নারী কন্যা, ভার্যা, মাতা হতে পারেন, কিন্তু রক্ষক, অধিনায়ক, মার্গদর্শক নয়। সমষ্টিগত ভারতীয়ের মনের কথা এটি। পশ্চিমবঙ্গ-সহ পাঁচ-ছ’টি রাজ্য যদিও খানিকটা উদারতার পরিচয় দিয়েছে। রাজ্যের মার্গদর্শকের পদে একাধিক বার মহিলাদের বসিয়েছে। কিন্তু গোটা ভারতের ছবিটা তা নয়।
ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম-এর গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২১ বলছে, লিঙ্গবৈষম্যের নিরিখে গত এক বছরে ভারত ২৮টি দেশের পিছনে চলে গিয়েছে— ১৫৬টি দেশের মধ্যে এখন ভারতের স্থান ১৪০তম স্থানে। শেষ কুড়িতে জায়গা এই প্রথম। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মহিলাদের সংখ্যা হ্রাসই পশ্চাদপসরণের প্রধান কারণ।
লিঙ্গবৈষম্য পরিমাপের চারটে মাপকাঠি— মহিলাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বেতনভিত্তিক শ্রমে অংশগ্রহণ ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যোগদান। ২০১৯-এ ১৫৩টি দেশের মধ্যে ভারতে মেয়েদের অবস্থান স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ১৫০তম, শিক্ষাক্ষেত্রে ১১২তম, বেতনভিত্তিক শ্রম-বাজারে ১৪৯তম এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ১৮তম। বাকি ক্ষেত্রগুলিতে ভারতীয় মেয়েরা আগাগোড়াই পিছিয়ে; কিন্তু তাঁরা রাজনীতিতে এগিয়ে ছিলেন। ২০২১-এ ছন্দপতন। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে ভারতীয় মহিলারা যথাক্রমে ১৫৫, ১১৪ ও ১৫১তম স্থানে— অর্থাৎ, ‘ধারাবাহিকতা’ রক্ষিত; কিন্তু রাজনৈতিক অংশগ্রহণে ১৮ থেকে পিছিয়ে ৫১-তে!
ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম তিনটি উপাদানের ভিত্তিতে মহিলাদের রাজনৈতিক অবস্থা পরিমাপ করে— সংসদে মোট আসনের কত শতাংশ মহিলাদের দ্বারা অধিকৃত; দেশে মোট মন্ত্রিসংখ্যার কত শতাংশ মহিলা; এবং পঞ্চাশ বছরের মধ্যে কত বছর দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পদে মহিলারা থেকেছেন। তৃতীয় বিষয়টিতে একা ইন্দিরা গাঁধীই ভারতকে অনেক এগিয়ে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী পদে তাঁর সাড়ে পনেরো বছর এবং রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিভা পাটিলের পাঁচ বছর যে ঘিয়ের শিশি উপুড় করেছে, ভারতে তার খুশবু থাকবে আগামী অনেকগুলো বছর। বিশ্বের যে ৮৫টি দেশ আজও কোনও মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান পায়নি, তাদের থেকে এগিয়েও রাখবে।
সংসদে আসনের শতাংশ হিসেবে মহিলাদের আসন সংখ্যায় ২০১৯ থেকে ’২১-এ তেমন ফারাক হয়নি। কিন্তু মহিলা মন্ত্রীর সংখ্যা কমেছে বিস্তর। ২০১৯-এর ২৩% থেকে কমে ’২১-এ দাঁড়িয়েছে ৯%-এ! গত বছরে আর কোনও দেশের মহিলা মন্ত্রীর সংখ্যা এক ধাক্কায় এতটা কমেনি। রিপোর্ট বলছে, দেশের মন্ত্রিপদে মহিলাদের অনুপস্থিতিই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁদের পিছিয়ে দিয়েছে।
১৯৯২-এ ৭৩ ও ৭৪তম সংবিধান সংশোধনের ফলে গ্রামীণ ও নাগরিক স্তরে স্থানীয় শাসন ব্যবস্থায় মহিলাদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ হয়। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮— দু’টি লোকসভা নির্বাচনে, মহিলা ভোটারের সংখ্যা ৫% বাড়ে। ১৯৯২-এর আগে মুষ্টিমেয় মহিলাই স্থানীয় রাজনীতিতে যোগ দিতেন এবং তা হত পিতৃতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবারের প্রভাবে। এর পর থেকে ছবিটা পাল্টাল। স্থানীয় স্তরে এক-তৃতীয়াংশ আসন বরাদ্দ হলে, মহিলারা নবলব্ধ ক্ষমতার জোরে রাজনীতিতে বেশি এলেন। ১৯৯৩-৯৪’এ, দেশের স্থানীয় পঞ্চায়েত ও পুরব্যবস্থায় প্রায় আট লক্ষ মহিলা নির্বাচিত হন। অন্য দিকে, ১৯৯২ সালের আগে, উত্তরপ্রদেশের মহিলাদের অংশগ্রহণের হার ছিল ১%। কেরলে ১৯৯১-এই ৩০% আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকায়, জেলা পরিষদের ৩৫% আসন তাঁদের দখলে যায়। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার ১৯৭৭-এই ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু করেছিল। বস্তুত পশ্চিমবঙ্গের মডেলেই ৭৩ ও ৭৪তম সংবিধান সংশোধন আইন প্রণয়ন হয়। কিন্তু বামফ্রন্টের চালু করা ত্রিস্তরীয় ব্যবস্থায় মহিলা আসন সংরক্ষণের বিষয়টি ছিল না। ১৯৯২-এর পদক্ষেপটি রাজ্যভিত্তিক তারতম্য দূর করল, মহিলাদের রাজনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করল।
২০১১ সালের এক গবেষণা দেখিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের যে ৮৬% বাবা-মা চান মেয়ে গৃহবধূ হোক বা শ্বশুরবাড়ির পছন্দের কাজে থাকুক। যে অঞ্চলে এই মুহূর্তে পুরুষ প্রতিনিধি নেই, সে অঞ্চলের ছেলেদের ক্ষেত্রে অনুপাতটি এক শতাংশেরও কম। অর্থাৎ, মেয়েদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রশ্নটি সার্বিক ভাবে তাঁদের উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত। রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রতিবেদন বলছে, দেশে মহিলাদের রাজনৈতিক উপস্থিতি বাড়লে, তাঁদের নাগরিক সমস্যাগুলি প্রাধান্য পায় ও সমাধান ত্বরান্বিত হয়। তাই মহিলাদের সামগ্রিক উন্নতি ও দেশের লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রায় ৭০ কোটি মহিলার বসতভূমি ভারতে মোটামুটি ৩৯% লিঙ্গবৈষম্য বর্তমান। বিশ্বে শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য ঘোচাতেই নাকি লাগবে ১৪৫ বছর! তাই লিঙ্গবৈষম্যের মূল কারণগুলিকে পাখির চোখ করে, পৃথক পৃথক নীতি অধিগ্রহণের মাধ্যমে এগোতে হবে। বিবেচনাধীন নীতিগুলিকে ত্বরান্বিত করতে হবে। লোকসভা ও বিধানসভায় এক-তৃতীয়াংশ মহিলা আসন সংরক্ষণের ২০০৮ থেকে পড়ে থাকা বিলটি নিয়েও উদ্যোগ চাই। তবেই শিক্ষার সুফল পরিলক্ষিত হবে স্বাস্থ্য সচেতনতায়, স্বাস্থ্যের সুফল পড়বে মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে ও রাজনৈতিক ময়দানে বেশি যোগদানে, মুক্ত চিন্তা আর স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাতে প্রতিফলিত হবে তাঁদের প্রকৃত শিক্ষা।
এ বার পশ্চিমবঙ্গে আট জন মহিলা মন্ত্রী। ভবিষ্যতে আরও বাড়ুক সংখ্যাটি। ১৯৯২-এর মতো, আবারও পশ্চিমবঙ্গই দেশের মডেল হয়ে উঠুক।
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy