Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
Environment

শেষের দিক থেকে প্রথমে

ভারত সরকার জানিয়েছে, এই রিপোর্ট বিজ্ঞানসম্মত নয় এবং তারা এ রিপোর্ট মানছে না।

জয়ন্ত বসু
শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০২২ ০৫:২৮
Share: Save:

সদ্য প্রকাশিত এক আন্তর্জাতিক পরিবেশ সমীক্ষায় ভারত ‘সকল দেশের সেরা’ হয়েছে, অবশ্য শেষের দিক থেকে। ইয়েল সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল ল অ্যান্ড পলিসি ‘এনভায়রনমেন্ট পারফরম্যান্স ইনডেক্স’, অর্থাৎ পরিবেশ নিয়ে কাজকর্মে কোন দেশ কোথায় দাঁড়িয়ে তা নিয়ে যে সমীক্ষা করেছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে ২০২২ সালে ১৮০তম, অর্থাৎ শেষ স্থান পেয়েছে ভারত। রিপোর্টটিতে দেখা যাচ্ছে যে, ভারত ১০০-র মধ্যে সব মিলিয়ে ১৮.৯ নম্বর পেয়েছে। যে মূল সূচকগুলির উপর দাঁড়িয়ে দেশগুলিকে বিচার করা হয়েছে, তার অধিকাংশতেই ভারতের অবস্থান একেবারে নীচের দিকে।

প্রত্যাশিত ভাবেই ভারত সরকার জানিয়েছে যে, এই রিপোর্ট বিজ্ঞানসম্মত নয় এবং তারা এ রিপোর্ট মানছে না। তাদের কথায়, ভারত পরিবেশের যে বিষয়গুলিতে ভাল কাজ করছে, যেমন— সৌরশক্তি, সেগুলিকে সমীক্ষায় যথোপযুক্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়নি; গুরুত্ব দেওয়া হয়নি ভারতের পরিবেশ বিষয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকেও। ঘুরিয়ে বলা হয়েছে, খানিকটা ইচ্ছে করেই ভারতকে ‘লাস্ট বয়’ করা হয়েছে সমীক্ষাটিতে। বিদেশের কোনও সংস্থা থেকে রিপোর্ট বেরোলেই তাকে শিরোধার্য করতে হবে, এমন কোনও কথা নেই। এবং অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বিদেশের অন্য কোনও তথাকথিত বিখ্যাত সংস্থা একই বিষয় নিয়ে অন্য রকম রিপোর্ট দিচ্ছে। যেমন, সাম্প্রতিক রিপোর্টে জলবায়ু নিয়ে কাজের ক্ষেত্রে ভারত ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬৫ নম্বর স্থান পেলেও মনে পড়ে যাচ্ছে, গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলন চলাকালীন জার্মানওয়াচ সংস্থা দ্বারা প্রকাশিত রিপোর্টে একই বিষয়ে ভারত দশম স্থান পেয়েছিল! এটাও মানতে হবে, সৌরবিদ্যুৎ বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভারত এই মুহূর্তে বিশ্বে প্রথম সারিতে। ইয়েল-এর রিপোর্টের প্রত্যুত্তরে দেওয়া সরকারি জবাবের গোড়াতেও সৌরশক্তির কথা উঠে এসেছে।

আর চিন্তার কারণটা ওখানেই। বাজার জুড়ে যাওয়ার কারণে সৌরবিদ্যুতের ক্ষেত্রে মোটামুটি ভাল ফল করলেও, পরিবেশের অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নতির দাবি করার মতো অবস্থায় সরকারও নেই। বস্তুত, ভারতের খারাপ ফল হওয়ার পিছনে যে মূল কারণটি বিদেশি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ঘটাতে গিয়ে পরিবেশকে জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে, এমন অভিযোগ দেশের বিশেষজ্ঞরাও আগে করেছেন। সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতাও সে কথাই বলে। ‘ইজ় অব ডুইং বিজ়নেস’-এর নামে সরকার বিভিন্ন শিল্প কারখানাকে, নির্মাণকার্যকে বস্তুত ইচ্ছামতো পরিবেশকে দুরমুশ করার লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছে। পরিবেশের নিয়ম ভাঙাটাই সরকারি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদতে এখন নিয়ম।

ফলে, বায়ুদূষণের জন্য আক্রান্ত দেশগুলির মধ্যে ভারত যে সামনের সারিতে থাকবে, বা উষ্ণায়নের ক্ষেত্রেও— তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। আশ্চর্য হল, পরিবেশের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ সূচকের ক্ষেত্রেই একেবারে পিছনে চলে যাওয়া। জীববৈচিত্র রক্ষায় ভারতের স্থান ১৭৯, বাতাসের গুণমানে ১৭৯, স্বাস্থ্যে ১৭৮, আর জলবায়ু পরিবর্তন সামলানোর ক্ষেত্রে সামান্য ভাল, ১৬৫তম স্থান। আরও চিন্তার হল, শুধু তালিকার তলায় থাকা নয়, পরিবেশের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভারতের গত এক দশকে ক্রমাবনতি ঘটেছে। সেই তালিকায় রয়েছে ইকোসিস্টেম সার্ভিস বা বাস্তুতন্ত্র থেকে পাওয়া পরিষেবা। গাছের সংখ্যা, জলাভূমির পরিমাণ, মৎস্য চাষ— এমন অজস্র বিষয়। শৌচব্যবস্থা এবং পানীয় জলের ক্ষেত্রে খানিকটা উন্নতি হলেও সে সব ক্ষেত্রেও ভারতের স্থান শেষের দিকেই। ১৮০টি দেশের মধ্যে যথাক্রমে ১৩৮ ও ১৪১তম।

প্রশ্ন হল, ইট, কাঠ, পাথরের তৈরি উন্নয়নের পিঠে সওয়ার হতে গিয়ে আমরা আসল উন্নয়ন, পরিবেশসম্মত সুস্থায়ী উন্নয়নকেই মেরে ফেলছি কি না! মনে রাখতে হবে, গত দশ বছরের অধিকাংশ সময় মোদী সরকার দেশ জুড়ে পরিকাঠামোর উন্নয়নকে পাখির চোখ করেছে এবং ভবিষ্যতে তার উপর দাঁড়িয়েই পাঁচ ট্রিলিয়ন অর্থনীতির স্বপ্ন দেখাচ্ছে। তাতে অর্থনীতির সত্যি কতটা উন্নতি হয়েছে, সে হিসাব অর্থনীতিবিদরা দেবেন, কিন্তু পরিকাঠামো নামক অশ্বমেধ ঘোড়ার দৌড়ের ধাক্কায় পরিবেশ যে বহুলাংশে পিছিয়ে পড়েছে, সঙ্গে দেশের সামাজিক পরিস্থিতি, তাতে সন্দেহ নেই।

এমন নয় যে, বিজেপি সরকারের আগে ভারত পরিবেশের ক্ষেত্রে খুব একটা সামনের সারিতে ছিল। কিন্তু স্পষ্টতই এতটা গভীর সঙ্কটে ছিল না। পরিসংখ্যানও একই কথা বলছে। ২০১৬ সালে, অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদী তখতে বসার দু’বছর পরে, ভারত ছিল ১৪১ নম্বরে, যাকে খানিকটা আগের মনমোহন সিংহ জমানার ফল বলে ধরে নেওয়া যায়। সেটাই ২০১৮ সালে নেমে এল ১৭৭-এ, ২০২০ সালে সামান্য উঠে ১৬৮-তে। আর এ বছর সবার পিছনে, অর্থাৎ ১৮০তম স্থানে। সদ্য প্রকাশিত রিপোর্টের খুঁটিনাটি নিয়ে নানা প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। আমরা তর্ক করতেই পারি যে, ভারত পরিবেশের ক্ষেত্রে ‘লাস্ট বয়’ নয়। কিন্তু এটা বোধ হয় মেনে নিতেই হবে যে, ‘লাস্ট বয়’ না হলেও আমরা এখন লাস্ট বেঞ্চের ছাত্র।

অন্য বিষয়গুলি:

Environment India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy