একটা ভূতের গল্প শুনিয়েছিলেন উত্তমকুমার, বিকেলে ভোরের ফুল ছবিতে। কথক এক অমাবস্যার রাতে জঙ্গলের পথে মোটরবাইক চালিয়ে আসতে গিয়ে দেখেন, বন্য গরিলার মতো কালো, রোমশ, তীক্ষ্ণ নখওয়ালা দু’টি হাত বার বার তাঁর বাইককে চেপে ধরছে। কথক প্রাণভয়ে ছুটতে শুরু করেন। রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকানে যান, পুলিশের কাছে থানায় যান। সকলকেই তিনি গল্পটা বলেন। সকলেই খুব মনোযোগ দিয়ে সহানুভূতি নিয়ে শোনে। তার পর বলে, দেখুন তো এই রকম হাত? দেখা যায় তাদের হাতগুলোও সেই কালো, রোমশ!
এখনকার রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গল্পটা মাঝে মাঝেই মনে পড়ে। ক’দিন আগে এ রাজ্যের এক সাংসদ আঙুল দেখিয়ে বললেন, পুলিশের গুলি করা উচিত ছিল বিক্ষোভকারীদের কপালের ঠিক মাঝখানে। দিল্লিতে ‘গোলি মারো’ স্লোগান বা শীতলখুচি, কিংবা ‘পেড ব্যাক ইন দেয়ার ওন কয়েন’— কত রকম সদৃশ উদাহরণ। কারও কারও মনে পড়ে গেল ‘এ রকম তো কতই হয়’ উক্তিটি। কেউ খুঁজে পেলেন প্রতি-আক্রমণের অস্ত্র, কেউ বা খুশি হলেন এই ‘মর্দানগি’তে।
‘মর্দানগি’ আজকাল রাজনীতিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ। সিক্স প্যাক নায়কের মতো ৫৬ ইঞ্চির ছাতি এখন রাষ্ট্রনেতারও সম্পদ। বিপণনযোগ্য সম্পদ। পৌরুষের নির্মাণ রাজনীতির অন্যতম চাহিদা। কোনও নেতার যৌনরুচি নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাঁকে একটু ‘কম পুরুষ’ বলে দেখানোর চেষ্টা সেই রাজনীতির সিলেবাসে তাই ঢুকে পড়ে অবলীলায়। যুক্তিক্রমটি স্পষ্ট— সমকাম মানে পৌরুষের অবনমন আর পৌরুষের অবনমন মানে চিতা থেকে পায়রায় ‘নেমে’ যাওয়া। কে চায় নামতে?
যে কোনও দিন যে কোনও চ্যানেলে সন্ধের তরজায় চোখ রাখলে ঝটিতি মালুম হবে, প্রত্যেকটি দল কী ভীষণ এক রকম! তাদের প্রতিনিধিরা এক রকম ভাবে কথা বলেন, এক রকম যুক্তি দেন। আক্রমণের ভাষা ও ভঙ্গি এক ছাঁচে ঢালা। বক্তব্যের বিষয়বস্তুতেও খুব ফারাক নেই। সেই ‘এক রকম’ দলগুলোর এক রকম নেতানেত্রীরা আবার পরস্পরের বিরুদ্ধে এক রকম কায়দায় সেটিং-এর প্রসঙ্গ তোলেন সময়সুযোগ বুঝে। কেউ বলেন, ‘সাধুবাবা বাঁচাবেন না’, কেউ বলেন ‘আমি বিশ্বাস করি না উনি এমন করতে পারেন’, কেউ বলেন ‘ওরা তো এ টিম’, কেউ বলেন ‘কই পুলিশ ওদের তো মারেনি’, কেউ কেউ আবার সন্তর্পণে ভোট পাচার করিয়ে দেন! বিশেষ বিশেষ সময়ে নীরব হয়ে যান কেউ, ভোটদানে বিরত থাকেন, বৈঠকে আসেন না, বিরোধী ভোট ভাগ করার কলকাঠি নাড়েন।
এই সাদৃশ্যের জোয়ার আকাশ থেকে পড়েনি। এ এক সর্বত্রগামী ফ্যাসিবাদের ফসল। কোনও বিশেষ দল বা ব্যক্তি বা দলীয় নীতিকে ফ্যাসিস্ট বলে দাগিয়ে দেওয়ার দিন যেন বা শেষ। আমরা যেন ফ্যাসিস্টের শাসন থেকে ফ্যাসিবাদের শাসনে উন্নীত হয়েছি। ফ্যাসিস্ট বা ফ্যাসিবাদীর শাসনে সে কর্তা, ফ্যাসিবাদ তার কর্ম। ফ্যাসিবাদের শাসনে ফ্যাসিবাদ নিজেই কর্তা, ফ্যাসিস্টরা তার কর্ম। ধর্মীয় মৌলবাদ-পরিবারতন্ত্র-ব্যক্তিতন্ত্র-দলতন্ত্র সেই কর্তৃকারক দশাননের এক-একটা মাথা। এই মুহূর্তে আমাদের দেশে মৌলবাদী মাথাটি সবচেয়ে বৃহৎ, সবচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে আগ্রাসী। অতএব সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। কিন্তু ছোট-মাঝারি সব ক’টি মাথাই স্ব স্ব চরিত্রে অসহিষ্ণু, বলদর্পী। আচরণে দুর্মুখ, মিথ্যাচারী এবং দুর্নীতিবাজ। অবস্থানে ধামাধরা পুঁজি আর কর্পোরেট আধিপত্যের দাসানুদাস।
এই সামগ্রিক সাদৃশ্যের কথা মনে রাখলে বুঝতে সুবিধা হয় দল বদল জিনিসটাও কেন চাকরি বদল বা জার্সি বদলের মতোই সহজ, সুগম এবং সংক্রামক হয়ে উঠল। আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে, মতাদর্শ বস্তুটা অস্তিত্বহীন হয়ে গেল বুঝি। আর একটু ঠাহর করলে বোঝা যাবে, মতাদর্শ আছে। যেটা ঘুচে গিয়েছে, সেটা মতাদর্শের ফারাক। একটা দলের সঙ্গে অন্য দলের চিন্তাধারার ফারাক। স্কুলের নাম আর ইউনিফর্মটা আলাদা। নইলে একই বোর্ড, একই সিলেবাস। ফলে যাঁরা ইউনিফর্ম পাল্টাচ্ছেন, তাঁদের পড়া বুঝতে, পরীক্ষা দিতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। হেডমাস্টারমশাইরাও নতুন পড়ুয়া নিতে পিছপা হচ্ছেন না। বিশেষ করে অন্য স্কুলের মেডেল পাওয়া পড়ুয়া পেলে তো কথাই নেই।
নব্বইয়ের দশকে ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা যখন ইতিহাসের সমাপ্তি ঘোষণা করেছিলেন, তখন তাঁর মনে হয়েছিল ঠান্ডা যুদ্ধের শেষ এবং সোভিয়েটের পতন বিশ্ব জুড়ে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাই নিশ্চিত করবে। পৃথিবীটা এক রক ম দেখতে লাগবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প আর ব্রেক্সিট দেখার পরে ২০১৭-য় এসে ফুকুয়ামাকে বলতে হয়েছে, গণতন্ত্র যে পিছনের দিকে হাঁটতে পারে, ২৫ বছর আগে এ ধারণা তাঁর ছিল না। পৃথিবীর বৃহদংশ জুড়ে অতি-দক্ষিণপন্থার এই উৎকট উত্থানের মানচিত্রেই ভারত তার ঠাঁই করে নিয়েছে। এখনকার ভারতকে দেখলে মনে হবে, ফুকুয়ামার কথাই সত্য হয়েছে বটে, তবে উল্টো দিক থেকে। গণতান্ত্রিকতা বিসর্জনে গিয়েই সব এক রকম দেখতে হয়েছে। মুখে যে দল যতই নিজেকে আলাদা বলে দাবি করুক না কেন, তার আত্মবিজ্ঞাপনের ভাষাটি ক্রমশ এক রকমই হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিয়ম করে মন্দিরে যাওয়া, জনসভায় মন্ত্র পড়া, উচ্চৈঃস্বরে দেশভক্তির কসম খাওয়া এগুলো প্রায় সব দলেরই এখন কম-বেশি পালনীয় কর্তব্য। নিজেকে কতটা আলাদা করব আর কতটা এক রকম হব— এই মাপতোলের হিসেব কষতেই দিন কাবার।
এখানে স্মরণ রাখা কর্তব্য, এক রকম হওয়া মানে কিন্তু সমান হওয়া নয়। ডিগ্রির পার্থক্য আছে। তার থেকেও বেশি আছে ক্ষমতার পার্থক্য। অভিন্নতার সিলেবাস রচনার কলমটি যার হাতে— দশাননের সেই বৃহৎ মস্তক— একত্বের সংজ্ঞা বেঁধে দিচ্ছে সে। বাকিরা প্রায় এম এন শ্রীনিবাস বর্ণিত সংস্কৃতায়নের ফরমুলায় সেই সংজ্ঞার শর্ত পালনের চেষ্টায় নেমেছে— দেখুন স্যর, গোলি মারো আমিও বলতে পারি! বৃহৎ মস্তক চায় দেশের সবাই এক রকম কথা বলুক, এক রকম ভাবুক, এক রকম বই পড়ুক, এক সুরে কথা বলুক, এক রকম খাবার খাক, রাজনীতির ভাষাটাও এক গ্রামে বাঁধা থাক। তা হলে আপসেই পর্দা মেলানোর তাগিদে বাকিদের গলাও ওই রকম হয়ে উঠবে। সেই আশা যে অনেকটাই পূর্ণ হতে পেরেছে, তার কৃতিত্ব বিরোধীদের। তাঁরা প্রাণপণে গলা সাধছেন, কণ্ঠী-গায়কে দেশ ভরে যাচ্ছে। শ্রোতারাও প্রস্তুত। তাঁরা হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের একনিষ্ঠ পড়ুয়া, ট্রোলে সিদ্ধহস্ত, ভাইরালের কারবারি। জামার রংটা ছাড়া প্রায় এক রকম দেখতে। ঐক্যের মধ্যে বৈচিত্র জোগানোর ভূমিকাটুকু বাদ দিলে অন্তরের ফারাক সামান্যই।
ফ্যাসিস্টের শাসনকাল ফ্যাসিস্টের প্রস্থানে শেষ হয়। ফ্যাসিবাদের শাসনে এক ফ্যাসিস্টের হাত থেকে ক্ষমতা অন্য ফ্যাসিস্টের হাতে যায়। ফ্যাসিবাদকে হটাতে গেলে দৃঢ়সঙ্কল্প নাগরিক সমাজের প্রয়োজন। এ দেশে নাগরিকদের আজকাল সিনেমা বয়কট করার আগ্রহ যত, তার কিয়দংশও কুবাক্যবাগীশদের বয়কটে ব্যয়িত হয় না। বরং নেতাদের টিআরপি বাড়ে। লাগাতার কুকথা বলেই পরিচিতি পেয়েছেন, রাজনীতির কেরিয়ারে হুহু করে এগিয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি। নাগরিক সমাজের নিজের ভাষাও যে কদর্যতার সাধনায় মগ্ন, সেটা সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে অগোচর নেই। নাগরিকের সমর্থন ছাড়া নেতা হয় না, ফ্যাসিবাদও টেকে না। ফ্যাসিবাদের সাফল্যই এই যে, সকলকে সে তার নিজের রঙে ছুপিয়ে নেয়! নেতা, কর্মী আর নাগরিক সেখানে ঠিক এক রকম দেখতে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy