রোজকার কাজ-কর্মে বাংলা ভাষা কি ব্যবহারযোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে? এক জন বাঙালি নাগরিক যিনি কেবল বাংলাই জানেন, তিনি কি খুব সহজে নিজে-নিজেই পশ্চিমবঙ্গের এটিএম থেকে বাংলা ভাষার নির্দেশ পড়ে টাকা তুলতে পারবেন? কিংবা, কৃষিজীবীর জন্য কি পাওয়া যায় বোধগম্য বাংলা ভাষায় লেখা কৃষিবিজ্ঞানের কোনও বই? বিভিন্ন ওষুধ-কোম্পানি আর হাসপাতালগুলি ওষুধের ও নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির গুণাবলি ব্যাখ্যা করে বাংলা ভাষায় কিছু লিখলেও আমরা কি তা পড়ি? না কি পড়তে গিয়ে হোঁচট খেয়ে চলে যাই অনায়াস ইংরেজিতে লেখা ব্যাখ্যায়? অভিজ্ঞতা বলছে, বাংলা ভাষাকে আমরা অনেকেই নিত্যদিনের কাজে লাগানোর চেষ্টা করি না। এটিএম থেকে শুরু করে ওষুধ কোম্পানির নির্দেশ, কোথাও সহজ-সাবলীল বোধগম্য বাংলার দেখা মিলবে না। প্রতিষ্ঠিত কোনও বাঙালি সাহিত্যিক, মেধাজীবী বা বাংলা ভাষার শিক্ষককে যদি বলা হয়, বোঝা যায় এমন সংযোগের বাংলা তৈরির কাজে মন ও মাথা ব্যবহার করুন, তা হলে তাঁদের অনেকেই রাজি হবেন না। ভাবখানা এই, কাজের বা ব্যবহারের উপযুক্ত বাংলা ভাষা গড়ে তোলার দায়িত্ব তাঁদের নয়, এই সব ছোটখাটো ভাষাকেন্দ্রিক দায় তো অন্য কেউ নিলেই পারেন।
অথচ বাংলা ভাষাকে নিত্যদিনের কাজে লাগানোর জন্য একদা যাঁরা শ্রম করেছিলেন তাঁরা ঢের বড় মাপের মানুষ। বুঝতে পেরেছিলেন তাঁরা, গদ্যভাষা কেবল ভাবে ও সৃষ্টিময়তায় বেঁচে থাকে না, তাকে নিত্যদিনের ছোট ছোট কাজে ব্যবহারের উপযুক্ত করে তুলতে হয়। ছোটর ভিতেই যেমন বড় দাঁড়িয়ে থাকে, তেমনই আবার বলা চলে বড়কে সোজা-সাপটা ভাবে বুঝতে-ভাবতে পারেন যাঁরা, তাঁরাই কিন্তু অনায়াসে নিত্যদিনের কাজে হাত লাগাতে চান। তা না হলে বঙ্কিমচন্দ্র কেন লিখবেন সহজ রচনাশিক্ষার মতো বই! সেখানে বঙ্কিমের স্পষ্ট নির্দেশ, “তুমি যাহা লিখিলে, লোকে যদি তাহা না বুঝিতে পারিল, তবে লেখা বৃথা।” বা ব্যবহারিক বাংলার প্রথম শর্তই হল লোকে যেন বুঝতে পারে। দুর্ভাগ্য, ব্যবহারিক বাংলা বাঙালি বোঝে না, ইংরেজিশিক্ষিত ভদ্রলোকের কাছেও তা অচল, ইংরেজি না-জানা সাধারণের কাছেও তা দুর্বোধ্য।
অথচ উনিশ শতকে বাংলা গদ্যভাষা যখন নানা দিকে ডালপালা মেলছে, তখন কৃতবিদ্যরা বাংলা ভাষায় সাধারণের কাছে নানা তথ্য পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেন। ইংরেজিতে যাকে বলে ম্যানুয়াল বা হ্যান্ডবুক, বাংলাতেও লেখা হচ্ছিল সে জাতীয় সহজ-নির্দেশের বই। প্যারীচাঁদ মিত্র আর অক্ষয়কুমার দত্ত দু’জনেই সে কালের খ্যাতকীর্তি বাঙালি। প্যারীচাঁদ আলালের ঘরের দুলাল-এর লেখক হিসেবে সুপরিচিত। সেই প্যারীচাঁদই লিখেছিলেন কৃষিপাঠ-এর মতো বই। তা সাহিত্যগ্রন্থ নয়, কী ভাবে নানাবিধ ফসলের চাষ করা যায় সে বিষয়ে নির্দেশিকা। ডিরোজিয়ো-শিষ্য প্যারীচাঁদ যখন এগ্রিকালচারাল সোসাইটির সদস্য, তখনই সহজ-বাংলায় কৃষিবিষয়ক এই নির্দেশিকা-পুস্তিকা রচনা করেন। অক্ষয়কুমার দত্ত লেখেন বাষ্পীয় রথারোহীদিগের প্রতি উপদেশ, ‘যাঁরা কলের গাড়ী আরোহণ করিয়া গমন করেন’ তাঁদের ‘বিঘ্ন নিবারণের উপায়’ নিয়ে বইটি লেখা। তত্ত্ববোধিনী সভার প্রেস থেকে বইটি প্রকাশিত। ইংরেজ আমলে রেলগাড়ি ও অন্য যানবাহন চালু হল। সেগুলি সম্বন্ধে সাধারণের মনে ভয়, না-জানা আশঙ্কা। রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি-তে আছে দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে উপনয়নের পর যখন তিনি বাইরে যাবেন তখন রেলে চাপা নিয়ে তাঁকে ভয় দেখায় সমবয়সিরা। অক্ষয়কুমার দত্তের বই পড়লে বাষ্পীয় শকট সম্পর্কে জানাও যাবে, কী করা উচিত ও উচিত নয় তা শেখাও যাবে।
এই যে দৈনন্দিন কাজে জনসংযোগের উপযুক্ত ভাষা তৈরির চেষ্টা শুরু হয়েছিল তা কেবল চাষ কিংবা রেলগাড়ি চাপার নিয়ম-কানুনেই আটকে থাকেনি। ভাষার ব্যবহারিকতার ও সংযোগের ক্ষেত্রটিকে বিস্তৃত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন চিন্তকেরা। উনিশ শতকের আশির দশকে জাতীয় কংগ্রেস তৈরি হল। রবীন্দ্রনাথ খেয়াল করলেন এই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটির মাথায় রয়েছেন যে ভদ্রলোকেরা, তাঁরা ইংরেজিদুরস্ত। ফলে প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভায় সাধারণ মানুষের সামনে তাঁরা ইংরেজিতেই বক্তৃতা দেন। সে বক্তৃতা যাঁদের জন্য তাঁরা কিছুই বোঝেন না। ফলে রবীন্দ্রনাথের দাবি, কংগ্রেসের প্রাদেশিক সভায় সাধারণের ভাষা ব্যবহার করতে হবে। ইংরেজিওয়ালা নেতারা অবশ্য সে কালে রবীন্দ্রনাথকে একহাত নিতে ছাড়েননি। তাঁদের বক্তব্য জনসাধারণ যেমন তাঁদের ইংরেজি বোঝেন না, তেমনই রবীন্দ্রনাথের বাংলাও বোঝেন না। কথাটা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। তবে রবীন্দ্রনাথ দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন, যে বাংলা তিনি লেখেন সে বাংলা সাধারণ মানুষ হয়তো বোঝেন না, কিন্তু তাঁদের বোঝানোর উপযুক্ত ভাষা নির্মাণে রবীন্দ্রনাথ প্রয়াসী হন। জমিদার হিসেবে গ্রামের প্রজাসাধারণের অবস্থা তিনি নিজের চোখে দেখেছিলেন। তাঁদের কাছে তাঁদের ভাষায় পৌঁছনোর দায়িত্ব তিনি অস্বীকার করেননি। বঙ্গভঙ্গের সময় বাউলের সুরে সহজ ভাষায় স্বদেশ পর্যায়ের যে গানগুলি লিখেছিলেন সেগুলির আবেদন সাধারণের কাছে গভীর। রবীন্দ্রনাথের মতোই গান্ধী দেশে ফিরে কেবল তাঁর বিলিতি বস্ত্রসজ্জাই বদল করলেন না, মুখের ভাষাও ফেললেন বদলে। প্রথম প্রথম ভুল হিন্দি বলতেন তবে সে দেশের বুলি ছাড়েননি, ভাল ভাবে ক্রমে রপ্ত করেছিলেন। যখন দাঙ্গাকবলিত নোয়াখালিতে মানুষের কাছে যাচ্ছেন, তখন বাংলা শেখার চেষ্টা করছেন সংযোগ স্থাপনের জন্যই।
সংযোগের বিষয়টি যে কোনও সংবেদনশীল সমাজ-সচেতন মানুষকেই ভাবিয়েছিল। বামপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবি হিসেবে কতটা শক্তিশালী ছিলেন, তা আর নতুন করে বলার কী আছে! সৃষ্টিশীল সুভাষ ভাষার সংযোগ রক্ষায় সর্বদা সজাগ। পদাতিক হিসেবে মানুষের কাছে যান, তাঁদের সঙ্গে থাকেন, কবিতায় তাঁদের ভাষা ভাব কথা নিয়ে আসেন। লেখেন কাজের বাংলা-র মতো বই। নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙ্গালীর ইতিহাস-এর মতো বৃহদায়তন গুরুত্বপূর্ণ বইটির সংক্ষিপ্ত সহজ রূপ তৈরি করেন। তাঁর হাংরাস উপন্যাসে একটি সমস্যার কথা ছিল, সাধারণ শ্রমিকেরা তো ভদ্রলোক তাত্ত্বিকদের ভাষায় মার্ক্সবাদ বুঝতে পারেন না। তাঁদের ভাষার অভিজ্ঞতার সঙ্গে তত্ত্বের ভাষা মেলে না। এই দায়িত্ব থেকেই সুভাষ লিখেছিলেন ভূতের বেগার। চুয়ান্ন সালের সে বইয়ের ভূমিকায় জানিয়েছিলেন, “আমাদের দেশে মার্ক্সবাদ-পড়া পণ্ডিতের অভাব নেই। দুঃখের বিষয়, তাঁরা বিদ্যের জাহাজ হয়ে বসে আছেন— কম লেখাপড়া-জানা মানুষদের কাছে খানিকটা জ্ঞান পৌঁছে দেবার তেমন চাড় তাঁদের তরফ থেকে দেখা যাচ্ছে না।” সে কাজটুকুই করেছেন তিনি। তাঁর আশা, “ছোট ডিঙির আস্পর্ধা দেখে জাহাজদের টনক নড়বে।”
না, টনক আমাদের নড়েনি। বাংলা ভাষায় কাজের জগৎ গড়ে তোলার দায় আমরা কম-বেশি সবাই অস্বীকার করেছি। এমনকি বাংলা ভাষায় নানা চিন্তা নিয়ে আমরা যারা পরস্পর মতবিনিময় করি, তারাও নিজেদের পরিধি বিস্তারের জন্য উপযুক্ত সহজ ভাষার সন্ধান ও অনুশীলন করি না। ভাবনাটা আর একটু সম্প্রসারিত হোক আরও মানুষের কাছে যাক, এই দায় যেন নিতে নেই। আমরা বলছি, আমরা শুনছি, আমরাই আত্মতৃপ্তিতে ভুগছি। ভাবনা পৌঁছনোর সে দায় আমরা নেওয়ার চেষ্টা করি না বলেই একেবারে যা কাজের ভাষা তাও তেমন করে গড়ে ওঠে না। সাধারণ মানুষের কাছে সরকারি বিজ্ঞপ্তি কি সহজ বাংলায় যাচ্ছে? সে বাংলা সহজ বোধগম্য ও দৈনন্দিনের উপযুক্ত চলিত? তা নিয়ে কি ভাবছেন কেউ? অসরকারি ক্ষেত্রে ভাবার দায় তো আরও কম। ওষুধ কোম্পানির কিংবা বিজ্ঞাপনের ভাষা আজ ইংরেজি হিন্দির এমনই অক্ষম, বোধহীন বাংলা অনুবাদ যে তা লজ্জিত করে। অথচ আমরা কোনও দায় নিই না। এই দায় না-নেওয়া কিন্তু ভাষার উপরেই এসে পড়ে। ব্যবহারিক বাংলার, সংযোগের বাংলার দীনতা বাঙালির অস্তিত্বকেই বিপন্ন করছে।
বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy