ভারতীয় অর্থনীতিতে সঙ্কট বিষয়টিকে ‘স্বাভাবিক’ বলেই এত কাল গণ্য করা হয়েছে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ভারতীয় অর্থনীতিতে সঙ্কট বিষয়টিকে ‘স্বাভাবিক’ বলেই এত কাল গণ্য করা হয়েছে। ১৯৬২ থেকে ১৯৭৪— এই ১২ বছরে ভারত তিনটি যুদ্ধে জড়িয়েছে, বিহারের মতো অঞ্চলে চারটি খরাপ্রসূত দুর্ভিক্ষ পার হয়েছে এবং প্রথম তৈলসঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছে। যেখানে অপরিশোধিত খনিজ তেলের দাম চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ভারত সেই দুই অঙ্কের মুদ্রাস্ফীতি পার হয়ে এসেছে, যা ২৬ শতাংশের সূচককে স্পর্শ করেছিল। এবং ১৯৯৬ সালে ভারতীয় মুদ্রার মান অবনমিত হয়ছিল প্রায় ৩৬ শতাংশ। তার উপরে নীতিগত ভ্রান্তির কারণেও ভারত বিপর্যস্ত হয়েছে। যেমন খাদ্যশস্যের পাইকারি বাণিজ্যের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে গিয়ে অবিমিশ্রকারিতার পরিচয় রাখা হয়েছিল।
এ সবের উপর সেই সময় ছিল রাজনৈতিক গোলযোগ (শাসক দল কংগ্রেসের মধ্যে বিভাজন)এবং বিস্তর প্রতিবাদ-আন্দোলন: প্রবল শ্রমিক হরতাল, নকশাল আন্দোলনের জন্ম এবং জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বধীন আন্দোলন— এই সব কিছু গিয়ে দাঁড়ায় ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা ঘোষণায়।
গত অর্ধশতকে তেমন কোনও বিপর্যয়ের পর্ব এ দেশ দেখেনি। যদিও এই কালপর্বে ভারত একের পর এক তৈল সঙ্কট প্রত্যক্ষ করেছে। যার মধ্যে একটি আবার এক খরা-পরিস্থিতির মধ্যে ঘটেছিল (এই দুইয়ের যৌথ ক্রিয়ায় মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি ১৯৭৯-’৮০ সালে ৫ শতাংশ হ্রাস পায়)। এই সময়ে খলিস্তান এবং কাশ্মীর প্রশ্নে জাতীয় সংহতি বিপন্ন হয়ে পড়ে, ১৯৯১ সালে বৈদেশিক বিনিময় নিয়ে সঙ্কট দেখা দেয়, এশিয়া এবং বিশ্বময় অর্থসঙ্কটকে এই অর্ধ শতকেই পেরতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই সব ঘটনাই ছিল ‘দৈবাৎ’ ঘটে যাওয়া। এগুলিকে ‘নিয়মিত’ বলে চিহ্নিত করা যায় না। কিন্তু এই সব ঘটনা খুব কম সময়ের ব্যবধানে ঘটে। সাম্প্রতিক কালে আবার ‘যুগ্ম ব্যালান্সশিট সঙ্কট’ দেখা দিয়েছে, যার এক দিকে রয়েছে ঋণভারে জর্জরিত সংস্থা এবং অন্য দিকে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া ব্যাঙ্ক। সক্রিয় রয়েছে ২০১৬-র নোটবন্দি এবং কোভিড অতিমারির তিনটি তরঙ্গ-সহ ২০২০-র লকডাউনের অভিঘাত। এবং এই মুহূর্তে আরও একটি তৈল সঙ্কট প্রকট হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে।
প্রশ্ন হল, কী ভাবে অর্থনীতিকে সঙ্কট-প্রতিরোধের বর্ম দেশ ধারণ করবে? খাদ্যসঙ্কটের কাল বিগত হয়েছে, এখন সমস্যা বরং অতিরিক্ত উৎপাদন নিয়ে। বৈদেশিক বিনিময়ের জন্য সঞ্চয়ের পরিমাণও স্বস্তিদায়ক, মুদ্রাস্ফীতি কমে এসেছে এবং সেই কারণে টাকার বাজারও স্থিতিশীল। খনিজ তেলের দামবৃদ্ধির আপৎকালীন অবস্থা অন্তত আংশিক ভাবে সামলানোর জন্য তৈল সঞ্চয়ের একটি প্রচেষ্টাও গৃহীত হয়েছে। যদি তেলের দাম কমে, তা হলে এই সঞ্চয়ের ভাঁড়ারটিকে দ্বিগুণ করে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। শক্তির ক্ষেত্রে আমদানির উপরে নির্ভরশীলতার বড় সমস্যাটি অবশ্য রয়ে গিয়েছে। এর কোনও সমাধান-সূত্র এখনও বার হয়নি। অনাগত ভবিষ্যতে ভারত যে তেল, গ্যাস এবং কয়লার অন্যতম বৃহৎ আমদানিকারক দেশগুলির একটি হয়ে থাকবে, এই সত্য কিন্তু দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট।
সংস্থাগত স্তরে কর্পোরেটগুলির হিসাব-নিকাশ আগের থেকে অনেক বেশি দৃঢ় ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত— ঋণ ও ইকুইটির অনুপাতে স্বাস্থ্যের ঝলক দেখা গিয়েছে। লভ্যাংশের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের প্রবণতায় রাশ টানা হয়েছে। ব্যাঙ্কগুলিতে মূলধন সরবরাহ আগের থেকে ভাল এবং আধমরা উদ্যোগ দেখিয়ে পুঁজি আটকে রাখার প্রবণতাসম্পন্ন ভুতুড়ে সংস্থার সংখ্যাও ক্রমহ্রাসমান। যদিও আরক্ষার বেশ কিছু পাঁচিল এ ভাবে গড়ে উঠছে। তবুও দেশীয় অর্থনীতি বহুল পরিমাণে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার সামনে উন্মুক্ত এবং সেই খোলা হাওয়ায় নিজেকে টিকিয়ে রাখার প্রমাণ তাকে এখনও দিতে হচ্ছে। বাণিজ্য সংস্থাগুলির তরফে অনাগত বিপদের কথা ভেবে বর্মনির্মাণ যেমন জরুরি, সেই বিপদের পরিমাণটি ঠিক কেমন, তা যথাসময়ে পুনর্বিবেচনা করাও জরুরি। প্রতিরক্ষার মতো কৌশল-নির্ভর ক্ষেত্রে দেশজ সুত্র থেকে ঘনবদ্ধ প্রণোদনার প্রয়োজন রয়েছে।
ইতিমধ্যে বেশ কিছু বাজার গভীরতর হয়েছে, তাতে নতুন মুখের আবির্ভাব হয়ে চলেছে এবং সেগুলি আগের চেয়েও অধিক স্থিতিশীল হয়ে উঠছে। এ সব ক্ষেত্রে আরও বেশি স্বচ্ছতা এবং অধিক দক্ষ নিয়ন্ত্রণ দেখা দিয়েছে— এই দুই ক্ষেত্রের আবার উন্নতির পথও উন্মুক্ত রয়েছে। আইএল অ্যান্ড এফএস (ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড)-এর দুমড়ে পড়ার মতো ঘটনা যদি অব্যাহত থাকে, তবে তার পিছনে দায় তাদের পরিচালকমণ্ডলীর, তাদের অডিট ফার্মগুলির এবং তাদের ঋণ-হার নির্ধারক সংস্থাগুলির, যারা আশানুরূপ কর্মদক্ষতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। এমন ক্ষেত্রে সংস্থাগুলির প্রশাসনিক স্তরে পুনর্বিবেচনার অবকাশ থেকেই যায়।
যদি ব্যক্তির স্তরে নেমে বিষয়টিকে দেখা যায়, তা হলে বোঝা যাবে যে, ভারত এখন বেশ কিছু নিরাপত্তার আচ্ছাদন প্রদান করছে। জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের জন্য খাদ্যসুরক্ষা প্রকল্প, গ্রামীণ স্তরে কর্মনিযুক্তির নিশ্চয়তা ইত্যাদি খাতে আরও বেশি অর্থ বিনিয়োগের অবকাশ থেকে গিয়েছে। জনসংখ্যার নিম্নতন অংশের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্প খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর অবকাশ রয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের অভাবগ্রস্ত মানুষের দিকে আর্থিক সহায়তার (যেমন বার্ধক্যভাতা) হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজন অবশ্যই রয়ে গিয়েছে। সদস্যের অকালমৃত্যুর কারণে যে পরিবারগুলি দুর্বিপাকে পড়ে রয়েছে, তাদের জন্য ব্যবস্থা করতে অকালমৃত্যুর হার কমানোর প্রকল্পের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বাজেটে গণস্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমই থেকে গিয়েছে। যাই হোক, শৌচাগার এবং পরিশোধিত জল সরবরাহের প্রকল্পগুলি পরিচ্ছন্নতাকে সূচিত করতে পারে, আরও বেশি পরিমানে রান্নার গ্যাসের প্রসার মেয়েদের স্বাস্থ্যরক্ষার উপায় হতে পারে। পথ দুর্ঘটনার হার কমাতে সড়ক নির্মাণ প্রযুক্তির দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। যে হেতু এ দেশে ভিত্তিগত আয়ের কোনও নিশ্চয়তা নেই, তাই এই সব পদক্ষেপ আয়ের নিশ্চয়তাকে পরোক্ষ ভাবে অনেকখানি সম্ভব করে তুলতে পারে।
দেশের অর্থনীতির প্রতি সর্বোৎকৃষ্ট যে সুরক্ষা-আচ্ছাদনটি প্রদান করা যেতে পারে, সেটি হল— কর্মনিযুক্তি বা চাকরি। যেমন-তেমন চাকরি নয়, অধিকতর যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষের জন্য অধিকতর মানের চাকরি, যাতে তারা স্বচ্ছন্দ জীবন যাপনের দিকে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে এক বৃহত্তর অর্থনৈতিক পরিবর্তনের প্রয়োজন থেকে যাচ্ছে। যার জন্য সময়েরও প্রয়োজন। আগামী ভবিষ্যতে যদি চাকরির সুযোগ না-ও তৈরি হয়, তাহলে বেকারভাতার মতো কোনও পদক্ষেপ সামাজিক-সুরক্ষার পরবর্তী ধাপ হয়ে উঠতেই পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy