আজকের দুনিয়ায় মধ্যবিত্ত কিন্তু আলোচনার পরিসরে মূলত আয়ের বন্ধনীতেই সীমাবদ্ধ। —ফাইল চিত্র।
রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বৃত্তটা ছিল বেশ বড়। আর সাধারণ আলোচনায় গাড়িওয়ালা পেশাদার আর গ্রাজুয়েট কেরানি একই সঙ্গে মধ্যবিত্তের পাতে বসতেন। আলোচনার পরিসরে কৌলিন্যের তকমা পড়ত শিক্ষার নিরিখে। কেন? এই আলোচনা সমাজবিজ্ঞানীরা করবেন। তবে আজকের দুনিয়ায় মধ্যবিত্ত কিন্তু আলোচনার পরিসরে মূলত আয়ের বন্ধনীতেই সীমাবদ্ধ।
তার মানে এই নয় যে সেখানে প্রথাগত শ্রেণিবিভাগ একেবারেই ব্রাত্য। শিক্ষা এখনও এই শ্রেণির নির্ধারণে একটা বড় জায়গা অধিকার করে আছে বইকি। আর থাকবে নাই বা কেন? এই মধ্যবিত্তই যে বাজারের অন্যতম চালিকাশক্তি। এই শ্রেণির হাতেই ধরা আছে আর্থিক বৃদ্ধির হারকে টেকসই করে তোলার চাবিকাঠি। তাই সাধারণ ভাবে বলা হয় যে দেশে এই শ্রেণি মূল জনসংখ্যার একটা বড় অংশ সেই দেশের উন্নয়ন লক্ষ্মীও তত কম চঞ্চলা। আর্থিক অসাম্য বাড়লে এই শ্রেণিটিও সংকুচিত হয়ে পড়ে আর উন্নয়ন লক্ষ্মীও তাঁর বাহন পেঁচার পিঠে উঠে পালাব পালাব করতে থাকেন। আর ভারতের ক্ষেত্রে এই শ্রেণিটিই আসলে উন্নয়নের উচ্চাশার তুলনায় একটু বেশিই ছোট বলে মনে করা হচ্ছে। অসাম্যের কারণেই।
সমস্যা হচ্ছে এই শ্রেণিকে ধরার কোনও নির্দিষ্ট মাপকাঠি নেই। একটা অঙ্ক অবশ্য অনেকেই ব্যবহার করে থাকেন এই শ্রেণিকে ধরতে। আর তা হলে দেশের মধ্যক (median) আয়কে মাপকাঠি ধরে তার দ্বিগুণ আয় একদিকে আর অন্য দিকে সেই মধ্যক আয়ের দুই তৃতীয়াংশের মধ্যে যাঁরা আয় করে থাকেন তাঁরাই মধ্যবিত্ত। আর এই মধ্যবিত্তের চাহিদাই কিন্তু সাধারণ বাজারের চরিত্র নির্ধারণ করে থাকে।
আমরা একটু পিছন ফিরে দেখি। পরিকল্পিত অর্থনীতির সময়কেই ধরা যাক। যে হেতু দেশের বাজারকে বাইরের বাজার থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছিল তাই প্রবাসী আত্মীয়স্বজন দেশে ফিরলে জিনস থেকে শুরু করে রান্না ঘরের সামান্য ছুরি-কাঁচিও বিরাট দামি উপহার বলে মনে করা হত। গোটা বছর ধরে চিঠিতে থাকত কী কী নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পেলে ভাল হয় তার তালিকা। আর সে সব ব্যবহারের অধিকার থাকত শুধু বাড়ির গিন্নির!
যাঁদের মনে আছে মারুতি গাড়ির শুরুর দিনের কথা তাঁরা জানেন কী উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল বাজারে। মারুতির দিন থেকে আজ গাড়ির বাজারে যে পরিবর্তন হয়েছে তা কিন্তু উচ্চবিত্তের গাড়ির চাহিদা ধরে হয়নি। এই বাজারে মধ্যবিত্তের উচ্চাশাই কাজ করেছে মূল চালিকা শক্তি হিসাবে। আর তারই হাত ধরে আজ বাজারে যত রকম গাড়ির মডেল চলছে তা সাধারণ ভাবে মনে রাখাই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই মধ্যবিত্তের হাত ধরেই কিন্তু চলছে বাকি সব বাজার। মল থেকে শুরু করে মাছের বাজার, সবই নির্ভর করে এই মধ্যবিত্ত কী চাইছে, কী ভাবে চাইছে এবং কী রকম চাইছে তার উপরেই।
মাত্র তেত্রিশ বছর। ১৯৯০ সালে ভারতের বাজারের দরজা উন্মুক্ত হয়। যে বাজারে এক সময় এরোপ্লেন চড়া ছিল চরম বিলাস আজ কিন্তু তা ভ্রমণের অন্যতম অভ্যাস। মাত্র তেত্রিশ বছরেই এতটা পরিবর্তন।
এখন প্রশ্ন হল ভারতের এই মধ্যবিত্তের সংখ্যা কি যে বৃদ্ধির স্বপ্ন আমরা দেখছি তা ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট? মাথায় রাখতে হবে ভারতের জনসংখ্যার কথা। প্রায় ১৪০ কোটির দেশ এই ভারতে অভ্যন্তরীণ বাজারের শক্তিটা কিন্তু সাংঘাতিক। আমরা প্রত্যেকে যদি দিনে ১০০ টাকা করেও খরচ করে থাকি তাহলে দিনে ১৪ হাজার কোটি টাকার চাহিদা তৈরি হয়। তিন মাস বা ৯০ দিনেই তা দাঁড়ায় ১২ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকায়! আর এর পাশে আমরা যদি ভারতের চলতি আর্থিক বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে ৭১ লক্ষ কোটি টাকার জাতীয় উৎপাদনকে দেখি তা হলেই আন্দাজ করতে পারব দেশের বাজারের হাল।
এই অঙ্কটার মধ্যে কিছু সমস্যা আছে। কিন্তু এটা আমাদের জাতীয় উৎপাদন সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়। একই সঙ্গে আমাদের দেশের বাজারের শক্তির ছবিটাও স্পষ্ট করে দেয়। এই অঙ্কই আবার বলে দেয় দেশের অনৈক্যের ছবিটা। এই অঙ্কটার পিছনে অনুমানটা তো সোজা। যে সবাই একই টাকা খরচ করছে। কিন্তু বাস্তবে তা তো হয় না। কেউ দিনে হাজার টাকা খরচ করে তো আরেক জন অন্যের কাছে হাত পাতে পেটের ভাতের জন্য। কিন্তু দিনে ১০০ টাকা সবাই খরচ করলেই তা প্রায় জাতীয় উৎপাদনের ১৮ শতাংশের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। এবার ভাবুন তো দেশের সবাই যদি দিনে অন্তত হাজার টাকা করে খরচ করতে পারত তাহলে বাজারের পরিসর কোথায় গিয়ে দাঁড়াত? এক ত্রৈমাসিকেই ১২০ লক্ষ কোটি টাকার মত বাজার তৈরি হত! প্রতি নাগরিকের মাসে ৩০ হাজার টাকা খরচ করার ক্ষমতা কিন্তু আমরা যে অর্থনৈতিক শক্তির স্বপ্ন দেখছি এবং প্রতি মুহূর্তে বলে চলেছি তাতে ন্যূনতম শর্ত হওয়া উচিত।
কিন্তু তা অনেক দুরের স্বপ্ন। ফেরা যাক মধ্যবিত্তের সংখ্যায়। বাজার টানে চাহিদায়। তা যে শুধু সংখ্যায় তা নয়। গুণমানের চাহিদাও কিন্তু একটা বড় ব্যাপার। মারুতি আসার পরে অ্যাম্বাসাডর চড়ে বেরনোর কথা ভাবতে অসুবিধা হত। মারুতি কেনার জন্য লাইন হত লম্বা। আর এখন তো আমরা ভাবতেই পারি না আম্বাসডরের মতো গাড়ির কথা। এই যুক্তি প্রতিটি পণ্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর খোলা বাজার হলে পণ্য প্রস্তুতকারকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে আরও প্রযুক্তির উন্নতি ঘটিয়ে আরও ভাল পণ্য বাজারে আনার। অর্থনীতির এই প্রাথমিক তত্ত্ব আজ স্কুলের বাচ্চাও জানে।
কিন্তু এরই সঙ্গে বাজারের কেনার ক্ষমতাও তো বাড়তে হবে। বাড়াতে হবে বাজারের পরিসরও। আর এখানেই আসে মধ্যবিত্তের কেনার ক্ষমতার কথা। মধ্যবিত্ত কারা? একটা ব্যাখ্যা বলে ভারতে যাঁরা বছরে ৬ লক্ষ থেকে ১৮ লক্ষ টাকার মধ্যে আয় করে থাকেন তাঁরাই মধ্যবিত্ত। এই অঙ্কের পিছনে আছে একটি ভাবনা। সাধারণ ভাবে বললে মধ্যবিত্ত তাঁরাই যাঁদের আয়ের পরিসরে যা তাতে দৈনন্দিন প্রয়োজন মিটিয়েও কিছু টাকা উদ্বৃত্ত থাকে বেড়াতে যাওয়ার জন্য এবং ঋণ করে বাড়ি বা গাড়ি কেনার জন্য। আর এঁরাই অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি।
ভারতে এঁদের সংখ্যা কত? একটি সমীক্ষা বলছে ভারতে এঁদের সংখ্যা ছ’কোটির মতো। ভারতের জনসংখ্যা যদি ১৪০ কোটি হয়, তার তুলনায় বাজারের চালিকা শক্তির অংশ মাইক্রোস্কোপে দেখতে হবে। প্রসঙ্গত মনে আসতে পারে আরেকটা প্রশ্ন। বড়লোক কারা? বছরে ১৮ লক্ষ টাকার উপরে যাঁদের আয় তাঁরাই বড়লোক। আর তাঁদের সংখ্যা ভারতের জনসংখ্যার এক শতাংশ মাত্র। আর এর বাইরে বাকি সবাই নিম্নমধ্যবিত্ত বা দরিদ্র।
এই বারেই আসে আসল প্রশ্ন। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে উদার অর্থনীতি আমাদের দেশের বাজারকে এতদূর নিয়ে এসেছে। আমরা নিজেদের বিশ্বের অন্যতম আর্থিক শক্তি বলে আস্ফালন করছি। কিন্তু উপরের বুড়ো আঙুলের অঙ্কই বলে দিচ্ছে আমরা আমাদের আর্থিক ক্ষমতার অণু অংশও জাগিয়ে তুলতে পারিনি। আর তা না পারলে বিশ্বের আর্থিক শক্তি হয়ে যে জায়গা আমরা খুঁজছি তা আমরা ধরে রাখতে পারব না। ২০২৪ সালে আমাদের একটাই প্রাপ্তির লক্ষ্যে হাঁটা শুরু করা উচিত। মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিসর বাড়ানোর। উপর থেকে নীচে টেনে নামিয়ে নয়। আয়ের বন্ধনীর নীচের নাগরিকদের মধ্যবিত্ত হয়ে ওঠার সুযোগ তৈরি করে দিয়ে। তা না হলে আমাদের আর্থিক শক্তি হিসাবে বর্তমান আস্ফালন আগামীতে দুর্বলের আকাশকুসুম কল্পনা হয়ে উঠতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy