—প্রতীকী চিত্র।
বাংলা সংস্কৃতির বিষয়ে এখন যে শুধু পাতা ঝরার গল্পই লিখতে হবে সে তো আমাদের মুখস্থ সিলেবাস। অন্য কিছু লেখার, পড়ার বা ভাবার সুযোগ পেলেই বরং ইদানীং মন নড়েচড়ে বেশি। সে সুযোগ এত কম, হয়তো এ কারণেই সংবেদনশীল বাঙালির আজ জবুথবু হওয়া ছাড়া উপায়ান্তর নেই। সেই ধ্বংসের কথাই বলব, টেলিভিশনের ভাষায় বলতে হয়: ‘কোত্থাও যাবেন না।’ নড়েচড়ে ওঠার কিছুই নেই।
আকাশবাণীর স্থান বাংলা কৃষ্টিতে কোথায়, তা নিয়ে নতুন করে শব্দব্যয় অর্থহীন। সেই সঙ্গে এ-ও এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই, সে জায়গার অনেকটাই অতীতের কুলুঙ্গিতে নিয়ে গিয়েছিল গত শতকের নব্বইয়ের দশক। অনুষ্ঠান তখনও রুচিমান, গুণমানে ভরপুর, কিন্তু তার চালটা আদিম। বিনোদনের রেলগাড়ি তখন নিত্যনতুন-সন্ধানী, এই সাবেক স্টিম এঞ্জিন গতিতে বহু দূর পিছিয়ে পড়েছে। টিভি তখন দূরদর্শনের কুড়ি বছরের জমজমাট সাদাকালো ইনিংসের পর কেব্ল-প্রীতিতে আরও রঙিন। ট্রানজ়িস্টর আর বানানোই হয় না, সারানোর দরকার পড়ে মহালয়ার দু’দিন আগে, চাইলে অবশ্য ক্যাসেটেও শুনে নেওয়া যায়। মিস হলেও সকাল সাড়ে পাঁচটায় দুর্গা স্বয়ং নাচের আসর নিয়ে আসেন টেলিভিশনে, কল্পনার দায় থাকে না।
এ-হেন স্বাভাবিক মৃত্যুকালে হঠাৎ কোরামিন হয়ে হাজির নতুন প্রযুক্তি এফএম— ফ্রিকোয়েন্সি মডিউলেশন। ঝকঝকে আওয়াজের এক নতুন সম্প্রচার, কোনও ঘসঘস-হিসহিস নেই, তার উপরে আবার স্টিরিয়ো। সঙ্গে সমস্যাও, এমনি-রেডিয়োতে শুধু মিডিয়াম আর শর্ট ওয়েভ ধরে, এর জন্য হয় নতুন রেডিয়ো কেনো যা বেশ দামি, নয়তো পাড়ার মিস্ত্রিকে বলে নতুন অ্যাডাপ্টর লাগাও, তাতেও খরচ কম না। কলকাতা এফএম-ও তখন সেই চ্যানেলে পর পর গান শোনায় শুধু, হয়তো একই শিল্পীর একটা গোটা অ্যালবাম, কিন্তু সে তো ক্যাসেটেও শোনা যায়। গোটা এফএম ব্যান্ডে একটাই ফ্রিকোয়েন্সিতে সম্প্রচার, একটাই স্টেশন, ১০৭ মেগাহার্ৎজ়। শ্রোতাশূন্য একাকী সম্প্রচারে একেলা গায়কের গান তেমন জমে না।
এর পরেই অবিশ্বাস্য সৃজনশীলতায় আকাশবাণী কলকাতা আচমকাই এক মিহিন দুপুরে, দু’জন বেতারনাট্য-অভিনেতাকে স্টুডিয়োতে লাইভ মাইক্রোফোনের সামনে বসিয়ে আর এক তাড়া ডিস্ক রেকর্ড দিয়ে বলল, কোনও বিষয়, স্ক্রিপ্ট, নাট্যমুহূর্তের কথা না ভেবে শ্রোতাদের সঙ্গে খোলামনে আড্ডা দিন— অবশ্যই অশালীনতা, ব্যক্তি-আক্রমণ ইত্যাদি এড়িয়ে, আর মাঝেমধ্যে ইচ্ছেমতো গান বাজান। আর শ্রোতাদের একটা ফোন নম্বর দিয়ে বলা হল, এই নম্বরে সরাসরি ফোন করে এই আড্ডায় লাইভ সঙ্গী হোন। আপনার গলা আর বক্তব্য নিমেষে পৌঁছে যাবে লক্ষ শ্রোতার কাছে, কোনও মহড়া ছাড়াই— কেউ বেয়াড়া কিছু বলে বসবেন না, এই ভরসা শ্রোতা আর উপস্থাপকদের উপর রেখেই। এ যে কী অভাবনীয় এক উদ্ভাবন, শ্রোতা ও বেতারের সম্পর্ক নিয়ে কত বড় এক পদক্ষেপ, তা এখনও সে ভাবে ভেবে ওঠা হয়নি। সমকালকে বাঙালি চিন্তাবিদরা সাধারণত তত বিবেচনায় আনেন না। ঐতিহ্য নির্মাণের কালে ঐতিহ্যকে ‘পড়ার চশমা’টি খুঁজে পান না, হারানোর পর অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলে খেয়াল পড়ে। সাধারণ শ্রোতা কিন্তু হাতের কাছের জহর চিনতে ভুল করেন না। ১০৭-এর টক শো কলকাতার হারাতে-বসা রেডিয়ো-অভ্যাসকে জাদুমন্ত্রে জ্যান্ত করে তুলল। তৈরি হল হাতে-গরম ইতিহাস। এফএম এ ভাবে রেডিয়োকে সমকালীন করে না তুললে কলকাতা শহরে রেডিয়োর ‘এপিটাফ’ হয়তো অনেক আগেই লিখতে হত।
‘ইতিহাস’ শব্দটা ব্যবহার করলাম সদর্থে। খুব সম্প্রতি, ২০২৩-এর জুলাই-স্য প্রথম দিবসে কেন্দ্রীয় সরকারি দিল্লি-কলমের এক পুঁচকে ও তীব্র খোঁচায় কদর্থে ‘ইতিহাস’ হয়ে গেল কলকাতার এফএম জগতের প্রথম গর্বিত, জনপ্রিয়, উপার্জনশীল ও দক্ষ পথপ্রদর্শক, ১০৭ মেগাহার্ৎজ় এফএম রেনবো। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ছাব্বিশ। স্কোরবোর্ডে অবস্থান ছিল বেতার-এর RAM রিপোর্ট (যা দিয়ে চ্যানেলের গ্রহণযোগ্যতা মাপা যায় ও হয়ে থাকে) অনুযায়ী, এ শহরে জনপ্রিয়তায় দ্বিতীয়। আজও। রেডিয়োর এই পুনর্মূষিক বনে যাওয়ার, পিছিয়ে যাওয়ার, ইন্টারনেটের আগ্রাসনের দিনকালেও।
১৯৯৭-এর সেই সময়টা বাংলা সংস্কৃতির কিঞ্চিৎ পুনরুত্থানের। ’৯২-এ এসেছেন সুমন, পরের বাসেই নচিকেতা, সময়ের যানবাহন পর পর নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছে অঞ্জন দত্ত, শিলাজিৎ, মৌসুমী ভৌমিককে। ’৯৭-এর মাঝামাঝি উঠিল রিমেক বাজি, যখন পূজার সময় এল কাছে। নতুন প্রতিভাবান গানওলাদের সাফল্য দেখে অনুপ্রাণিত, গিটার ও দাড়িসর্বস্ব তথাকথিত ‘জীবনমুখী’র টলমলে দাপাদাপির বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় কিঞ্চিৎ বিরক্ত শ্রোতার বহু দিন বাদে মনে পড়ে গেছে সোনা-ফলানো যুগের অসামান্য আধুনিক-কথা, নতুন যুগের চালে তার সঙ্গীতমূল্যকে মর্যাদা দিতে এসে গেছেন ইন্দ্রনীল সেন, শ্রীকান্ত আচার্য, নতুন গান ও কবিতার গান নিয়ে লোপামুদ্রা মিত্র; আর এক ধারার যৌথ গানের গণসংসারে চন্দ্রবিন্দু, ভূমি, ক্রসউইন্ডজ়, ক্যাকটাস। বাংলা রঙ্গমঞ্চেও নতুনের নড়াচড়া, পাদপীঠে তো বটেই, টিকিট কাউন্টারেও। সিনেমাতেও মহানায়ক-পরবর্তী শূন্যতা ঢাকতে যে বিকট রস, ফাঁপানো বাবরি আর আনস্মার্ট কোমর-দোলানো, বম্বের ফ্যাকাশে অনুকরণ বা অন্তহীন সাংসারিক কূটকচাল, তা থেকে দর্শককে বাঁচাতে, স্টেশনে ঢোকার আগে ডিসট্যান্ট সিগন্যালে দাঁড়িয়ে আছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ।
এই সম্ভাবনার সময়ে নতুন মাত্রা যোগ করল এফএম টক শো। আড্ডাবাজ, অথচ বদলে-যাওয়া দিনকালে সঙ্গীহীন বাঙালি আড্ডারুকে নিয়ে নিছক কথার জালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আসর বসাল আকাশবাণী কলকাতা। নতুন কোনও আর্ট ফর্ম এসে পড়লে সেই খেলনা নিয়ে কত দূর এগোনো যায়, কত নতুন কথা নতুন ভাবে বলার রাস্তা বার করা যায়, বাঙালি তা পরীক্ষা করে দেখতে ভালবাসে চিরকাল। থিয়েটার, সিনেমা, সংবাদপত্র, গান, সবেতেই এই নবজাতকের যাত্রাপথ আবিষ্কারে তার প্রতিভা সবচেয়ে বেশি মুক্তি ও স্ফূর্তি পায়। তাই কলকাতায় ও শুধু কলকাতাতেই, বেতারের এফএম-প্রযুক্তির পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার ও ক্রমবিকাশ দেখা গেল। অন্য মেট্রো শহরগুলিতে এফএম কমবেশি বিবিধ ভারতী-র আপগ্রেডেড সংস্করণ হয়ে থেকে গেলেও, কলকাতা বেতার তার একমুখী সম্প্রচারের ধরন ছেড়ে-ছুড়ে হয়ে উঠল দ্বিমুখী। শ্রোতাও হয়ে উঠলেন উপস্থাপক। দৈনন্দিনের সুখদুঃখের গল্প, বাজারদর, নতুন নায়িকার স্বয়ম্বর, রাস্তার ইতিহাস, বহমান বঙ্গজীবনের কোনও অঙ্গই তার আওতার বাইরে থাকল না। স্টুডিয়োর চক-মেলানো ঘরদুয়ার ছেড়ে সে নতুন আসা মোবাইল হাতে দৌড় দিল শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত নৈঃশব্দ্য থেকে বাসে-ট্রামে, পুজোর ভিড়ে, বইমেলার হট্টগোলে, মাদার টেরিজ়া থেকে জ্যোতি বসুর শেষযাত্রায়।
১০৭ এফএম সম্প্রচারের ধারা পরবর্তী যুগের মিডিয়াকে প্রভাবিত করেছে এত দূর পর্যন্ত যে, সম্প্রচারের প্রায় কোনও শাখাই আজ তার প্রভাবমুক্ত নয়। এফএম-পূর্ব যুগে টিভি কখনও ভাবেনি রোজ সন্ধেয় কারও সঙ্গে কথায় কাটানোর জন্য লোকে জলদি বাড়ি ফিরবে। অনুষ্ঠানে সরাসরি ফোনে ধরার, শ্রোতাকে মত ও দ্বিমত প্রকাশের সুযোগ দেওয়ার, ঘটনাস্থল থেকে সরাসরি পেশ করা হাতে-গরম বাস্তবতার যত খণ্ডচিত্র দেখা যায়, সবই এফএম-এর প্রতিফলন বা অনুসরণ।
সে এফএম-এর উত্থানের যুগ। সাম্প্রতিক অতীতের সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব এসে সরাসরি শ্রোতার সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন, দীর্ঘ কাল বাদে রেডিয়ো-বক্তারা সেলেব্রিটি হয়েছেন। প্রথমে এসেছে আকাশবাণী-র অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে সময় কিনে নিয়ে টাইমস বা এইচএমভি এফএম, তার পর ব্যান্ড-এ ফ্রিকোয়েন্সি কিনে নিয়ে বহু বেসরকারি এফএম। সহজলভ্য ইন্টারনেটের সবল থাবা আবার যখন একে একে নেবাতে থাকল এফএম চ্যানেলের দেউটি, সেই পড়তি সময়েও ‘দিলের বাতি’ জ্বালিয়ে সারা রাত জাগত ১০৭ এফএম রেনবো ও ১০০.১ এফএম গোল্ড। অতিমারিকালে যখন সারা ক্ষণ কানের কাছে ভয়াল মৃত্যুর কাড়ানাকাড়া বাজাচ্ছে টিভি চ্যানেল, তখন তথ্যপূর্ণ অথচ পরিমিত কথনে, স্নায়ুসহায়ক গানে শ্রোতাদের পাশে থেকেছে এফএম রেনবো: শুশ্রূষা, বরাভয় নিয়ে। যথাযথ বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দিতেও যে এ যুগের শ্রোতাকে মজিয়ে রাখা যায়, সিরিয়াস ও চাটনি কোনওটার জন্যই যে বকচ্ছপ ভাষার দরকার নেই, কলকাতার আত্মিক মরণাপন্নতার যুগে সেটাই ছিল আশার আলো।
কিন্তু ধুক করে নিবে গেল বুক-ভরা আশা। ৩০ জুন ২০২৩, রাত বারোটায় শ্রোতারা খেয়াল করলেন, ১০০.১ আকাশবাণী এফএম গোল্ডটুকু পড়ে আছে শুধু। ১০৭-এ কলকাতা ক, অধুনা গীতাঞ্জলি, বছর ত্রিশ আগের মতোই আলুর ধসা রোগ বা মাজরা পোকার সমস্যা প্রসঙ্গে মনোজ্ঞ, স্থির ও স্থবির কথিকা রিলে করছে। অভ্যস্ত এফএম-গড়ন ভোজবাজির মতো উধাও।
সারা ভারত এই এফএম টক শো-কে আর্ট ফর্ম হিসাবে ব্যবহার করতে পারেনি। বাংলার মেধা ও সৃষ্টিশীলতা তা পেরেছে, পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে। সমকালে দাঁড়িয়ে আমাদের ঐতিহ্য রক্ষায় কখনওই সরব হতে পারিনি আমরা, তাই দিল্লির বেয়াড়া সিদ্ধান্তে স্থানীয় ভাষার এফএম রেনবো বন্ধের তোড়জোড় যে ভাবে আটকে গেছে দক্ষিণ ভারতে, ভাষাসচেতন, স্থানিক কৃষ্টিসচেতন মানুষের নাছোড় চাপে— কলকাতার শ্রোতারা তখন হতাশ, বিষণ্ণ— কিন্তু মুখর নন। প্রহর কি তবে শেষ? না কি পুনর্বিবেচনা হতে পারে এই তুঘলকি যবনিকা পতনের? ইতিহাসের ফেলে আসা স্টেশনে, কলকাতা ক-এর সাবেক গড়নে কি ফিরতে রাজি হবেন এ যুগের এফএম-অভ্যস্ত শ্রোতা?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy