়।

প্র: এই চরিত্ররা এক কাল্পনিক গ্রামের বাসিন্দা। আপনি বলেছেন, সেই গ্রামটি ভারত, ইন্দোনেশিয়া বা কেনিয়া, অথবা অন্য যে কোনও দেশেই থাকতে পারে। তবে কি আপনার মতে উন্নয়ন সংক্রান্ত সমস্যার একটা বৈশ্বিক চেহারা আছে, যা কোনও দেশের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির উপরে নির্ভরশীল নয়?

এস্থার: এ কথা অনস্বীকার্য যে, একটা দেশের নির্দিষ্ট পরিস্থিতি— সে দেশের রাজনৈতিক চরিত্র, গণতন্ত্র থাকা বা না-থাকা, সামাজিক রীতিনীতি, জাতিভেদ প্রথা বা বর্ণবিদ্বেষের মতো প্রথা উন্নয়নের প্রশ্নকে প্রভাবিত করে। কিন্তু, একই সঙ্গে এটাও ঠিক যে, সমস্যাগুলোর এমন একটা বৈশ্বিক রূপ রয়েছে, যেটা সব দেশের ক্ষেত্রেই এক রকম। এখানে আমি সমস্যাগুলোর সেই চেহারা ধরতে চেয়েছি।

প্র: পুয়োর ইকনমিক্স প্রকাশের পর অর্থনীতির গবেষণায় র‌্যান্ডমাইজ়ড কন্ট্রোলড ট্রায়ালস-এর প্রয়োগ কোন কোন নতুন ক্ষেত্রে হয়েছে?

এস্থার: ২০১১ সালে পরিবেশ বা জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ক্ষেত্রে আরসিটি-র গবেষণা ছিল না বললেই চলে। এখন প্রচুর কাজ হচ্ছে এই ক্ষেত্রটিতে। বন্যা কী ভাবে গরিব মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে, পাকিস্তান বা ব্রাজ়িলের বন্যার পর সে বিষয়ে গবেষণা হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় জল ক্রমেই অমিল হচ্ছে। জলের সেই অভাব কী ভাবে মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলছে, এবং কী ভাবে সেই অভাবকে মাথায় রেখে জীবনযাত্রা ও কৃষির চরিত্র পাল্টানো যায়, সে গবেষণা চলছে। গরিব মানুষকে টাকা দিলে বাস্তুতন্ত্র রক্ষার ক্ষেত্রে সুপ্রভাব পড়ে কি না, দেখা হচ্ছে। লিঙ্গবৈষম্য থেকে পরিযায়ী শ্রমিক, অনেক নতুন বিষয় ঢুকেছে আরসিটি-র গবেষণায়। প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তর নিয়েও গবেষণা হচ্ছে।

প্র: পশ্চিমবঙ্গ সরকার গত এক দশকে কন্যাশ্রী বা লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো যে প্রকল্পগুলি রূপায়ণ করেছে, তার কোনও একটিকে যদি আপনাকে নতুন করে সাজাতে হত, কোন কোন ক্ষেত্রে পরিবর্তন করতেন?

এস্থার: এই প্রকল্পগুলোর ডিজ়াইন সম্বন্ধে আমি বিস্তারিত জানি না, কাজেই কী পাল্টানো প্রয়োজন, সে আলোচনা করা ঠিক হবে না। কিন্তু এটুকু বলতে পারি, দুনিয়া জুড়ে অজস্র প্রমাণ মিলেছে যে, গরিব মানুষের হাতে নিঃশর্তে নগদ টাকা তুলে দিলে তাঁরা সে টাকার যথেষ্ট সদ্ব্যবহার করতে পারেন। তাঁরা টাকা নষ্ট করবেন, মদ খেয়ে উড়িয়ে দেবেন, এমন আশঙ্কার কোনও কারণ নেই। পৃথিবী জুড়ে শয়ে শয়ে আরসিটি-র কাজ হচ্ছে নগদ হস্তান্তর নিয়ে, এবং বহু ইতিবাচক ফলাফল মিলছে। হাতে নগদ টাকা পেলে মানুষের খাদ্যের পরিমাণ বাড়ছে, খাদ্য নিরাপত্তা বাড়ছে, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটছে, শ্রমশক্তিতে যোগ দেওয়ার সামর্থ্য বাড়ছে। কাজেই বলা যায়, নিজেদের উন্নয়নে টাকা কী ভাবে ব্যবহার করতে হয়, গরিব মানুষ জানেন। পশ্চিমবঙ্গের মানুষও নিশ্চয়ই জানেন। এখানে কয়েকটা প্রশ্ন আছে— যেমন, প্রাপকদের ঠিক ভাবে টার্গেট করা হচ্ছে কি না; ঝড় বা বন্যা অথবা লকডাউনের মতো কোনও সাময়িক সমস্যার কথা মাথায় রেখে টাকা দেওয়া হচ্ছে, না কি দারিদ্রের দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার সমাধানে দেওয়া হচ্ছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ঠিক ভাবে জানলে লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো প্রকল্প উন্নয়নের মাপকাঠিতে সফল হবে বলেই বিশ্বাস করি। প্রশ্ন হল, ১০০০ টাকায় কতখানি উন্নয়ন সম্ভব? আমার মত হল, কম টাকা দেওয়ার চেয়ে বেশি টাকা দেওয়া সব সময় ভাল! এটা ঠিক যে, ভারতের মতো দেশে ১০০০ টাকা খুব বেশি টাকা নয়। বিশেষত, যে পরিবারগুলি একেবারে দরিদ্র নয়, সেখানে। কিন্তু যে সব পরিবারে দারিদ্র চরম, সেখানে এই ১০০০ টাকার গুরুত্ব অপরিসীম।

অন্য বিষয়গুলি:

Esther Duflo Nobel Prize
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy