—প্রতীকী ছবি।
আগামী মাসদুয়েক লোকসভা নির্বাচন সম্বন্ধে একটা কথা বারে বারেই বলা হবে— ‘গণতন্ত্রের উৎসব’। কিন্তু, গণতন্ত্র মানে তো জনগণের শাসন— অর্থাৎ, যাঁরা দেশ চালানোর নীতি ও আইনকানুন তৈরি করবেন, তাঁদের মধ্যে জনতার ‘প্রকৃত’ প্রতিনিধিত্ব। এই প্রকৃত প্রতিনিধিত্বে পৌঁছনোর জন্য প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ভোটাধিকার একটি মৌলিক সহায়ক শক্তি, কিন্তু সেই অধিকারটুকুই গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হতে পারে না। এ দেশে ‘জনগণের শাসন’ প্রকৃত অর্থে কতটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে?
ভারতের ধনীতম ১০ শতাংশের হাতে আছে দেশের মোট সম্পদের ৭২ শতাংশের বেশি, এবং ধনীতম ১%-এর সম্পদের পরিমাণ জনসংখ্যার নীচের ৫০%-এর তেরো গুণ। ২০১৮ সালের হিসাবে, ভারতের জনসংখ্যার ০.৬ শতাংশের মোট সম্পদের পরিমাণ এক লক্ষ আমেরিকান ডলারের বেশি। অর্থাৎ, ভারতে বিপুল অর্থনৈতিক বৈষম্য বর্তমান, দেশের অতি অল্প পরিমাণ মানুষের কাছে সম্পদের সিংহভাগ গিয়ে জমেছে। বাকিরা কোনও ক্রমে দিনাতিপাত করছেন, যার সবচেয়ে বড় প্রতিফলন ঘটেছে বিশ্ব ক্ষুধা সূচক রিপোর্টে, যেখানে দেখা যাচ্ছে যে, ১২৫টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১১১ এবং ভারতের প্রায় ২২ কোটি মানুষ প্রতি রাতে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমোতে যান।
এই ভারতীয়দের শাসন করেন যাঁরা, তাঁরা কেমন আছেন? বর্তমান সংসদের বিদায়ী সদস্যরা প্রত্যেকে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে তাঁদের সম্পদের পরিমাণ, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা ইত্যাদি তথ্য সম্বলিত একটি হলফনামা দাখিল করেছিলেন নির্বাচন কমিশনের কাছে। কমিশনের ওয়েবসাইটে থাকা সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে, ভারতের সংসদে ৫৪৩ সদস্যের মধ্যে ৩৬টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব আছে, এ ছাড়াও আছেন কয়েক জন নির্দল সদস্য। তাঁদের মধ্যে ৮২% সদস্যের ঘোষিত সম্পদের পরিমাণ এক লক্ষ ডলার (২০১৯ সালের হিসাবে ৭৫ লক্ষ টাকার বেশি)। এক মিলিয়ন ডলারের (২০১৯-এর হিসাবে সাড়ে সাত কোটি টাকা) বেশি মূল্যের সম্পদের অধিকারী প্রায় ৩০% সাংসদ— ১৪০ কোটি মানুষের দেশে যে পরিমাণ সম্পদের অধিকারী মাত্র কয়েক জন। এক কোটি টাকার বেশি সম্পদের অধিকারী ৮০% সংসদ সদস্য।
ভারতের সংসদে যে ৩৬টি দলের প্রতিনিধিত্ব আছে, তার মধ্যে আছে দক্ষিণপন্থী থেকে বামপন্থী, সর্বভারতীয় থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ছোট আঞ্চলিক দল, জাতি এবং ধর্মভিত্তিক দল। অর্থাৎ রাজনৈতিক মতাদর্শ, জাতি, ধর্ম, ভাষা, আঞ্চলিক অভীপ্সার প্রতিনিধিত্বের দিক থেকে ভারতীয় গণতন্ত্র বিশাল এবং বিস্তৃত। কিন্তু সম্পদের বিচারে দেখলে এই বিস্তৃত গণতন্ত্রের চেহারাই অতি সঙ্কীর্ণ হয়ে ওঠে, যেখানে ভারতের জনগণের অতি ক্ষুদ্র একটা অংশ গোটা দেশ শাসন করে। যাঁদের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে, তাঁদেরই হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতাও কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এবং অদ্ভুত ভাবে রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে এটা সত্যি। আর বিপুল সাধারণ দরিদ্র জনগণের প্রায় কোনও প্রতিনিধিত্ব নেই। ক্ষুদ্র চাষি, খেতমজুর, কলকারখানার শ্রমিক, নির্মাণ-শ্রমিক, পরিবহণ-শ্রমিক, দোকান-কর্মচারী এবং আরও বহু পেশার মানুষের সংসদে পৌঁছনোর কোনও সুযোগ নেই, যদিও তাঁদেরই শ্রমের উপরে এই সমাজ দাঁড়িয়ে আছে— তাঁরাই ফসল ফলাচ্ছেন, রাস্তা তৈরি করছেন, আমাদের সারা দিনের ব্যবহার্য জিনিসগুলি তৈরি করছেন, বাস চালাচ্ছেন।
সভ্যতার ইতিহাস বলে, যাঁর হাতে সম্পদ, তাঁরই হাতে শাসনক্ষমতা। আর সেই ক্ষমতাকে ব্যবহার করে বিপুল জনতার শ্রমের উপরে তাঁদের সম্পদ আরও স্ফীত হতে থেকেছে। যদিও সেই বিপুল জনতা নিজেদের তৈরি সম্পদের খুব সামান্য অংশই পেয়েছে। এবং শাসনব্যবস্থা যতই পরিবর্তিত হোক, এই অবস্থাটা মূলত একই রয়ে গেছে। সম্রাট রাজা জমিদার জোতদার— সব পেরিয়ে এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও এই অবস্থার সে রকম কোনও পরিবর্তন হয়নি। আর পরিবর্তন হয়নি বলে গরিব জনতার হাতে তার পরিস্থিতি বদলানোর ক্ষমতা কখনওই সরাসরি আসেনি, তাঁকে তাকিয়ে থাকতে হয়েছে প্রধানত ধনী ও কিছু মধ্যবিত্ত ক্ষমতাবানদের দিকে, তাঁরা যদি দয়া করে সমাজের বৈষম্যের ব্যবস্থার কিছু পরিবর্তন ঘটান। কিন্তু তা করা মানে নিজেদের ক্ষমতা ও সম্পদে ভাগ বসাতে দেওয়া, যা শাসকেরা চাননি। তাই আজও গরিব মানুষ পরোক্ষ কর হিসাবে তাঁদের আয়ের অনেক বেশি অংশ দেন ধনীতম অংশের থেকে। সরকারি স্কুল, তাদের মিড-ডে মিল-সহ, অযত্নে পড়ে থাকে। কারণ যাঁরা সংসদে বসে আইন ও নীতি তৈরি করছেন, দেশের সিংহভাগ জনতার দুঃখ-কষ্ট-সমস্যাগুলো সম্পর্কে তাঁদের কোনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই নেই।
কেউ বলতে পারেন যে, কোনও গরিব খেতমজুর বা শ্রমিক নির্বাচনে দাঁড়াতেই পারেন, এবং জিতলে সংসদে যেতেই পারেন। কিন্তু, আইনে কেউ না আটকালেও এই ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত শক্তি তাকে প্রতিহত করে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, জিতে, সংসদে পৌঁছনোর জন্য যে অর্থশক্তি ও সামাজিক পুঁজি লাগে তা এ দেশের খুব সামান্য-সংখ্যক মানুষেরই আছে। ‘গণতন্ত্রের উৎসব’-এ সেই বিরাট সংখ্যক ‘গণ’ শুধুই দর্শকের ভূমিকায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy