বৃদ্ধিই কি সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
বাজেট এবং অর্থনীতির পর্যালোচনা থেকে সরকারের সামূহিক অর্থনৈতিক (ম্যাক্রো-ইকোনমিক) কৌশলের যে ছবিটি উঠে আসছে, তা সরল ভাবে বলতে গেলে এই প্রকার: অর্থনীতির বৃদ্ধিই যাবতীয় সমস্যার সমাধান করতে সমর্থ। দু’দশক আগেকার সামূহিক অর্থনীতির সূচকগুলিকে যখন আজকের রাজকোষ ঘাটতি, সরকারি ঋণের উপর চেপে বসা বিপুল সুদের বোঝা বা সমস্যাদীর্ণ ব্যাঙ্ক-ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করা হয়, তখন এমনটিই মনে হয়। পরবর্তী বছরগুলিতে দ্রুত আর্থিক বৃদ্ধির হার দেখে মনে হয়, যেন বিশ্ব অর্থনীতিতে স্টেরয়েড প্রয়োগ করা হয়েছে। সেই অবস্থায় কর বা রাজস্ব আদায়ের উল্লম্ফন মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি-র সঙ্গে সম্পর্কবিন্যাসের দিক থেকে ঋণ ও ঘাটতিকে কমিয়ে আনে এবং সুদের বোঝাকে সহনীয় করে তুলতে সাহায্য করে।
নতুন শতকে প্রবেশ-মুহূর্তের সঙ্গে আজকের পরিস্থিতির তুলনা করলে দেখা যায়, পরিস্থিতিতে খানিক ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। ব্যাঙ্কগুলি এখন দুর্বহ ঋণ-জনিত সমস্যা এবং পুঁজির অপ্রতুলতার বিষয়টি সামলাতে সমর্থ। কিন্তু পূর্বোল্লেখিত সময়ে যশোবন্ত সিংহের সুদের হার কমানোর দৃঢ় সিদ্ধান্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পুনরুজ্জীবনে সহায়ক হয়েছিল। আজ আমরা সম্পূর্ণ বিপরীত এক পরিস্থিতির সম্মুখীন: সুদের নিম্নমুখী হার ক্রমে চড়ছে। সেই সঙ্গে, সেই সময়ে যেখানে বিশ্ব অর্থনীতি বৃদ্ধির পথে ছিল, সেখানে আজ তার গতি ধীর হয়ে পড়েছে। সুতরাং সরকার যদি মনে করে, বৃদ্ধিই যাবতীয় সমস্যার সমাধানের একমাত্র উপায়, তা হলে তা কি ক্রমশ গতি হারানো এবং সুদের হার বেড়ে চলা এক বিশ্বের পক্ষে উপযুক্ত? মনে রাখতে হবে, প্রাক-অতিমারি পর্বেও আমাদের দেশের বৃদ্ধির হার ধীরগতিরই ছিল।
এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, আগামী দুই থেকে তিন বছরের জন্য তা হয়তো সম্ভব হতে পারে। আসন্ন অর্থবছরে আর্থিক বৃদ্ধিকে বড় করে প্রদর্শনের বিষয়টিকে অবশ্যই অতিমারি-ঘটিত পরিস্থিতির আংশিক পুনরুজ্জীবনের প্রবাহ হিসেবে দেখা উচিত। ২০২১-’২২-এর প্রথম ত্রৈমাসিকের অর্থাৎ কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গের কালের নিম্নমুখী পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিক খানিক উজ্জ্বল ছবি দেখাতে পারে। এবং উৎপাদন সংকোচনের ফলে অর্থনীতির যে দোমড়ানো অবস্থা এখনও বিদ্যমান, তা ক্রমে সহজ হয়ে আসতে পারে। ২০২২-’২৩-এর পক্ষে সাত থেকে আট শতাংশের বৃদ্ধির পূর্বাভাস বেশ বেশিই বলা যায়। চলতি বছরে যা ছিল ৯.২ শতাংশ। এবং সে কারণে এই ছবিটি মোটেই অবাস্তব নয়।
২০২০-’২১-এর অতিমারি পর্বের মন্দাবস্থার অভিঘাত সম্পূর্ণ ভাবে কাটিয়ে ওঠার জন্য অর্থনীতির দ্রুত পুনরুজ্জীবনের আরও একটি বছরও যথেষ্ট নয়। এই মন্দার সময়ে জিডিপি-র হার ৬.৬ শতাংশে আটকে ছিল। ২০২০-’২৩, এই তিন বছরে বৃদ্ধির হার গড়ে ৩.৪ শতাংশ। তর্কাতীত ভাবে এ কথা বলাই যায় যে, ভোগের সঙ্কোচনের কারণে উৎপাদনে এর পরেও একটি বড় ফাঁক থেকে যাবে মূলত স্বাভাবিকের চেয়ে কম ‘ক্যাপাসিটি ইউটিলাইজেশন’ (ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা অধিক, অথচ উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা কম থাকার মতো পরিস্থিতি)-এর প্রতিফলন হিসেবে। এবং এর প্রভাবে বেসরকারি উদ্যোগে বিনিয়োগ কমবে, ঋণ বাড়বে। যদি আমরা ধরে নিই যে ২০২৩-’২৪-এ এই সব হিসেবনিকেশ স্বাভাবিক হয়ে যাবে এবং সেই সঙ্গে পরিকাঠামোগত বিনিয়োগ থেকে কিছু ফলদায়ী সুবিধা লভ্য হবে, তা হলে এক থেকে দু’বছরে মোটামুটি দ্রুতগতির বৃদ্ধি আশা করা যায়। উৎপাদনে উৎসাহব্যঞ্জক কিছু প্রকল্প অতিরিক্ত উদ্দীপক হিসেবে আগাম দেখা দিতে পারে।
এমন এক পরিস্থিতিতে সামূহিক অর্থনীতির আজকের বোঝাগুলি (বিপুল পরিমাণ রাজকোষ-ঘাটতি এবং সরকারি ঋণ ও সেই ঋণের উপরে প্রদেয় সুদ) জিডিপি-র সঙ্গে সম্পর্কের নিরিখে কমে আসবে, যেমন ঘটেছিল চলতি শতকের প্রথম দশকে। বিভিন্ন বিপত্তি কাটিয়ে (যার মধ্যে নীতিগত বিষয়ও রয়েছে) গতিছন্দ কমে আসার আগেই অর্থনীতি বাণিজ্যচক্রের চূড়ান্ত ঊর্ধ্বতন স্তরে পৌঁছবে।
এই সব কথা আশাব্যঞ্জক শোনালেও কার্যত কিন্তু ততটাও নয়। ২০১৮-’২৫— এই সাত বছরের পর্বে বৃদ্ধি কিন্তু গড়ে মেরেকেটে পাঁচ শতাংশের আশপাশেই থেকেছে। বিগত শতাব্দীর শেষ এক-তৃতীয়াংশ সময়ে বৃহত্তর চক্রের নিরিখে এই পরিসংখ্যানকে কম বলাই উচিত হবে। এই ফারাকটিকে অতিমারির অভিঘাত হিসেবে (সম্পূর্ণ ভাবে কখনই নয়) ব্যাখ্যা করা হবে, উৎপাদনক্ষেত্রে যা থেকে জাত ক্ষতিগুলি সম্পূর্ণ পূরণ করা দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সম্ভব নয়।
২০২৫-এর পরে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির গতি দ্রুততর হবে কি না, এই প্রশ্ন মুলতুবি রেখে এ কথা আজ জিজ্ঞাসা করা যেতেই পারে যে, এই বৃদ্ধিই কি সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি? তা-ই যদি হয়, তা হলে বেকারত্ব, দারিদ্র, পরিবেশ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ইত্যদির কী হবে? যেগুলিকে আপাত ভাবে পরস্পর-বিচ্ছিন্ন বলে মনে হলেও তাদের মধ্যে অন্তর্লীন সংযোগ বিদ্যমান, যে ক্ষেত্রগুলি গত দু’বছরে (বা তার বেশি সময় ধরে) বিপুল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বাজেট যেগুলিকে প্রায় উপেক্ষিতই রেখেছে?
এটি সেই ‘কে-ফ্যাক্টর’ বিতর্ক (কাঙ্ক্ষিত বৃদ্ধির হার স্পর্শ করতে না পারলেও সময়ে তার ফল ফলবে কি না), যেখানে সরকার মনে করে যথোপযুক্ত বৃদ্ধিতে সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু সত্যিই কি তা সম্ভব? মাঝারি বা দীর্ঘ সময়ের ক্ষেত্রে তা হলেও হতে পারে, কিন্তু আপনা-আপনি হবে না। কৌশলগত ক্ষেত্রে পন্থা সংশোধনের অবকাশ এখানে থেকেই যাচ্ছে, কারণ দীর্ঘস্থায়ী বৃদ্ধি তার উপরেই নির্ভরশীল। এমন পরিস্থিতিতে বেশি করে মনে পড়তে পারে অর্ধ শতক আগে পল সাইমন এবং আর্ট গারফাঙ্কেলের গাওয়া ‘দ্য বক্সার’ গানটির সেই অমোঘ পঙক্তিগুলি— ‘শুধুমাত্র শ্রমিকের মজুরি চেয়েছিলাম/ চাকরির খোঁজ করে যাচ্ছিলাম/ কিন্তু তা মিলছিল না.../ এখন বছরগুলি আমাকে পেরিয়ে চলে যাচ্ছে...।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy