গৌরকিশোর ঘোষের (ছবিতে) দেশ মাটি মানুষ তিন খণ্ডে লেখা এপিক ট্রিলজি— জল পড়ে পাতা নড়ে, প্রেম নেই আর প্রতিবেশী যদিও তিনটি স্বতন্ত্র উপন্যাস, কিন্তু মূলত একই উপন্যাসের পৃথক খণ্ড মাত্র। এই ত্রয়ী উপন্যাসের জন্যে ১৯২২ থেকে ১৯৪৬ এই পঁচিশ বছর সময়কালকে নির্বাচন করেছিলেন লেখক। হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের বিবর্তন, দেশবিভাগের ট্র্যাজেডিকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। প্রতিবেশী গ্রন্থের ভূমিকায় গৌরী আইয়ুব লিখেছিলেন, “তিনটি খণ্ডেরই মূল বিষয়টি একই, অর্থাৎ বাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক এবং পঁচিশ বছরে তার বিবর্তন। যা গোড়ায় ছিল ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সংঘাত সেটাই কী করে ক্রমে গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বে এবং শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে পৌঁছে দেশকে খণ্ড খণ্ড করল তারই বস্তুনিষ্ঠ সহৃদয় চিত্রণ। ভারত-ইতিহাসের এই সুপরিচিত ট্র্যাজিডি গৌরের উপন্যাসেও দুটি মানব-মানবীর ব্যক্তিগত ট্র্যাজিডিতে পরিণত হয়েছে তৃতীয় খণ্ডে এসে।”
জল পড়ে পাতা নড়ে উপন্যাসের শুরু ১৯২২ সালে। সেই সময় গ্রাম থেকে হিন্দু একান্নবর্তী পরিবারের অনেকেই শহরে চলে যাচ্ছে জীবিকার সন্ধানে। এক দিকে গ্রামীণ নিম্নবিত্ত পরিবারের প্রেম-ভালবাসা, আশা-নিরাশা, দ্বেষ-বিদ্বেষ, ধর্মান্ধতা-সংস্কার, অন্য দিকে নিকটতম প্রতিবেশী মুসলমান পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন। ১৯২২ সাল থেকে ১৯২৬ সাল, এই চার বছর এই উপন্যাসের কালপর্ব। প্রথম পর্বে স্বাধীনতা আন্দোলনকে ঘিরে নেতৃবর্গের বিভিন্ন চুক্তি আর দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের রাজনৈতিক ভূমিকার পাশাপাশি গ্রামের পরিবারবর্গের ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি বিভিন্ন অধ্যায় বিবৃত হয়েছে। পরবর্তী পর্বে নানা রাজনৈতিক দলের মতভেদ, জোরালো স্বাধীনতা আন্দোলন, চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যু, ইংরেজদেরকে হিন্দু-মুসলমানের তোষণ, পণপ্রথা ইত্যাদি।
এই জীবনধর্মী উপন্যাসের মূল চরিত্র মেজোকর্তার গ্রামে বসবাস, যদিও লেখাপড়া কলকাতায়। মনেপ্রাণে অসাম্প্রদায়িক, গ্রামের ও নিজের পরিবারের সংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাবে ভীত। চিত্তরঞ্জন দাশ যখন হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি রক্ষার চেষ্টা করছেন, সেই সময় মেজোকর্তাও চেয়েছিলেন সকলের জন্যে শিক্ষা ও অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থা করতে, চেয়েছিলেন হিন্দু-মুসলমান ঐক্য। তবুও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, মুসলমানদের পক্ষে তিনি। দেশবন্ধুর ডাকে যেমন হিন্দুরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সাড়া দেয়নি, সেই রকমই উপন্যাসের মেজোকর্তার মাধ্যমে লেখক বলেছেন দেশোদ্ধার সহজ নয়।
এই ত্রয়ী উপন্যাসের দ্বিতীয় উপন্যাস প্রেম নেই সর্বাধিক জনপ্রিয়। ভারতের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বিভিন্ন রকম পরিবর্তনের ছাপ এতে। সুদীর্ঘ সময় ধরে একত্রে থেকেও হিন্দু-মুসলিম এই দুই সম্প্রদায়ের নিজেদের মধ্যে যে তেমন বোঝাপড়া হয়নি, সেই বিষয়টিকে নিবিড় ভাবে বুঝতে ও ব্যাখ্যা করতে চান গৌরকিশোর ঘোষ। ভালবাসার অভাব থেকেই এই উপন্যাসের নাম। হিন্দু-মুসলমান, নারী-পুরুষ, আবার নগরকেন্দ্রিক ও গ্রাম্য মানুষের চিত্র এমন আন্তরিক ও নিপুণ ভাবে এঁকেছেন, সম্পর্কের অন্তর্দ্বন্দ্ব, প্রেম, সংঘাত, রাজনৈতিক চেতনাকে স্পষ্ট করেছেন, তৎকালীন সমাজকে হৃদয়ঙ্গম করতে পাঠকের অসুবিধে হয় না। এক চরিত্রের মুখে লেখক বলেছেন, “হিন্দুদিগের সঙ্গে মুছলমানদিগের মিশ খাওয়া সম্ভব না। ক্যান? পেরধান কারণ এই যে ইরা দুটো আলাদা জাত। হিন্দুরা পয়দা হইছে হিন্দুস্থানে, মুছলমানরা পয়দা হইছে আরবে। আমাদিগের মুছলমানদিগের আসল দেশ হল আরব দেশ।” অর্থাৎ, লেখক মুসলমান সমাজের চেতনার ফাঁকফোকরও তুলে ধরেছেন। আবার, হিন্দুধর্মের সংস্কারকদের সঙ্গে শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যেও চেতনা জাগ্রত হওয়ার আখ্যান বুনেছেন।
শেষ উপন্যাস প্রতিবেশী-র মূল চরিত্র অমিতা ও শামিম ভালবেসেছিল পরস্পরকে। দু’টি শিক্ষিত মনের মানুষ তাদের বুদ্ধি ও আবেগ দিয়ে পরস্পরকে শরীরে ও মনে গ্রহণ করেছিল, কিন্তু ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডির ছায়া পড়ল তাদের ব্যক্তিজীবনে। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল তারা। অমিতার মারণরোগ ক্যানসারকে লেখক প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন দেশের রাজনীতির সঙ্গে তুলনা করে। গৌরী আইয়ুব লিখেছেন, “একটি মাত্র চরিত্রের সাহায্যে তখনকার জটিল রাজনৈতিক চিত্রটিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠার দুঃসাধ্য দায়িত্ব নিজের উপর আরোপ করেছিলেন লেখক। অমিতার স্মৃতিতে ভিড় করে আসা মানুষগুলি তো তখন ছায়াছবি। তারই প্রেক্ষিতে একটি সংরক্ত প্রেমের কাহিনীও বুনে গিয়েছেন গৌরকিশোর।”
রাজনৈতিক ঘটনার সঙ্গে ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক দিক বিশ্লেষণ করাই লেখকের মূল উদ্দেশ্য ছিল। তদানীন্তন ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রেও যেমন শ্রেণি-সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়েছিল, সেই রকমই ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষে মানুষে বিভেদও বিস্তার লাভ করেছিল, বিশেষত নারী-পুরুষে। সমাজের একাংশ ছিল নারীমুক্তির পক্ষে, অন্যেরা বিরোধীপক্ষ। প্রতিবেশী উপন্যাসে সেই রকমই দুই চরিত্র ছিল শামিম এবং অমিতার বাবা, এক জন প্রগতিশীল এবং অন্য জন জাত-পাতের বেড়াজালে আবদ্ধ।
স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ যখন শহর থেকে গ্রামে গিয়ে পড়েছিল এবং আন্দোলনের আঁচ লেগেছিল গ্রামের মানুষদের মধ্যে, সেই সময়কে এবং সম্পর্কের অন্তর্দ্বন্দ্ব, প্রেম, সংঘাত, রাজনৈতিক চেতনাকে সুস্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত করেছেন গৌরকিশোর তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে। সাড়া-জাগানো এই ত্রয়ী উপন্যাস কালের সীমা অতিক্রম করে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে আজও মূল্যবান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy