বার্তা: মহারাষ্ট্রের ঠাণে-তে হিজাবের সমর্থনে সংখ্যালঘু মেয়েদের মিছিল। ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, পিটিআই
কর্নাটকে মেয়েদের একটি স্কুলে প্রাক্-বিশ্ববিদ্যালয় কোর্সের কিছু ছাত্রী হিজাব পরে ক্লাস করতে শুরু করায় কর্তৃপক্ষ তাঁদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢুকতে পারা যে কোনও ছাত্রের মৌলিক অধিকার, হিজাব পরায় সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া যায় না— এই দাবি তুলে নানা স্তরের হিজাবি ছাত্রীরা ধর্নায় বসেন। উল্টো দিকে, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একটি পাবলিক পরিসর, কোনও ধর্মীয় বিধিপালনের জায়গা নয়, তাই হিজাব পরে আসা যাবে না’: সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ধ্বনি শোনা যেতে থাকে। এও বলা হয়, ইউনিফর্ম অল্পবয়স্ক ছাত্রদের মধ্যে নিয়মশৃঙ্খলার বোধ তৈরি করে। সেখানে হিজাব পরে ধর্মীয় পরিচয় প্রকট করে তুললে তাতে সামাজিক ঐক্য ও মৈত্রী ব্যাহত হতে পারে। হাইকোর্টে কেস শুরু হয়। শুরু হয়, রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মীয় গোষ্ঠীর সম্পর্ক নিয়ে সেই পুরনো অমীমাংসিত তর্ক। কোনও সম্প্রদায় কেন ধর্মীয় সংস্কৃতির কিছু চিহ্ন বহন করতে চায়— এই সব কিছু না জেনেই শুরু হয় গোদা আগ্রাসী, অসহিষ্ণুতার রাজনীতি। এই দেশের সংস্কৃতির মূলে নিহিত যে নানাত্ব, তাকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয় সংখ্যাগুরু আগ্রাসন— এমন এক সময়ে যখন উত্তরপ্রদেশ-সহ বিভিন্ন রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন শুরু হয়েছে।
এর সঙ্গে, নতুন করে এই আলোচনা ফিরে আসে যে হিজাব তো শুধু একটি পোশাকমাত্র নয়, তা একটি ধর্ম-সম্প্রদায়ের পিতৃতান্ত্রিকতার নিগড়। কিন্তু হিজাবি মেয়েদের প্রথমেই যদি উচ্চশিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে দেওয়া হয়, তাঁরা নিজেরা তা হলে কী করেই বা এক দিন এই বন্ধনের থেকে মুক্তি পেতে চাইবেন, ও হিজাব ত্যাগে সক্ষম হবেন? শিক্ষা ও ধর্মপালনের অধিকারের প্রসঙ্গে ফিরে যেতে হয় আমাদের সংবিধানের ২৫ নম্বর ধারায়। এই ধারায় ব্যক্তির ও গোষ্ঠীর ধর্মীয়তা পালনের অধিকারকে যে ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে তাতে আমাদের সেকুলারিজ়মের অন্যতর সংজ্ঞা তৈরি হয়। ইউরোপের আধুনিকতায় রাষ্ট্র ও জনপরিসর আলাদা। সেখানে ধর্ম বাড়ির মধ্যে বা উপাসনালয়ের নিভৃতিতে করার চল। কিন্তু সেই সেকুলারিজ়মের সঙ্গে আমাদের দেশের সংস্কৃতি ভিন্ন। আমাদের রোজকার পাবলিক জীবনে ধর্মীয় চিহ্ন, ধর্মপালনের চিহ্ন ওতপ্রোত ভাবেই জড়িয়ে থাকে। আমাদের সংবিধানে নির্দিষ্ট ধর্মনিরপেক্ষতায় বহু ধর্মসংস্কৃতির মানুষের একটি নৈতিক সহাবস্থানের কথা কল্পনা করা হয়, যেখানে পরমত বা পরধর্ম সহিষ্ণুতাই মূল সূত্র, নিজের ধর্ম পালনে অন্যের উপর আগ্রাসন তৈরি করা, বা অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ণ করা নয়।
লক্ষণীয়, হিজাবি মেয়েরা ক্লাসে থাকলে তা অস্বস্তি আর বৈষম্য তৈরি করবে বলে অভিযোগ তোলা হয়। অথচ তাঁরা নানা সামাজিক অর্থনৈতিক লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন বলে ক্লাসরুমগুলি যে অপূর্ব ক্ষমতায়নের সাক্ষী হয়ে ওঠে, এবং ‘বেটি বচাও বেটি পঢ়াও’ দাবিকেই সত্য প্রতিপন্ন করে তোলে— এটা বোঝার সময়-সুযোগ-ইচ্ছে হয় না। কিছু মেয়ে হিজাব পরেন মানে কি তাঁরা নিষ্ঠাবান গোঁড়া শরিয়তি হয়ে উঠে নেশনের সামাজিক ঐক্যকে ভাঙতে চান? না কি ধর্মীয় সংস্কৃতির চিহ্ন পালন করে তাঁরা নিজের ধর্মসংস্কৃতির নিজস্বতা ধারণ করতে চান? অনেক সময় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ব্যক্তি তাঁদের ধর্মচিহ্ন ধারণ করেন জনপরিসরে নিজের গোষ্ঠী পরিচয়ের সম্ভ্রম ফিরে পাওয়ার জন্য। কিন্তু যখন রাজনৈতিক নেতা সাফ বয়ান দেন যে, হিজাব পরতে চাও তো মাদ্রাসায় যাও, তা অন্য ধর্মীয় গোষ্ঠীকে রাষ্ট্রের ভয়াবহ আগ্রাসনের মুখোমুখি দাঁড় করায়। স্পষ্ট বোঝা যায়, রাষ্ট্রের নামে কী ভয়ঙ্কর এক সমাজ তৈরি হয়েছে।
স্বাধীনতার এত বছর পরেও যে সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজের কাছে ভারতমাতার উন্নয়নের মঙ্গলহস্ত গিয়ে পৌঁছয়নি, তাঁরা পড়ে আছেন যে তিমিরে সেই তিমিরে— সাচার কমিশন রিপোর্ট (২০০৬) চোখে আঙুল দিয়ে সে সব দেখিয়ে দিয়েছে। তার পরেও যে কাজের সুযোগ বা শিক্ষার ডোল বা উন্নয়নের পরিষ্কার রেখচিত্র গিয়ে পৌঁছেছে সংখ্যালঘু এলাকায়— এমন অপলাপ দেশের শত্রুও করতে পারবে না। বরং সংখ্যালঘুর প্রতি অসম্মান, শারীরিক অত্যাচার, সামাজিক নিগ্রহ, লুটপাট, সম্পত্তি ভাঙচুর অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বেড়েছে। যা আগে লোকে চোরাগোপ্তা ভাবত, এখন তা প্রবল আত্মবিশ্বাসে গলাবাজি করছে দেশ জুড়ে মুদিখানা বা চায়ের দোকানে। এই নতুন জমানায় কারও ফ্রিজে, রান্নাঘরে, ব্যাগে অহিন্দু মাংস আছে জানতে পারলে সে গণনিধনের শিকার হয়ে যেতে পারে। তাকে নমাজ থেকে তুলে জয় শ্রীরাম বলিয়ে নেওয়া হতে পারে। হিজাব পরলে তাকে তাড়া করা যেতে পারে।
এ এমন আতঙ্কের সময় যখন সহপাঠীদের হিজাব পরে ক্লাসে আসার প্রতিবাদে হিন্দু ছাত্রছাত্রী গলায় গেরুয়া উত্তরীয় জড়িয়ে শোভাযাত্রা করেন। অথচ, মুসলমান মহিলারা হিজাব পরছেন বলে আমরা গেরুয়া উত্তরীয় নেব, শিখদের কিরপান বহন সিদ্ধ বলে আমরা কাল থেকে সর্বক্ষণ ত্রিশূল পকেটে ঘুরব— এটা কোনও যুক্তি হতে পারে না। এক একটি ধর্মের চিহ্ন ও তার অর্থ আলাদা। গেরুয়া বা ত্রিশূল হিন্দু ধর্মের দ্যোতক, কিন্তু এই ধর্মের কোনও একমাত্রিক অক্ষ না থাকায় এগুলির কোনওটাই হিন্দুদের আবশ্যিক দ্যোতক নয়, সর্বক্ষণ বহন করার কথাও নয়। ‘ওরা হিজাব পরে বলে আমরা বাঘছাল পরে বেরোব’, এই যুক্তি তাই স্বভাবতই খাটে না।
হিজাবের বিষয়টি আমাদের সংবিধানের ২৫ নম্বর ধারার দিকে নিয়ে যায়। সেখানে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ধর্মাচরণের অধিকার চিহ্নিত ও সুরক্ষিত। হিজাব পরার অধিকার আলোচনায় আসে ১৯ (১) (এ) ধারার কথাও, যেখানে ব্যক্তির বয়ানের ও অভিব্যক্তির অধিকারের কথা বলা আছে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, হিজাব একটি কঠোর পিতৃতান্ত্রিক নিয়ম, যা মহিলা শরীরকে শুধু প্রজনন ও প্রলোভনের বস্তু হিসাবে দেখে। আর তা ধর্মের নামে তার অন্য সম্ভাবনাগুলিকে খর্ব করে, নারীর একমাত্রিক বশ্যতার ছবি তৈরি করে। প্রশ্ন ওঠে, হিজাব পরাকে প্রশ্রয় দিলে কি হিজাবি মহিলা কখনওই সেই কাঙ্ক্ষিত স্বাতন্ত্র্যে পৌঁছতে পারবেন, যা পিতৃতন্ত্র থেকে মুক্তির, যা ক্ষমতায়নের পথ? তা হলে কি হিজাবের প্রসঙ্গে এসে ২৫ ও ১৯(১) (এ) ধারা আদতে পরস্পরবিরোধী হয়ে পড়ে?
না। সংবিধানের ২৫ নম্বর ধারায় হিজাবের সঙ্গে ধর্মের যে যোগ, ১৯(১) (এ) ধারার সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে তা এক গভীরতর মাত্রা পায়। বোঝা যায়, ধর্ম ও মহিলাদের স্বাতন্ত্র্য পরস্পরবিরোধী নয়, হিজাব শুধুই পিতৃতন্ত্রের চিহ্ন নয়। হিজাব পরেই অনেক পথ একা হেঁটে আসতে পেরেছেন— চার দিকে এমন মেয়েদের দৃষ্টান্ত অনেক অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, এক দিকে হিজাব ত্যাগ যেমন নারী মুক্তির একটি বড় পদক্ষেপ, অন্য দিকে হিজাব নারী ক্ষমতায়নের পরিপন্থীও নয়। হিজাব পরেই থাকেন বহু মুসলমান মহিলা, যাঁরা তাঁদের কাজের ক্ষেত্রে পারঙ্গম। যেমন, মহিলা কাজিরা, মহরমের মজলিসের জাকিরা, মহিলা আইনজীবী, মনস্তাত্ত্বিক, চিকিৎসক, শিক্ষক। উল্টো দিকে, মাদ্রাসাতেও অনেক শিক্ষক আছেন যাঁরা হিজাব পরেন না। আছেন অজস্র মহিলা যাঁরা শ্রমের পেশার সঙ্গে যুক্ত, যাঁদের বাড়িতে, বাড়ির বাইরে, মাঠে কারখানায় লড়ে নিতে হয়।
ভিন্ন সামাজিকতা আসলে সম্মানের বস্তু। হিজাব-মুক্তিই নারীমুক্তির একমাত্র মানদণ্ড নয়। কখনও তা সংখ্যালঘু মেয়েদের গোষ্ঠীচেতনার সংস্কৃতি, কখনও শরিয়তি নিয়মগুলির মধ্যে নিজের জায়গা করে নেওয়ার জন্য একটি স্ট্র্যাটেজি, কখনও ধর্মীয়তাই তাঁদের সিদ্ধান্ত। পোশাক যদি অন্যকে আঘাত না করে, এক জন ব্যক্তির অভিব্যক্তির অধিকার তো সম্পূর্ণ সিদ্ধ। সংবিধানের ধারা মেনেই তো আমরা রাজনৈতিক নেতাকেও যোগীবেশ ছেড়ে আমজনতার সাজে আসতে বলি না!
তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ,
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy