গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আমরা জানি, শীতে বিলেতে কষ্ট পেতে হয় না। হয় শুধু আমাদের দেশেই। ও দেশে বাড়ি, অফিস, গাড়ি, বাস, ট্যাক্সি, মেট্রো— সবই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। তাপমাত্রা এমন ভাবে রাখা হয়, যাতে বাইরে যখন বরফ পড়ছে, বাড়ির ভিতরে আপনি শুধু শার্ট পরেই থাকতে পারেন। এই স্বাচ্ছন্দ্য চিরকাল ছিল না। এটা সম্ভব হয়েছিল গত শতাব্দীর ষাটের দশকে, যখন প্রাকৃতিক গ্যাস সহজলব্ধ হয়। তার আগে কয়লা পুড়িয়ে গ্যাস উৎপন্ন করে কাঠের পাইপে করে তা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হত। পরিমাণ অল্প হওয়ায় দাম ছিল বেশি। সেই সময়ের গরিব মানুষের দুর্ভোগ ধরা আছে চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমায়।
সত্তরের দশকে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রস্তাব দিল, সাইবেরিয়ার গ্যাসের খনি থেকে তারা ইউরোপে গ্যাস পাঠাবে। হিসাব কষে দেখা গেল আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরেও গ্যাসের দাম কমই থাকবে। কিন্তু তখন আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই চলছে। আমেরিকা চায় না ইউরোপ সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে এ রকম চুক্তিতে আবদ্ধ হোক। কিউবার মিসাইল সঙ্কটের মতো পরিস্থিতি আবার হলে এই চুক্তি সোভিয়েতের হাতে একটা বড় অস্ত্র তুলে দেবে। গ্যাস বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে সোভিয়েতরা ইউরোপকে তাদের দিকে টানতে পারবে।
তাই আমেরিকা এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে। ইউরোপ কিন্তু এই সস্তা এবং পরিচ্ছন্ন জ্বালানির মূল্য অস্বীকার করতে পারে না। ঝুঁকি থাকলেও তারা ঠিক করে, সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে গ্যাস আমদানি করা হবে। সেই সময় হল্যান্ড এবং নরওয়েতে দুই অতিকায় গ্যাসের খনি পাওয়া যায়। ব্রিটেনও নর্থ সি-এর গ্যাস কাজে লাগাতে সক্ষম হয়। এই পরিস্থিতিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন গ্যাস বন্ধ করে ইউরোপকে বিপদে ফেলতে পারবে না— এই আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে। গ্যাস সরবরাহের চুক্তি সম্পন্ন হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হয়। রাশিয়া গ্যাসের সরবরাহ বজায় রাখে এবং বাড়াতে চায়। আমেরিকা আবার আপত্তি জানায়। কিন্তু ইউরোপে সে আপত্তি গ্রাহ্য হয় না।
গ্যাসের পরিমাণ বাড়তে বাড়তে এ বছরের গোড়ায় দাঁড়িয়েছে দৈনিক ১৬ কোটি ঘন মিটারে। ইউরোপে যত গ্যাস ব্যবহার হয়, রাশিয়ার গ্যাস ছিল তার ৩৪ শতাংশ। গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সে যুদ্ধ আজও চলছে। বোঝাই যায়, আমেরিকা ও ইউরোপের সক্রিয় সাহায্য ছাড়া ইউক্রেন কখনওই পারত না এত দিন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। অন্য দিকে, আমেরিকা বোঝে যে শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনকে সাহায্য করলে হবে না। রাশিয়াকে পরাজিত করতে হলে তাকে আর্থিক ভাবে পঙ্গু করতে হবে। তাই রাশিয়ার আমদানি-রফতানির উপর একাধিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। প্রশ্ন ওঠে ইউরোপীয় দেশগুলি কি আমেরিকার হাত শক্ত করতে রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি বন্ধ করবে?
ইউরোপ কিছু বলার আগেই রাশিয়া নির্দেশ জারি করে যে, গ্যাসের দাম আর ডলারে দিলে চলবে না। দিতে হবে রাশিয়ান রুবলে। এর কারণ বোঝা কঠিন নয়। ডলার যে কোনও সময়ে বাজেয়াপ্ত হতে পারে। ইউরোপের দেশগুলি জানায়, এই নির্দেশ তারা মানবে না। তাই রাশিয়াই বন্ধ করে দিল গ্যাসের প্রবাহ। ১৬ কোটি ঘন মিটার নেমে এল ৬ কোটিতে। ইউরোপ তাতে বিচলিত হয়নি। তাদের বক্তব্য, তারা এমন ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে যে ২০২২ সালের পরে এই গ্যাস আর তাদের প্রয়োজন হবে না।
কী কাজে লাগে এই গ্যাস? এ প্রশ্নের উত্তর এক এক দেশে এক এক রকম। আগেই বলা হয়েছে গোটা ইউরোপে বেশির ভাগ গ্যাসের ব্যবহার হয় ঘরবাড়ি গরম রাখার কাজে। এর পরেই আসে বিদ্যুৎ উৎপাদন। কারণ এই কাজে গ্যাস টারবাইনের কার্যকরিতা সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া গ্যাস কাজে লাগে শিল্পে ব্লাস্ট ফার্নেস থেকে শুরু করে সব ফার্নেসে। তা হলে রাশিয়ার সরবরাহ কমে যাওয়াতে ইউরোপের অসুবিধা হয়নি কেন? তার বড় কারণ, এ বছর এখনও শীত পড়েনি। গ্যাসের চাহিদা কম আছে। প্রত্যেক দেশেই গ্যাসের বড় বড় ভূগর্ভস্থিত ভান্ডার আছে। গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলে ভান্ডারে গ্যাস ভর্তি করা হয়। যে কোনও কারণে গ্যাসের সরবরাহ কমে গেলে ভান্ডারে জমানো গ্যাস খরচ করা হয়।
এখনও পর্যন্ত ইউরোপ তার জমানো গ্যাস ব্যবহার করছে। এ বার এই ভান্ডার আবার ভরতে হবে। তার জন্য আমদানি করা হবে তরলীকৃত গ্যাস (এলএনজি)। তাই দু’টি এলএনজি টার্মিনাল প্রস্তুত করা হচ্ছে জরুরি ভিত্তিতে। আগামী বছরেই সেগুলি চালু হয়ে যাবে। আর কোন জ্বালানি ব্যবহার করা যায় গ্যাসের পরিবর্তে? এক, কয়লা। দুই, জলবিদ্যুৎ। তিন, পরমাণুবিদ্যুৎ। এ বছর অল্প বৃষ্টির কারণে জলবিদ্যুৎ কম হয়েছে। নদীতে জল কম ছিল বলে বার্জে কয়লা নিয়ে যাওয়া যায়নি। পরমাণু চুল্লি ঠান্ডা রাখার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ জল পাওয়া যায়নি।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, দুর্ভাগ্য আর গরুর গাড়ি কখনও একলা আসে না। আজকের ইউরোপে অবশ্য গরুর গাড়ি দুর্ভাগ্যের প্রতীক নয়। কারণ, ইউরোপ চেষ্টা করছে গ্যাসের পরিবর্ত হিসেবে বায়োগ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে। এ ছাড়া সৌর এবং বায়ুবিদ্যুৎ তো আছেই। ইউরোপ সমুদ্রবক্ষে টারবাইন বসিয়ে প্রচুর বায়ুবিদ্যুৎ উৎপন্ন করে। সেটা এই বিপদে কাজে লাগছে। ইউরোপের গ্রিন পার্টিগুলি পারমাণবিক শক্তির বিরোধিতায় সব সময়ে সক্রিয়। ১৯৯০ সালের পরে ইউরোপে কোনও নতুন চুল্লি চালু হয়নি। পুরনো চুল্লিতে উৎপাদন যত দূর সম্ভব কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগামী শীতে ইউরোপ কি পরমাণু বিরোধিতা শিকেয় তুলে রাখবে?
পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যত গ্যাস পাওয়া গিয়েছে তার দুই-তৃতীয়াংশ পাওয়া যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ইরানে। সোভিয়েত ইউনিয়ন তার গ্যাস সম্পদ কাজে লাগিয়ে কোটি কোটি ডলার উপার্জন করেছে। ইরানও চেষ্টা কম করেনি। কিন্তু তারা সফল হয়নি। এই ব্যর্থতার পিছনে সোভিয়েতের হাত ছিল কি না বলা কঠিন। ইউরোপে গ্যাস পাঠাতে না পেরে ইরান চেষ্টা করে কিছু গ্যাস ভারতে পাঠাতে। এই গ্যাস আসার কথা ছিল পাকিস্তানের উপর দিয়ে। এই ব্যবস্থা কি আমাদের পক্ষে নিরাপদ হত? কেউ কেউ রাজি ছিলেন ঝুঁকি নিতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই প্রস্তাব বানচাল হয়ে যায়। পাইপলাইনে গ্যাস আনা উচিত হবে না বুঝে সরকার ঠিক করে এলএনজি আমদানি করা হবে। এলএনজি আমদানিকারি দেশের মধ্যে ভারত এখন প্রথম সারিতে।
ইউরোপ কি শীত পড়ার আগেই প্রয়োজনীয় এলএনজি জোগাড় করে ফেলতে পারবে? ইউরোপের এখনকার চাহিদা হল মোট উৎপাদনের ১০ শতাংশ। এই পরিমাণ এলএনজি পাওয়া নিশ্চয়ই সম্ভব, কিন্তু পা ফেলতে হবে সন্তর্পণে। না হলে দাম বেড়ে যাবে হুহু করে। আমরা বলি, কী দরকার ঝুঁকি নেওয়ার! ডিসেম্বর-জানুয়ারি হল বাংলা ভ্রমণের সবচেয়ে ভাল সময়। এই সময়ে কেউ পয়সা খরচ করে ইউরোপে পড়ে থাকে? আমাদের রাজ্য সরকার ট্যুরিজমের জন্য কত কি করছে তা তো কারও অজানা নয়। রাষ্ট্রপুঞ্জও স্বীকার করেছে সে কথা। এই সুযোগ। একটা হোম-স্টে বুক করুন। আর বেরিয়ে পড়ুন। পুরো ইউরোপ উঠে এলেও সুন্দরবনে ভেটকির অভাব হবে না!
(লেখক পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব। মতামত নিজস্ব।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy