Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
‘এধারে ভয়ানক খিদা’
Division of India

এই শিকড়ছেঁড়া হাহাকার আজ আর দুই বাংলার নয়, সারা বিশ্বের

১৯৩৯ সালে জন্ম হওয়ার ফলে কৈশোর, যৌবন ও পরিণত বয়সজুড়ে উপমহাদেশের রক্তাক্ত ইতিহাসের সাক্ষী হতে হয়েছে তাঁকে।

ক্ষুধার্ত: শিয়ালদহ স্টেশনে উদ্বাস্তু মানুষের সারি, ১৯৭১

ক্ষুধার্ত: শিয়ালদহ স্টেশনে উদ্বাস্তু মানুষের সারি, ১৯৭১

গোপা দত্তভৌমিক
শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০২১ ০৬:৩০
Share: Save:

আমাদের এধারে এদানি ভয়ানক খিদা।’ বাক্যটি উচ্চারণ করেছিল হাসান আজিজুল হকের (ছবিতে) ‘বাইরে’ গল্পে এক ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ান। শহুরে টুরিস্টের দল এসেছিল শিলাইদহের কুঠিবাড়ি দেখে সম্ভবত কিঞ্চিৎ রবীন্দ্রচর্চা করতে, সঙ্গে রথ দেখা আর কলা বেচার মতো ছিল পাখি শিকার ও বনভোজনের টান। গাড়োয়ানদের দিয়ে ভাত আর মুরগির মাংস রান্না করিয়ে কুঠির হাতার মধ্যে যখন দলটি খেতে বসেছে, বিশাল এক ক্ষুধার্ত জনতা ঘিরে এল তাদের, যারা শুধু চেয়ে থাকে। কিন্তু সেই চাহনির সামনে শহুরে দলটির পক্ষে খাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। গল্পটি পড়তে পড়তে পাঠক অনুভব করে রাবীন্দ্রিক বিন্যাস ছিঁড়েখুঁড়ে কী ভাবে বেরিয়ে আসছে অন্য শিলাইদহ। কোথাও উচ্চকণ্ঠ কোনও নির্ঘোষ নেই, পাথরের মতো বুকে চেপে থাকে বাস্তব, তাকে সরানো যায় না, নড়ানো যায় না, অস্বীকার করা যায় না।

সম্প্রতি প্রয়াত হলেন এই বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক, তাঁকে শুধু বাংলাদেশের জীবনের রূপকার বলা যাবে না, বর্ধমানের ভূমিপুত্র হওয়ার সুবাদে রাঢ়বঙ্গও তাঁর লেখায় সমান ভাবে উঠে এসেছে। আর শুধু দুই বাংলা নয়, রাষ্ট্রক্ষমতার বুটের নীচে থেঁতলানো মানবজীবন, ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর ক্ষয়িষ্ণু অস্তিত্বের কি কোনও দেশকাল আছে? হাসান আজিজুল হক চলচ্ছবির বুনুনিতে এই ভাঙাচোরা আর্ত মানবিক অস্তিত্বকে প্রবহমান করেন। টানা গল্প বলে যাওয়া, নিটোল কোনও প্লটের বয়নে তিনি বিশ্বাস করেন না। তবু আখ্যান আছে তাঁর গল্পে— ছেঁড়া ছেঁড়া কাহনের ফাঁকে ফাঁকে লুকোচুরি খেলে চৈতন্যের ডুবজল। এক দিকে আপস না মানা নাছোড় বাস্তব, অন্য দিকে গাঢ় অনুভবের স্রোত— দু’টি মিলিয়ে তাঁর গল্পের শৈলী একেবারে নিজস্ব। বাংলা ছোটগল্পের যে ধারায় তারাশঙ্কর, মানিক, সতীনাথ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মহাশ্বেতা রয়েছেন তাকে স্বকীয় ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ করেছেন হাসান আজিজুল হক।

১৯৩৯ সালে জন্ম হওয়ার ফলে কৈশোর, যৌবন ও পরিণত বয়সজুড়ে উপমহাদেশের রক্তাক্ত ইতিহাসের সাক্ষী হতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর গোটা সাহিত্যিক জীবনজুড়ে নানা লেখায় একটি প্রশ্নই যেন উচ্চারিত হতে থাকে: “কী দরকার ছিল? কী দরকার ছিল সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, দাঙ্গা, দেশভাগের?” মনের গভীরে এই লেখক দেশভাগকে বার বার প্রত্যাখ্যান করতে থাকেন। তাঁর গল্পে আসা-যাওয়া করে ভিটে হারানো উদ্বাস্তু মানুষ, সম্প্রতি এক্সচেঞ্জের নানা জটিলতা, সংখ্যালঘুর নিরাপত্তাহীন বিপন্নতা। এই সব বিষয়বস্তু আজ আর শুধু দুই বাংলার নয়, গোটা পৃথিবীর শিকড়ছেঁড়া মানুষের হাহাকারকে বড় মমতায় স্পর্শ করে। তাঁর গল্প পড়তে পড়তে অলক্ষ্য সুতোর টানে মনে পড়ে বিপজ্জনক ভাবে ভিটেমাটি ছেড়ে পলকা নৌকা চড়ে পলায়নপর রোহিঙ্গাদের, মনে পড়ে বিদেশি সমুদ্রতটে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা শিশুর মৃতদেহ। লেখকের প্রশ্নটি ডালপালা মেলে পাঠককে টেনে নেয়, দর্পিত ক্ষমতাধারীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের চেতনা জাগায়। আবার হিংস্র বর্বর প্রতিপক্ষকে ক্রমশ বিকট স্পর্ধায় এগিয়ে আসতে দেখে সর্বব্যাপী বিষাদ যেন রোদনাতুর মেঘের মতো আকাশ ছেয়ে দেয়।

সাধারণ ভাবে মানুষের অস্তিত্ব হয়তো খানিকটা দোরোখা কাঁথার মতো, তার এক দিকে নান্দনিক ঐশ্বর্যের সমারোহ, অন্য দিকে ক্ষুধা, তৃষ্ণা, যৌনতার তীব্র দৈব দাবি। হাসান আজিজুল হকের গল্পে এই দু’টি দিকের টানাপড়েনে নকশাগুলি তৈরি হয়, আবার ভেঙে যায়। কখনও তিনি বয়ানে আনেন রূপকথার ধরন, কখনও কুহক বাস্তব। ‘শকুন’ গল্পটি বহু আলোচিত দল ছাড়া শকুনটিকে আক্রমণ করে একদল গ্রামীণ কিশোর, ঘৃণা করে তারা কুশ্রী পাখিটিকে। “সুদখোর মহাজনের চেহারার কথা মনে হয় ওকে দেখলেই।” কিন্তু লেখক কোথাও আবৃত করেন না কিশোরদের নির্মমতা, হিংস্রতা। গল্পের তাই অনেকগুলি তল তৈরি হয়ে যায়। বয়ঃসন্ধির কিশোররা তাঁর গল্পে ঘুরেফিরে আসে, কেউ পিতৃপরিচয়হীন বাশেদের মতো শরীর জোড়া খিদে নিয়ে মৃত্যুর দিকে গড়িয়ে যায়, কেউ কাঁকলের মতো অবৈধ সংসর্গে লিপ্ত বাবা মা-র ঔদাসীন্যে দুরারোগ্য বিষাদে ডুবে যায়। রেজার মতো কোনও কিশোর বয়স্কা বিবাহিতা মহিলার যৌন কামনার শিকার হয়ে বসে। পরিবারগুলির আপাত শান্ত নীড়ে বড় হয় ভাইবোনেরা, ‘বিমর্ষ রাত্রি: প্রথম প্রহর’ গল্পে যৌথ জীবনযাপনের ছবিটি কয়েক টানে আঁকা, “সেই বাড়িতে টিকটিকি, গিরগিটি, আরশোলা, ইঁদুর, অভাব এবং স্বার্থপর স্নেহ এক সঙ্গে গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি করে বাস করত।” একান্নবর্তী পরিবারের অর্থগৃধ্নুতা, সম্পত্তি নিয়ে আকচাআকচি যেন
ধীর প্রক্রিয়ায় পারস্পরিক প্রীতির শিকড়টিকে শুকিয়ে দেয়। ‘আবর্তের সম্মুখে’ বৃদ্ধ নারী অসমর্থ অসহায় ভাবে দেখেন ছেলেমেয়েরা যেন অচেনা হয়ে যাচ্ছে।

“নারীর ক্ষীণদৃষ্টিতে রাহেলার মুখটা তাঁর কাছে ঝাপসা লাগে। সে মুখটা তাঁর মনে আছে, তার তুলনায় এ মুখ অনেক বড় ও ধূর্ত। এ যেন আর কারও মুখ।”

পরিচিত মানুষ, পরিচিত সমাজ এ ভাবে অচেনা এবং লোলুপ হিংস্র হয়ে যাওয়ার থেকে ভয়ঙ্কর বোধ হয় আর কিছু নেই। দাঙ্গা, দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং পরবর্তী বাস্তবতা টুকরো টুকরো হয়ে আছে গল্পগুলিতে— পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে দুর্বোধ্য অপরিচয়ের অন্ধকার। কেন দূর দূর গ্রাম থেকে অস্ত্র নিয়ে অকারণে হত্যা করতে আসে মানুষ। হত্যার সঙ্গে সমান বীভৎসতায় চলে ধর্ষণের তাণ্ডব, মেশিনগান হাতে ধেয়ে আসে পাক মিলিটারি, গ্রামের পর গ্রামে চলে নির্দয় অত্যাচার। ‘কৃষ্ণপক্ষের দিন’ গল্পের নামটি প্রতীকী হয়ে যায়। হাসান আজিজুল হক একাত্তরের ধ্বস্ত সময়ের দলিলীকরণ করেছেন, কিন্তু শুধু তথ্য আর সত্যের পরিসজ্জা নয়, তাঁর আখ্যান শৈলী যেন চলচ্চিত্রধর্মী হয়ে ওঠে, দৃশ্যমালার সাদা-কালোতে ঝলকে ঝলকে রক্ত গড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধের প্রতি, সংহারের প্রতি তীব্র বিমুখতা সঞ্চার করে তাঁর গল্প। মুক্তিযোদ্ধা আসফ আলির একটা পা কাটার পরও সে বাঁচেনি— অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট-এর কেমেরিখের মতো। আসফ আলির অন্তিম চিৎকার কানে বাজতে থাকে, “আমার ঠ্যাং কাটিছো ক্যানো— আনে দাও, আমি বাড়ি যাবো।” সূক্ষ্ম ভাবে এই নিধনপর্বের মধ্যে কাজ করে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক চেতনা। লেখক রাজনীতি ও ধর্মের ক্রূর, চতুর ফন্দিকে প্রত্যাখ্যান করেন। গল্পের পর গল্পে তিনি দেখান কী ভাবে ধর্মের মুখোশ পরে চলছে জমি দখল, নারী দখল। উন্নতির জয়বাদ্যে, বাইরের রংচঙে মোড়কের আড়ালে নিরন্ন থেকে নিরন্নতর মানুষ। ‘পাতালে হাসপাতালে’ স্বাস্থ্যব্যবস্থার অন্তঃসারহীন খোলসটি বার করে আনে, ‘খনন’ গল্পে আসে উন্নতিশীল অর্থনীতির চালাকি, গ্রামীণ ভূমিব্যবস্থার জগদ্দল সামন্ততান্ত্রিকতা। ভোলা যায় না ‘বিধবাদের কথা’ গল্পে ধর্মমোহের বিষে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দুই বোনের শান্ত সংসারটিকে। গল্পের ভাষা যেন দক্ষিণারঞ্জন, অবনীন্দ্রনাথকে ছুঁয়ে অন্য আকাশে উড়াল দেয়।

“রাহেলা কথা প্রায় বলেই না, গোঁজ হয়ে থাকে, দু-একটা কথা যখন বলে তখন যেন কাঠ-চেরাইয়ের আওয়াজ হয়। ভারি কষা তার কথার স্বাদ। আর নিচু গলায় টানা কথা বলে সালেহা। রোদে-তাতে পুড়ে এসে খানিকক্ষণ তার কথা শুনলে যেন মাটির মেয়ের গামছা পেতে শুয়ে পড়ার আরাম হয়।”

‘মা-মেয়ের সংসার’, ‘জননী’, ‘সমুখে শান্তি পারাবার’, ‘বিলি ব্যবস্থা’ এবং আরও অজস্র গল্পে লেখক আনেন রাষ্ট্রীয় ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যবস্থায় এবং ক্ষমতার প্রহারে ধর্ষিতা মেয়েদের। কোথাও এই পীড়িত নারীরা শ্যামল দেশভূমির সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। কথক যেন মাথা নিচু করে দাঁড়ান সেই মানহারা মানবীর পায়ের কাছে।

“আমি দেখি আকাশ বুজোতে বুজোতে অন্ধকার নেমে আসছে। তার মধ্যে সে হারিয়ে যাবার আগেই আমি দ্রুত পায়ে এই পরিশুদ্ধ জননীর কাছে গিয়ে জিগ্যেস করি, মা, এবার তোর কি হলো?”

ছোটগল্পের সীমারেখা ভেঙে উদ্বেল কবিতা পাঠককে স্তব্ধ করে রাখে।

অন্য বিষয়গুলি:

Division of India Famine Hasan Azizul Huq
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy