সন্ধে হয়ে এল, সে দিন কুমুকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। শেষ কালে দেখা গেল, ভাঁড়ারঘরের পাশে একটা ছোট কোণের ঘরে যেখানে প্রদীপ পিলসুজ তেলের ল্যাম্প প্রভৃতি জমা করা হয়, সেইখানে মেজের উপর মাদুর বিছিয়ে বসে আছে।
মোতির মা এসে জিজ্ঞাসা করলে, “এ কী কাণ্ড দিদি?”
কুমু বললে, “এ বাড়িতে আমি সেজবাতি সাফ করব, আর এইখানে আমার স্থান।”
মোতির মা বললে, “ভালো কাজ নিয়েছ ভাই, এ বাড়ি তুমি আলো করতেই তো এসেছ, কিন্তু সেজন্যে তোমাকে সেজবাতির তদারক করতে হবে না। এখন চলো।” (যোগাযোগ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
প্রদীপ, সেজবাতি, হারিকেনের দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল মেয়েদের। প্রতি বিকেলে হারিকেনের কাচ পরিষ্কার করে পলতের মাপ ঠিক করে রাখতে হত। যারা এত আলো দেয়, তাদের জীবনে আলো এত কম কেন? কেন বিদ্যুৎ বণ্টনেও লিঙ্গবৈষম্য?
কৃষ্ণকান্তের উইল-এর রোহিণীর চোখের বিদ্যুতের আঁচ বেড়ালটা পর্যন্ত পেয়েছে। ‘‘পশুজাতি রমণীর বিদ্যুদ্দাম কটাক্ষে শিহরে কি না দেখিবার জন্য রোহিণী তাহার উপরে মধ্যে মধ্যে বিষপূর্ণ মধুর কটাক্ষ করিতেছিল’’: যে মেয়েদের চোখে নাকি বিদ্যুৎ— বিজলী, বিদ্যুৎপ্রভা কিংবা সৌদামিনী, কত নাম তাদের, তাদের জীবনে বিদ্যুতের ব্যবহার কতটুকুই বা?
‘‘অন্দরটা যেন পশমের কাজের উল্টো পিঠ। সেদিকে কোন লজ্জা নেই, শ্রী নেই, সজ্জা নেই। সেদিকে আলো মিটমিট করে জ্বলে।’’ (স্ত্রীর পত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
১৮৭৯ সালের ২৪ জুলাই পি ডব্লিউ ফিউরি অ্যান্ড কোম্পানি এ শহরে প্রথম বিদ্যুতের আলো জ্বাললেও বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয় ১৮৯৯-এর ১৭ এপ্রিল থেকে। স্ত্রীর পত্র প্রকাশিত হয়েছিল সবুজপত্র মাসিক পত্রিকায়, শ্রাবণ ১৩২১। এখানে প্লেগের উল্লেখ আছে, সুতরাং ধরে নেওয়াই যায় বিদ্যুৎ এসে গেছে গৃহস্থবাড়িতে। তবে বিদ্যুৎ সহজে নিতে চাননি গৃহস্থেরা। একে তো ছিল কুসংস্কার। দ্বিতীয়ত, দাম বেশি বিদ্যুতের, যা তখন লন্ডনের সমান। তাই গ্যাসবাতি প্রথমে বিজলিকে হারিয়ে দিয়েছিল, এমনকি ভোটাভুটি অবধি হয়েছিল এই নিয়ে।
রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলায় ‘‘তখন শহরে না ছিল গ্যাস, না ছিল বিজলি বাতি, কেরাসিনের আলো পরে যখন এল তার তেজ দেখে আমরা অবাক। সন্ধ্যাবেলায় ঘরে ঘরে ফরাস এসে জ্বালিয়ে যেত রেড়ির তেলের আলো। আমাদের পড়বার ঘরে জ্বলত দুই সলতের একটা সেজ।...বাহিরমহল থেকে বাড়ির ভিতর যাবার সরু পথ ছিল খড়খড়ির আবরু-দেওয়া, উপর থেকে ঝুলত মিটমিটে আলোর লণ্ঠন।’’
বাহিরমহলের তুলনায় রেড়ির তেলের আলো, গ্যাসবাতি, পরে বিজলি বাতির ভাগ বরাবর কমই পেয়েছে অন্দর। শহরের এই যখন অবস্থা, গ্রামে আরও কতই না ভয়ানক।
১৯৫৫ সালে প্রকাশিত উপন্যাস আবু ইসহাকের সূর্য দীঘল বাড়ি। সেখানে মা জয়গুণ আর দাদা হাসু বেরিয়ে গেলে সারা দিন একাই থাকে দশ বছরের বালিকা মায়মুন। ‘‘ঘরে সাঁঝ বাতি দেখিয়ে আবার নিবিয়ে দ্যায় মায়মুন। আবছা অন্ধকারে বসে মাছ কয়টা কুটে লবণ দিয়ে রাখে।
রাত নটা দশটা পর্যন্ত অন্ধকারে ওকে একা বসে থাকতে হয় প্রায়ই।’’
স্বাধীনতার এত বছর পরেও অবস্থা কিছু বদলাল কি? সুন্দরগড় জেলার এক গ্রামে অন্ধকারে ভাত খেতে হয় বালিকাকে। জমির দখল না েপয়ে নালিশ জানাতে আসা ভূমিহীন আদিবাসী, তার মেয়েটির কেন গলার একধার ফুলে আছে, জানতে চাইতে সে বলে, ও কিছু না। অন্ধকারে খাচ্ছিল, গলায় কাঁটা ফুটে গেছে। অপারেশন করতে বার হল, মাছের কাঁটা না, দেড় ইঞ্চি লম্বা লোহার তার। ভাতের মধ্যে ছিল। (রোদ বাতাসের পথ, অনিতা অগ্নিহোত্রী)
দেখা গেছে, অনেক গ্রামে বাড়ি বাড়ি বিদ্যুৎ গেলেও সেটার ব্যবহার ও বণ্টন নিয়ন্ত্রণ করছেন বাড়ির পুরুষরাই। গ্রামীণ ভারতে (বিদ্যুৎ সংযোগহীন অংশের বিচারে বিশ্বের একদম প্রথম সারিতে যার স্থান) সমীক্ষা চালিয়ে বেরিয়ে এসেছে এ রকম কিছু তথ্য। মেইতাল রোজ়েনবার্গ ও তাঁর দল গুজরাতের একটি গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ আছে এমন বাড়ির তিরিশ জনের বেশি নারীর ইন্টারভিউ নেন। রোজ়েনবার্গ জানতে চেয়েছিলেন, এই সব বাড়িতে পুরুষ-ব্যবহৃত, নারী-ব্যবহৃত এবং লিঙ্গ-নিরপেক্ষ: এই তিন ধরনের বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রের মধ্যে কোনটা কতটা চালানো হয়। দেখা গেছে, এই সব বাড়িতে পুরুষের ব্যবহৃত যন্ত্রের সংখ্যা অনেক বেশি। একান্ত ভাবে মেয়েদের যন্ত্র ভাবা হয় যাদের, সেই সেলাই মেশিন, মিক্সার-গ্রাইন্ডার কেনার ক্ষেত্রেও পুরুষই সিদ্ধান্ত নেন, এই সব যন্ত্রে বিদ্যুৎ একটা বাজে খরচই ভাবা হয়। এমনকি আলো, পাখা এই সব তুলনায় সস্তা ‘অ্যাপ্লায়েন্স’ রান্নাঘর বা রান্নাঘর-সংলগ্ন জায়গায় লাগানো কম হয়। রান্নাঘরে জ্বলে সবচেয়ে কম পাওয়ারের বাল্ব। দেখা গিয়েছে, বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ এলে তার আশি শতাংশ ব্যবহার হয় আলো এবং টিভিতে। দুটোতেই মেয়েদের জীবনে পরিবর্তন আসে। বিজলি আলো এলে কেরোসিনে জ্বলা কুপি বা হারিকেনের ব্যবহার কমে, যার ফলে দূষণ কমে (‘কেরোসিনের সুবাতাসে/ মহাপ্রাণি খইসে আসে’), কমে দুর্ঘটনার ঝুঁকি, বেঁচে যাওয়া সময় মেয়েদের বাইরের কাজ করতে দেয়, তা ছাড়া বাড়িতে এবং গ্রামের পথে আলো থাকলে মেয়েদের নিরাপত্তাও বাড়ে। অন্য দিকে টিভি শুধু বিনোদন নয়, ঘরের মধ্যে নিয়ে আসে গোটা বিশ্বকে।
ধরেই নেওয়া হয়, যে কাজ মেয়েরা বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া হাতেই করতে পারেন, যেমন শিলে মশলা বাটা বা হাতে কাপড় কাচা, সেখানে যন্ত্র কেনা একটা বাজে খরচ। এটাও দেখা যায়, গৃহসহায়িকা থাকলে সহজে মিক্সার-গ্রাইন্ডার বার করা হয় না। শিলেই মশলা পেষানো হয়। মেয়েদের পরিশ্রম বা স্বাস্থ্যের বিষয়টা একেবারেই নন-ইস্যু।
রোজ়েনবার্গকে এক-চতুর্থাংশ মহিলা জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ আসার ফলে তাঁরা বাইরের কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। বেশির ভাগ মহিলাই জানিয়েছেন, বাড়িতে যে ‘অ্যাপ্লায়েন্স’গুলো কেনা হয়, সেগুলো বেশির ভাগই তাঁদের স্বামী আর বাচ্চারা ব্যবহার করে। এটাও দেখা গিয়েছে, যে সংসারের মাথা নারী, সেখানে রান্নাঘরে উজ্জ্বল আলো ও পাখা রাখার দৃষ্টান্ত আছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় এবং গুয়াতেমালায় গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ তৈরির ফলে মেয়েদের নিযুক্তি নয় শতাংশ বেড়েছে। আলোকমালায় সজ্জিত শহরে উৎসবের আবহে বসে সে কথা আমরা যেন ভুলে না যাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy