মুখ্যমন্ত্রী খুশি হয়ে যেটুকু দিয়েছেন তার বেশি এক পয়সাও কেন দেওয়া যাবে না? কী যুক্তি খাড়া করা হয়েছে সরকারের তরফে? গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
রাজ্য সরকার কি তার কর্মচারীদের কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘ ভাতা (ডিএ) দিতে বাধ্য? মোটেও নয়। কেন্দ্রের পরিস্থিতি আর রাজ্যের পরিস্থিতি এক হতে পারে না। তাদের প্রয়োজন আলাদা। সামর্থ্য আলাদা। তাই চিকিৎসার ক্ষেত্রে বা অন্যান্য সুযোগসুবিধার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী আর রাজ্য সরকারের কর্মীদের মধ্যে একটা ফারাক থাকেই। কখনও সেটা কমে। কখনও বাড়ে। বেড়ে গেলে কর্মীদের অসন্তোষ বাড়ে। রাজ্য সরকার নিয়োজিত ‘পে কমিশন’ তখন সব দিক খতিয়ে দেখে সরকার এবং কর্মচারীদের বক্তব্য শুনে সুপারিশ করে, ভাতা ঠিক কতটা বাড়ানো যুক্তিযুক্ত হবে। সরকার মানতেও পারে সেই সুপারিশ। না-ও মানতে পারে।
১৯৭০-এর দশকে মুদ্রাস্ফীতি যখন পুরনো রেকর্ড ছাপিয়ে গেল, তখন সরকার ঠিক করল, সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হবে, যাতে তাঁরা কিছুটা অন্তত ক্ষতিপূরণ পায়। তার পরে এল সবুজ বিপ্লব। খাদ্যশস্যের জোগান বাড়ল। আমেরিকা থেকে পিএল ৪৮০-র গম আসা বন্ধ হল। মুদ্রাস্ফীতি কিন্তু রয়েই গেল। সেই সঙ্গে মহার্ঘ ভাতাও। সেই থেকেই দশ বছর অন্তর গঠিত বেতন কমিশনের একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল মহার্ঘ ভাতার হার ঠিক করে দেওয়া। আমাদের রাজ্যে ২০০৮ সালে গঠিত বেতন কমিশন সুপারিশ করে কী ভাবে ধাপে ধাপে কেন্দ্র এবং রাজ্যের মহার্ঘ ভাতার তফাত কমিয়ে আনা যায়। রাজ্য সরকার সে সুপারিশ গ্রহণ করে। সেই সিদ্ধান্ত রোপা অধিনিয়মের অন্তর্গতও হয়।
তা যদি চিরকুটের সিদ্ধান্ত হত, তা হলে তাকে চিরকুটেই বিদায় করা যেত। কিন্তু সে কালে চিরকুটে ভাতা দেওয়া হত না। সিগারেটের প্যাকেটে নাম লিখে চাকরি দেওয়া হত না। সেখানেই হয়েছে বিপদ। সঠিক পদ্ধতি মেনে সিদ্ধান্ত হওয়াতে কর্মচারীদের তাতে আইনি অধিকার জন্মেছে। আজকে আন্দোলনে নেমে তাঁরা এই অধিকার রক্ষা করতে চাইছেন। আদালত এবং স্যাট— দু’তরফেই এখনও পর্যন্ত এই অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় হারে ডিএ চাওয়াটা হল পাটিগণিতের সমাপতন। আইনের চোখে কর্মচারীরা চাইছেন রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হোক। তাই ‘কেন্দ্রের চেয়ে ছুটি বেশি দিচ্ছি’ বললে বোধ হয় সুবিধা হবে না।
সরকারের কাছে কিছু চাইলে, আমরা জানি, সরকার বলবে, পয়সা নেই। আমরাও ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’ তা-ই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকি। মা লক্ষ্মীর কৃপায় সেই পাওয়ার পরিমাণ নেহাত কম নয়। এই সব উন্নয়ন মার্কা প্রকল্পের পয়সা আসে কোত্থেকে? আমাদের জানার দরকার নেই। সরকারেরও কোনও তাগিদ নেই আমাদের জানানোর। জানার অধিকার আর জানানোর কর্তব্য পূর্ণ হয় সরকারের বাজেটের মাধ্যমে। বাজেটের গুরুত্ব তলানিতে ঠেকেছে। আজকাল নতুন প্রকল্পের ঘোষণা বাজেটে হয় না। বিশেষ কারণে, বিশেষ সময়ে মুখ্যমন্ত্রী প্রকল্পের ঘোষণা করেন। আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর দয়ার শরীর। তিনি ঠিক করলেন, সরকারি কর্মীদের ৩ শতাংশ ডিএ দেবেন। তাতে কত খরচ? ৩-এর বদলে ৫ শতাংশ দেওয়া যেত না? অথবা ১০?
মহৎ কার্যটি সম্পন্ন করা হল চালাকির দ্বারা। ঘোষণা যদিও বিধানসভায় হল। বাজেট ভাষণের দিনেই হল। কিন্তু বাজেটের বাইরে রাখা হল বিষয়টিকে। তাই বিষয়ের খুঁটিনাটি আমাদের আয়ত্তের বাইরে থেকে গেল। পেয়েছি এই না কত! মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘আমাকে কেটে ফেললেও যা দিয়েছি তার বেশি দিতে পারব না। পেনশন দেব, না ডিএ দেব?’’ যে হাঁস সোনার ডিম পাড়ে তাকে কেটে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আমরা তা করব না। কথা দিলাম। কিন্তু খুব শীঘ্রই সুপ্রিম কোর্টে শুনানি আছে। কোর্ট যদি কর্মচারীদের আইনি অধিকারকে গুরুত্ব দেয়? এই বয়সে কিন্তু আদালত অবমাননার দায়ে জেলে যেতে পারব না।বিষয়টি বাজেট-বহির্ভূত হওয়াতে রাজ্য সরকার বিভিন্ন সময়ে নানা মন্তব্য করেছে, যার সমর্থনে তথ্য পাওয়া অসম্ভব। কখনও বলা হয়েছে, বকেয়া কিছু নেই। যা দেওয়ার ছিল সব দেওয়া হয়েছে। কখনও বলা হয়েছে, ৯৯ আর ৬ মোট— ১০৫ পারসেন্ট ডিএ দেওয়া হয়েছে। খরচ হয়েছে ১,৬৪,০০০ কোটি টাকা। আরও ডিএ দিতে হলে পেনশন দেওয়া যাবে না। কর্মী সংগঠনের একটা প্রতিবেদনে দেখলাম, খরচ ৫,০০০ কোটির বেশি হবে না। এত তফাত! তা হলে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির প্রাক্তন চেয়ারম্যানের শরীর ঠিক থাকে কী করে? আমরা তাঁর দ্রুত আরোগ্য কামনা করি।
প্রশ্ন উঠেছে যে, সরকারের হাতে পয়সা না থাকলে সরকার পাড়ার ক্লাবগুলিকে পুজোর জন্য এত টাকা অনুদান দিচ্ছে কী করে? এই হরির লুট শুরু হয়েছিল কয়েক বছর আগে ২৮,০০০ ক্লাবকে ১০,০০০ টাকা করে দিয়ে। এই অনুদান ক্রমাগত বেড়েছে। গত বছর ৪৩,০০০ ক্লাব ৬০,০০০ টাকা করে পেয়েছে। মানে, মোট ২৫০ কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। শুধু ডিএ দিতে পয়সা কম পড়ে? এই যুক্তি সরকারি কর্মীরা মানবেন কেন? তাঁরা স্যাটে গিয়েছেন। কেস জিতেছেন। উচ্চ আদালতে গিয়েছেন। সেখানে কেস জিতেছেন। দেখতে হবে শীর্ষ আদালত কী বলে। মুখ্যমন্ত্রী খুশি হয়ে যেটুকু দিয়েছেন তার বেশি এক পয়সাও কেন দেওয়া যাবে না? কী যুক্তি খাড়া করা হয়েছে সরকারের তরফে?
প্রথমত, বাম সরকার যে টাকা ধার করেছিল, বর্তমান সরকারকে তার সুদ গুণতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, সরকার উন্নয়নমূলক প্রকল্পে বহু টাকা খরচ করছে। যুক্তি দুটো ধোপে টেকে না। কারণ, দেশের যে সব রাজ্যে উন্নয়নে খরচ বেশি, সেই রাজ্যগুলিতে ডিএ-র হারও বেশি। একই পরিস্থিতি সেই সব রাজ্যে, যেখানে সরকারি ঋণের পরিমাণ বেশি। সরকারের ইচ্ছা থাকলে, ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষমতা থাকলে এগুলি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় না। তৃতীয় যে কারণ মাঝে মধ্যে শোনা যাচ্ছে, তা হাস্যকর। বলা হচ্ছে, কেন্দ্র বিপুল পরিমাণ টাকা বাকি রাখায় সরকার ডিএ দিতে পারছে না। কিন্তু কেন্দ্র বিভিন্ন কারণে— বিশেষ করে দুর্নীতির অভিযোগে— যে টাকা আটকে রেখেছে তা তো নির্দিষ্ট স্কিমের টাকা। সেই টাকায় ডিএ হবে বললে তো কোনও দিনই পাওয়া যাবে না সে টাকা!
যাই হোক। আপাতত অপেক্ষা। শীর্ষ আদালতে শুনানির জন্য। অবশ্য যাঁরা এই কঠিন লড়াইটা চালাচ্ছেন, তাঁরা জানেন যে শুধু আদালতে জিতলে হবে না। লড়াই যত ব্যাপক হবে, ততই ভাল। আমার কাছে বড় প্রশ্ন হল প্রশাসন কী ভাবে চলবে? কারও খেয়াল, খুশি অনুযায়ী, না কি ৭০ বছর ধরে তৈরি করা সিস্টেমের ভিত্তিতে? আমিও চাইছি সব প্রশ্নের সুষ্ঠু সমাধান হোক।
(লেখক পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব। মতামত নিজস্ব।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy