Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
সুখে থাকতে জানলে বাড়তি রোজগার কি সত্যিই সুখ বাড়ায়
Happiness

দুঃখ কিসে যায়?

কানেম্যান আর অ্যাঙ্গাস ডিটন— দু’জনের অফিস ড্রয়ারেই একটা করে নোবেল প্রাইজ় আছে, মনে রাখিস— একটা পেপার লিখেছিলেন সুখ নিয়েই।

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০২৩ ০৭:৩৩
Share: Save:

বয়স হচ্ছে, বুঝলি। শেষ পর্যন্ত খবরের কাগজ পড়ে জানতে হল যে, কানেম্যান আর কিলিংসওয়র্থ-এর বিরোধের ফয়সালা হয়েছে!” একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন শিবুদা, সেটা আসল না লোকদেখানো, বোঝা গেল না।

“ড্যানিয়েল কানেম্যানকে তো চিনি, এই কিলিংসওয়র্থ আবার কে?” প্রশ্ন করল সূর্য। “আমিও কি ছাই চিনতাম,” বললেন শিবুদা। “কানেম্যানের রিসার্চকে চ্যালেঞ্জ করে যখন প্রথম পেপার লিখলেন, তখন খোঁজখবর নিয়ে দেখলাম যে, নিতান্ত বাচ্চা ছেলে। এখন ওয়ার্টনে আছেন। কানেম্যানের সঙ্গে টক্কর নেওয়ার মতো ওজন আছে, এক বারও মনে হবে না। কিন্তু, গত পনেরো বছর ধরে পড়ে আছেন একটাই জিনিস নিয়ে— হ্যাপিনেস রিসার্চ। কানেম্যান আর অ্যাঙ্গাস ডিটন— দু’জনের অফিস ড্রয়ারেই একটা করে নোবেল প্রাইজ় আছে, মনে রাখিস— একটা পেপার লিখেছিলেন সুখ নিয়েই। তাঁরা ৪৫,০০০ জনের উপর সমীক্ষা করে জানিয়েছিলেন, রোজগার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সুখের পরিমাণও বাড়ে বটে, কিন্তু তার একটা ঊর্ধ্বসীমা আছে— বছরে রোজগার ৭৫,০০০ ডলারের বেশি হলে আর বাড়তি রোজগার সুখের পরিমাণ বাড়ায় না। তার উত্তরে ম্যাট কিলিংসওয়র্থ প্রায় ৩৩,৫০০ জনের উপর সমীক্ষা করে পেপার লিখে বললেন, আদৌ তেমন কোনও ঊর্ধ্বসীমা নেই— বছরে পাঁচ লক্ষ ডলারের বেশি আয়, এমন লোকের কথা বলতে পারবেন না, কিন্তু তার নীচে যাঁরা আছেন, তাঁদের সবারই আয় বাড়লে হ্যাপিনেসও বাড়ে।”

গোপাল আজ আলুর চপ ভেজেছে। থালায় করে গোটাকয়েক চপ দিয়ে গেছিল। তার থেকে তৃতীয় বার একটা চপ তুলে নিয়ে বলল তপেশ, “এটা নিয়েই আনন্দবাজার-এ অতনু বিশ্বাসের একটা লেখা বেরিয়েছিল না মাসখানেক আগে? এই যে, কানেম্যান আর কিলিংসওয়র্থ এক সঙ্গে রিসার্চ করে দেখেছেন যে, আসলে দু’জনেই ঠিক, কিন্তু কিলিংসওয়র্থ একটু বেশি ঠিক?”

শিবুদা ঘাড় নেড়ে “হ্যাঁ” বললেন। শিশির ফুট কাটল, “কে বলে খবরের কাগজে প্রকাশিত লেখার মেয়াদ একবেলা, তার পরই সব ঠোঙা!” “প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সস-এ কানেম্যান আর কিলিংসওয়র্থ-এর প্রবন্ধটা বেরিয়েছে এই মার্চে। দেখলাম, দু’জনের পৃথক কাজে যে কথাটা ধরা পড়েনি, যৌথ গবেষণায় সে দিকে নির্দেশ করেছেন তাঁরা। আয়বৃদ্ধির সঙ্গে সুখের সম্পর্ক সবার ক্ষেত্রে এক রকম নয়। যাঁরা স্বভাবতই সুখী— সুখের মাপে সত্তর পার্সেন্টাইলের উপরে আছেন যাঁরা— তাঁদের সুখের পরিমাণ আয়বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ে তো বটেই, রোজগারের পরিমাণ বছরে এক লক্ষ ডলারের বেশি হলে সুখ বাড়তে থাকে আরও দ্রুত হারে। অন্য দিকে, স্বভাবতই যাঁরা অসুখী— সুখের মাপে পনেরো পার্সেন্টাইল বা তার নীচের লোকজন— তাঁদের আয় এক লক্ষ ডলারের কাছাকাছি পৌঁছলে বাড়তি আয় আর বাড়তি সুখ দেয় না। এই দু’দলের মাঝামাঝি রয়েছেন যাঁরা, তাঁদের ক্ষেত্রে এমন কোনও ওঠাপড়া নেই— আয় বাড়লেই সুখের পরিমাণও বাড়ে।” কথা শেষ করে চপের থালার দিকে হাত বাড়ালেন শিবুদা। একটাই পড়ে আছে, বাকিগুলো শিশির আর তপেশ পাল্লা দিয়ে শেষ করেছে।

“আজ বড্ড নীরস কচকচি করছেন,” শিবুদা থামতেই তপেশ মতামত জানায়। চপটা শেষ করে চায়ে চুমুক দিলেন শিবুদা। বললেন, “যদি তোর লেখাপড়ার অভ্যাসটুকু থাকত, তা হলে এতখানি ব্যাখ্যান করে বলতে হত না। গোড়ার কচকচিটুকু না জানলে পরের কথাগুলো কি বুঝবি কিছু?”

একটা সিগারেট ধরালেন শিবুদা। বললেন, “এই গল্পে প্রথম স্পিনটা দিয়েছেন কানেম্যান নিজেই। লিখেছেন, আসলে সুখ নয়, আয়ের সঙ্গে সম্পর্কটি অ-সুখের। অর্থাৎ, দুঃখের। আয় বাড়লে মানুষের দুঃখ কমে কি না, তার মাপজোখ। এ বার ভাব, একটা নির্দিষ্ট ধাপের পরে আয় বাড়লেও কাদের দুঃখের পরিমাণ কমছে না— যাঁরা স্বভাবতই অসুখী, তাঁদের। পনেরো পার্সেন্টাইলের নীচে যাঁরা— অর্থাৎ, যত জনের মধ্যে সমীক্ষা হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে কম সুখী পনেরো শতাংশ মানুষ। কানেম্যান আঁচ করছেন, এঁদের জীবনে এমন কোনও অ-সুখ আছে, টাকা যাকে ঢাকতে পারে না। প্রিয়জনের মৃত্যু, বিচ্ছেদ, বড় ধরনের অসুস্থতার সঙ্গে লড়ছেন কেউ কেউ, আবার কেউ হয়তো ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের শিকার। অন্যদের মতো এঁদেরও এমন কিছু অ-সুখ আছে, যেগুলো টাকা বাড়লে কমে— যেমন, ক্রেডিট কার্ডের দেনা মেটানোর চিন্তা কমে, চিকিৎসার খরচের ব্যবস্থা হলে সে চিন্তা কমে। কিন্তু, সেই ধাপটুকু পেরিয়ে গেলে টাকা যে বাড়তি সুখ দিতে পারে, এঁদের অ-সুখের চরিত্র এমনই যে, সেই সুখ এঁরা গ্রহণ করতে পারেন না।”

“হায় আল্লা, এ কথাটুকু বলার জন্য এত সমীক্ষা, এত তামঝাম! ভেবে দেখুন, যিনি সন্তানশোক বুকে চেপে বাঁচছেন, টাকা কি সত্যিই তাঁর দুঃখের বোঝা লাঘব করতে পারে, তাঁকে সুখ দিতে পারে?” ইয়ার্কির সুরে প্রশ্নটা শুরু করলেও তপেশের কথায় বাকি তিন জন চুপ করে গেল। একটু পরে মুখ খুললেন শিবুদাই। বললেন, “স্যাম্পল সাইজ়-এর ১৫ শতাংশের জীবনে এমন গভীর শোক আছে, সেটা মানতে একটু অসুবিধা হচ্ছে না তোদের? মনে হচ্ছে না, অন্য কোনও ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন? ড্যানিয়েল গিলবার্ট-এর নাম শুনেছিস কি? হার্ভার্ডে সাইকোলজি পড়ান, স্টাম্বলিং অন হ্যাপিনেস নামে একটা বই লিখেছিলেন, যে বইটাকে বাদ দিয়ে সুখের চর্চা অসম্ভব। তো, এই ড্যান গিলবার্ট বিভিন্ন পার্টিতে গিয়ে বিভিন্ন লোককে আচমকা প্রশ্ন করতেন, ‘ধরুন, যদি দু’বছর পরে আপনার সন্তান মারা যায়, কেমন বোধ করবেন?’ প্রশ্নটা যে ঠিক ভদ্রজনোচিত নয়, গিলবার্ট নিজেই স্বীকার করেছেন— বলেছেন, এই প্রশ্ন তাঁর জনপ্রিয়তা এমনই বাড়িয়েছে যে, কেউ আর ভুলেও কোনও পার্টিতে তাঁকে নিমন্ত্রণ জানায় না। তাঁর প্রশ্ন শুনে প্রায় সবাই রেগে গিয়েছিলেন; বলেছিলেন, ‘সন্তান মারা গেলে আমি যদি বাঁচিও, জীবন্মৃত হয়ে বাঁচব। তিলমাত্র আনন্দ থাকবে না আমার জীবনে।’ গিলবার্ট লিখেছেন, প্রত্যেককে এই ‘ভুল’ উত্তর দিতে শোনাও একটা অভিজ্ঞতা।”

“সন্তানের মৃত্যু ঘটলে নিজের বেঁচে থাকা আনন্দহীন হয়ে যাবে, এ কথাটা ভুল?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করে সূর্য। বাকি দু’জনও একই রকম অবাক।

“ভুল, কারণ অভিজ্ঞতা বলছে, সন্তান হারিয়েছেন এমন এক জন গড়পড়তা মানুষ— সন্তানের মৃত্যুর পরে কিছু দিন কেটে গেলে— অন্যদের মতোই কাজকর্ম করেন, বেড়াতে যান, রেস্তরাঁয় খেতে যান, সিনেমা দেখেন, যৌনতাও করেন। সন্তানশোক কিছু মানুষকে স্তব্ধ করে দেয় ঠিকই, তবে সবাইকে নয়।” কথাগুলো বলে একটু থামলেন শিবুদা। ঝোলা থেকে বোতল বার করে এক ঢোঁক জল খেয়ে ফের কথার খেই ধরে নিলেন, “কিন্তু, সন্তানশোক পেলে ভবিষ্যতের চেহারাটা ঠিক কেমন হবে, তা অনুমান করতে বললে এই কথাগুলো মনে পড়ে না, তখন শুধু এক গভীর দুঃখের কথা মনে আসে। সন্তানের মৃত্যুর কথাটা আসলে স্ট্রং একটা প্রম্পট, মনের গড়নটা বোঝানোর জন্য। যখন ভবিষ্যতের কথা ভাবি, তখন তো কল্পনা করি মাত্র— সেই কল্পনা হয় আমাদের মনের কোনও আশাকে অনেক বড় করে দেখায়, ভবিষ্যৎ আসলে যতখানি ভাল হতে পারে আমরা তার চেয়ে অনেক রঙিন কল্পনা করি; বা তা আমাদের আশঙ্কাকে বহু গুণ বাড়িয়ে চাপিয়ে দেয় ভবিষ্যতের ঘাড়ে। আসলে আমরা ভবিষ্যতে যতখানি ভাল থাকব, তার চেয়ে অনেক কম মনে হয় সেই ভাল থাকার পরিমাণ।

“অবিশ্যি, শুধু ভবিষ্যৎই নয়, অতীত সম্বন্ধেও একই জিনিস করে আমাদের মন। অতীতে কী ঘটেছিল, তার পুরোটা মনে রাখা তো সম্ভব নয়, আমরা মনে রাখি কিছু বিশেষ ঘটনা, বিশেষ অনুভূতি। পরে যদি মনে করতে হয় যে, অতীতে আমরা ঠিক কতখানি সুখী ছিলাম, সেই বিশেষ কিছু স্মৃতিকে ঘিরে আমরা আসলে অতীতটাকেও কল্পনা করি। এবং, তাতেও একই ঘটনা ঘটে— যদি সুখস্মৃতি থাকে, তা হলে সেটাই ফুলেফেঁপে উঠে অতীতকে আসলের চেয়ে বেশি সুখের করে তোলে; দুঃখের স্মৃতি ঠিক উল্টোটা করে।”

“তা না হয় হল, কিন্তু এর সঙ্গে আয় বাড়লে কিছু লোকের বেশি ভাল থাকা, আর কিছু লোকের ভাল থাকার পরিমাণ না বাড়ার সম্পর্ক কোথায়?” প্রশ্ন করল শিশির।

“আছে, আছে। সেই উত্তর দিয়েছেন গিলবার্ট আর কিলিংসওয়র্থ, তাঁদের ২০২০ সালের একটা পেপারে,” উত্তর দিলেন শিবুদা। কোনও বিষয়ে তাঁর আগ্রহ তৈরি হলে শিবুদা যে তার আগাপাছতলা পড়ে ফেলেন, শিশিররা আগেও বহু বার দেখেছে। বোঝা যাচ্ছে, এখন হ্যাপিনেস নিয়ে পড়েছেন। শিবুদা বললেন, “ওঁরা দু’জন দেখিয়েছেন যে, মানুষ বেশির ভাগ সময়ই আসলে বর্তমানে বাঁচে না। তার মন হয় অতীতে থাকে, নয় ভবিষ্যতে। বর্তমানে তাদের যে সুখ বা অ-সুখ, তাতেও আসলে অতীত বা ভবিষ্যতের প্রভাব বিপুল। এ বার পুরোটাকে ছকে ফেলে দে— দেখবি খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। মোদ্দা কথাটা হল, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিংড়ে কেউ যদি শুধু দুঃখ উদ্বেগ আশঙ্কা নিয়ে বাঁচেন, টাকার সাধ্যি নেই তাঁকে সুখী করার। বাকিদের জন্য, আয় বাড়া মানেই সুখ বাড়া।”

অন্য বিষয়গুলি:

Happiness World Happiness Report
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy