বহু বছর ধরেই পশ্চিমী বিশ্লেষক এবং সাংবাদিকরা চিন ও রাশিয়াকে বোঝার ব্যাপারে ভুল করে চলেছিলেন। —ফাইল চিত্র।
পশ্চিম গোলার্ধের দেশগুলির সঙ্গে বিশ্বের বাকি অংশের ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতায় এই মুহূর্তে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেটি হল, পশ্চিম এখনও বড়সড় আঘাতের চেষ্টা চালিয়ে গেলেও তার শক্তিক্ষয় ঘটছে। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে আমেরিকান নৌবাহিনীর অবস্থান আধিপত্যের বিন্দু থেকে হুমকি বা বাধাদানের জায়গায় সরে গিয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ওয়াশিংটন তার আগ্রাসী (প্রযুক্তিগত নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্যিক বিধিনিষেধ এবং আর্থিক অবরোধ) অবস্থানবিন্দু থেকে সরে এসে রক্ষণাত্মক (আমেরিকান বাজারকে ঘিরে শুল্কপ্রাচীর গড়ে তোলা) ভঙ্গিতে খেলতে শুরু করেছে। পাশাপাশি, ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমের সাহায্য অব্যাহত থাকলেও তা রাশিয়াকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেনি। মাও জে দং সময়ের বহু আগেই ঘোষণা করেছিলেন, পুবের বাতাস পশ্চিমা বাতাসকে প্রতিহত করবে। মাওয়ের সেই ভবিষ্যদ্বাণী যেন এখন ফলতে শুরু করেছে।
বহু বছর ধরেই পশ্চিমী বিশ্লেষক এবং সাংবাদিকরা চিন ও রাশিয়াকে বোঝার ব্যাপারে ভুল করে চলেছিলেন। রাশিয়াকে আর্থিক দিক থেকে তাঁরা ‘দুর্বল’ বলে বর্ণনা করে চলছিলেন এবং ভ্লাদিমির পুতিনকে রাজনৈতিক ভাবে চ্যালেঞ্জযোগ্য, এমনকি, মরণাপন্ন রোগে আক্রান্ত বলেও দেখিয়ে চলছিলেন। দশকের পর দশক ধরে চিনের পতনের বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করে আসা হচ্ছিল। সাম্প্রতিক কালে তাকে ‘বিপর্যস্ত’ বা ‘অবরুদ্ধ’ বলেও দেখানো হচ্ছিল। বাস্তবে দেখা যায়, রাশিয়া পশ্চিমী অবরোধকে অপ্রত্যাশিত ভাবে সহ্য করে, ইউক্রেনের উপরে হামলার মাত্রা বাড়ায় এবং পুতিন পুনর্নির্বাচিত হন। ইতিমধ্যে চিন দ্রুততম আর্থিক বৃদ্ধির দেশগুলির অন্যতম হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে তার আয়স্তরও বৃদ্ধি পায়।
বেশ কিছু চিনা পণ্যের উপরে আমেরিকা সম্প্রতি যে কড়া শুল্কনীতি ঘোষণা করেছে, তা কিন্তু পুরোমাত্রায় ‘বাণিজ্য সংঘাত’-এর ইঙ্গিত দেয় না। কারণ, সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলি আমেরিকার বাজারে তেমন চাহিদাসম্পন্ন নয়। বরং এমন কথা বলা যেতেই পারে যে, এই শুল্কনীতি আসলে দেশের ভিতরে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের নিজস্ব রাজনৈতিক ভিত্তিকে দৃঢ় করার উদ্দেশ্যেই তৈরি করা হয়েছে। এ সত্ত্বেও চিন কিন্তু সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলির প্রধান উৎপাদক হিসেবে থেকে যায় এবং অন্যত্র বাজার খুঁজে নেয়। কোনও কোনও পণ্যের ক্ষেত্রে আমেরিকার আমদানিকারকদের সামনে বিকল্প পথ খোলা ছিল না। সরবরাহের বিষয়ে চিন তৃতীয় কোনও দেশের কারখানাকে ব্যবহার করতেই পারে। সে ক্ষেত্রে আমেরিকার ভোক্তাদের এই সব পণ্যের জন্য চড়া দাম দিতে হবে।
এই ধরনের রক্ষণাত্মক পরিকল্পনার (যার উল্টো দিকে আমেরিকান উৎপাদনের পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে ভর্তুকি-নির্ভর নীতি রয়েছে) সঙ্গে অতীতের আগ্রাসী পদক্ষেপগুলির ফারাক স্পষ্ট। আশা করা গিয়েছিল, এই সব আগ্রাসী পদক্ষেপ আমেরিকার শত্রুদের কোণঠাসা করে ফেলতে পারবে। সন্দেহ নেই যে, অর্থনৈতিক অবরোধগুলি প্রতিপক্ষকে আঘাত হানতে পেরেছিল। কিন্তু (প্রায় সর্বদাই এ ধরনের অবরোধের ক্ষেত্রে এমন ঘটে) এর ফল দেখা যায় আংশিক ক্ষেত্রে। দেখা যায়, রাশিয়া তার খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস বিক্রির জন্য নতুন ক্রেতা জোগাড় করে ফেলেছে। সেখানে ইউরোপ সস্তায় জ্বালানি কেনার এক গুরুত্বপূর্ণ উৎসকে হারিয়েছে। জার্মানির মতো দেশের অর্থনীতির গতি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। আর এই অবকাশে রাশিয়ার অর্থনীতিতে বৃদ্ধি অব্যাহত থেকেছে।
রাশিয়া এবং চিন উভয়েই এমন এক বিনিময় ব্যবস্থা গড়ে তোলে, যা ডলারকে পাশ কাটাতে সমর্থ হয় (রুশ-চিন বাণিজ্যের ৯৫ শতাংশই এখন স্থানীয় মুদ্রায় নির্বাহ হয়) এবং সুইফ্ট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাঙ্ক ফিনানশিয়াল টেলিকমিউনিকেশন্স)-এর মতো ব্যাঙ্কিং যোগাযোগ ব্যবস্থাকেও তারা এড়িয়ে যেতে পারে। এই মুহূর্তে রাশিয়ার হাতে ডলারের থেকে অনেক বেশি পরিমাণ ‘রেনমিনবি’ (চিনের মুদ্রা)-র ভাঁড়ার। অন্য দিকে, চিন সোনার প্রতি ঝুঁকছে। গত ১৮ মাচে চিন বিপুল পরিমাণ সোনা কিনেছে। দ্য পিপলস্ ব্যাঙ্ক অফ চায়নার ২২৫০ টন সোনার সঞ্চয় এখনও পর্যন্ত সামগ্রিক মজুতের ৫ শতাংশ হলেও তা অতীতের পরিসংখ্যানকে ছাপিয়ে গিয়েছে।
প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বিদ্যুৎচালিত যানবাহন, সৌরশক্তি এবং লিথিয়াম ব্যাটারি উৎপাদনের ব্যাপারে চিন অন্যদের অনেক আগেই দ্রুততার সঙ্গে শীর্ষস্থান দখল করে ফেলেছে। সংশ্লিষ্ট শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহের ক্ষেত্রেও চিন অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছে এবং কোনও কোনও উপাদানের বাজারেও একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছে। বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম, জৈব পণ্য এবং প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সামগ্রী উৎপাদনের ক্ষেত্রেও চিন সম্ভবত প্রযুক্তিগত বাধাবিপত্তিগুলি অতিক্রম করার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সম্প্রতি হুয়েই ৭ ন্যানোমিটার চিপ সম্পন্ন স্মার্টফোন তৈরি করে পশ্চিমী বিশ্বকে চমকে দিয়েছে এবং এখন তারা ৫ ন্যানোমিটার চিপ তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছে। আগামী বছরের মধ্যে চিন চিপ নির্মাণ ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ স্বনির্ভর হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। ইতিমধ্যে পশ্চিমী ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি জৈব ওষুধ এবং অন্যান্য জৈব পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে চিনের অগ্রগতিকে স্বীকার করে নিয়েছে। সাংহাইয়ের কাছে সুঝৌতে অবস্থিত বায়োবে-র মতো জায়গায় এই ধরনের জৈবপ্রযুক্তির বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর জন্য চিন একটি ‘মেগা হাব’ নির্মাণ করেছে। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও চিন তার পরমাণুশক্তি চালিত চতুর্থ বিমান পরিবাহী জাহাজটি নির্মাণ করছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত পদক্ষেপ। এক কথায়, এই মুহূর্তে চিনের মুখের উপর পশ্চিমের প্রযুক্তির দরজা বন্ধ করার সময় চলে গিয়েছে।
যদি রাশিয়া ইউক্রেনের উপর তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হয় এবং সেই প্রায় বিপর্যস্ত দেশটিকে ভাগ করতে উদ্যত হয়, তবে পশ্চিমী ভাষ্যকারেরা প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে দুর্ভাবনার মেঘ দেখতে পাচ্ছেন। যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফিরে আসেন এবং নর্থ অ্যাটলান্টিক ট্রিটি অর্গ্যানাইজেশন (ন্যাটো)-কে ক্ষমতাহীন করে দেওয়ার জন্য হুমকি দিতে থাকেন, তবে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে দাঁড়াবে। লোকবল, সরঞ্জাম, রণক্ষমতা এবং সামরিক উৎপাদনের সামর্থ্যের ব্যাপারে ইউরোপের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বলা যায়, এমন পরিস্থিতিতে গোটা মহাদেশ এতটাই বিপন্ন বোধ করতে পারে যে, ঠান্ডা লড়াইয়ের সূত্রপাতের পর থেকে তেমন বিপন্নতা দেখা যায়নি। ইউরোপের দেশগুলি প্রতিরক্ষা বাজেট পরবর্তী কালে তাদের মোট জাতীয় উৎপাদন (জিডিপি)-এর ২ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রায় ধার্য করেছে। কিন্তু তা ঘটেছে অন্তত পক্ষে এক দশক আগেই। তাদের প্রতিরক্ষায় আমেরিকান সহযোগিতার আশ্বাস ছাড়াই। বিশেষত, আমেরিকান পারমাণবিক অস্ত্রের ছত্রছায়ায় আসার আগেই।
তুলনামুলক ভাবে মস্কো এবং বেজিং পরস্পরের আরও বেশি কাছাকাছি এসেছে। পাশাপাশি, বিশ্বের অন্যত্র কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও তারা লাভবান হয়েছে। সিরিয়ায় রাশিয়া কূটনৈতিক খেলায় বেশ খানিকটা সাফল্য পেয়েছে এবং এই মুহূর্তে ইরানের কাছ থেকে ড্রোন আদায়ে সমর্থও হয়েছে। গতবছর চিন ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ককে স্বাভাবিক করার ব্যাপারে মধ্যস্থতা করেছে। আফ্রিকায় চিন আমেরিকার থেকে বেশি অর্থ ব্যয় করেছে। সেখানে একের পর এক দেশ ফরাসি বা আমেরিকান সেনাদের বিদায় করে নিরাপত্তার জন্য রুশ সেনাদের আহ্বান জানাচ্ছে। এমনকি, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যে সব দেশের অর্থনীতি চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগসম্পন্ন ছিল, তারাও আমেরিকা আর চিনের মধ্যে কোনও একটি পক্ষকে বাছাই করে নিতে চাইছে না। আমেরিকা যে ভাবে প্রায়শই তার নির্ভরযোগ্যতা হারায় (যেমন ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে ঘটেছে), তা কিছুতেই অস্বীকার করার উপায় নেই। ইউক্রেন এবং গাজ়ার ক্ষেত্রে গ্লোবাল সাউথের সঙ্গে পশ্চিম যে রকম প্রতারণামূলক এবং বৈপরীত্যপূর্ণ অবস্থান নিয়েছে, তাকেও অস্বীকার করা যায় না।
পশ্চিমী ভাষ্যকাররা এমন কারণ দেখিয়ে তর্ক করতেই পারেন যে, চিন বহুকাল ধরেই একবগ্গা ভাবে এক মার্কেন্টাইল নীতি গ্রহণ করে বিপুল পরিমাণে সরকারি সহায়তাপুষ্ট শিল্পের হয়ে মুখ খুলেছে এবং তার মুদ্রাব্যবস্থা গ্রহণীয় হল কি না, তা না ভেবেই বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করেছে। সে কারণেই খানিক দেরিতে চিন পশ্চিমের পাল্টা পদক্ষেপকে আহ্বান করেছে। কিন্তু এই যুক্তির সঙ্গে তাঁরা এ কথা বলেন না যে, চিনের অভ্যন্তরে প্রতিযোগিতাপূর্ণ দেশজ বাজারও রয়েছে। যেমন, সেখানে কমবেশি ১৩৯টি সংস্থা বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাণের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। যোগ্যতমই সে বাজারে টিকে থাকবে এবং বিওয়াইডি-র মতো সংস্থা সে ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সেরা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।
তা সত্ত্বেও যদি গুরুত্বপূর্ণ রফতানি বাজারগুলি সম্মতি না জানায়, তা হলে চিনের উৎপাদনক্ষমতা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। কিন্তু ভারতের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, নিছক শুল্কপ্রাচীর তুলে চিনের পণ্যকে আটকে রাখা যাবে না। প্রকৃতপক্ষে চিন প্রযুক্তি এবং বাজার— উভয় ক্ষেত্রেই প্রতিশোধের নীতি গ্রহণ করার মতো জায়গায় চলে যেতে পারে। আশির দশকের মধ্যভাগে জাপান পশ্চিমী চাপের মুখে পড়ে তার রফতানিকে নিয়ন্ত্রণ করতে উদ্যোগী হয় এবং ইয়েনের মূল্যমান বাড়াতে সমর্থ হয়। পরিস্থিতি অনেকটা সে দিকেই চলে যেতে পারে। আজকের দুনিয়ায় নিরাপত্তাগত বিষয়, প্রযুক্তিগত উন্নতি, উৎপাদন এবং বাণিজ্যিক আধিপত্য বা কূটনৈতিক প্রতাপ, অথবা এক কথায় বিশ্বে শক্তিসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে পুবের বাতাস আগের চেয়ে অনেক বেশি জোরেই বইছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy