জুলজুল করে তাকানো বোধ হয় ওটাকেই বলে। হাতে গোল্ডেন বুট। মুখে হাসি নেই। দু’চোখ তাকিয়ে আছে সামনের পোডিয়ামের উপর রাখা সোনালি বিশ্বকাপের দিকে। অপলক। ছবি: ইমাগো।
ফাইনালের বিরতিতে টেক্সট মেসেজ ভেসে এল— ‘কী রকম যেন মনে হচ্ছে টালিগঞ্জ অগ্রগামী খেলছে। ফ্রান্স নয়।’ ঠিকই। বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখতে দেখতে সেটাই মনে হচ্ছিল। ফ্রান্সকে গোটা ময়দানে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! গ্রিজম্যানকে আটকে দেওয়ায় জিরু বেকার। গ্রিজম্যান এমবাপেকে বলও বাড়াতে পারছেন না। হু-হু করে আক্রমণে উঠছেন মেসি, দি’মারিয়ারা। প্রথমার্ধেই দুটো গোল ভরে দিয়েছে আর্জেন্টিনা। প্রথমটা পেনাল্টি— মেসি, মেসি, মেসি। দ্বিতীয়টা দি’মারিয়া। সারা পৃথিবী জুড়ে মেসিভক্তেরা উদ্বেল।
অগ্রজ হিতৈষীকে পাল্টা টেক্সট পাঠালাম— ‘ফ্রান্স মনে হচ্ছে শেষমেশ চারটে নেবে!’’
লিয়োনেল মেসিকে ক’বার চর্মচক্ষে দেখেছি? সাকুল্যে বারদুয়েক। প্রথম বার বেজিং অলিম্পিক্সের সময় সেমি ফাইনাল এবং ফাইনালে। দ্বিতীয় বার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে। মিত্র মদন-অধ্যুষিত জমিতে। কোনও দিন সে ভাবে ‘চরিত্র’ বলে মনে হয়নি। আসলে ‘নেতা’ বলে মনে হয়নি। কখনও চাক্ষুষ না দেখলেও চিরকাল সিআর সেভেনের ভক্ত (বিশ্বকাপে তাঁকে একাধিক ম্যাচে রিজার্ভ বেঞ্চে বসিয়ে রাখায় পর্তুগাল কোচের উপর একটু রাগও হয়েছিল)। মেসিকে গ্রহান্তরের প্রাণী বলে মনে হয়। রোনাল্ডোকে রক্তমাংসের মানুষ। মেসিকে প্রতিভা মনে হয়। রোনাল্ডোকে পরিশ্রমী শ্রমিক। কিন্তু বিশ্বকাপ ফাইনালে প্রথম মেসিকে ‘নেতা’ মনে হচ্ছিল। খানিকটা স্বভাববিরুদ্ধ। খানিকটা আগ্রাসী। খানিকটা গ্যালারিকে তাতিয়ে দেওয়া। খানিকটা শ্রমিকও বটে।
২০১৮ সালে লেখা দি’মারিয়ার একটা লেখা পড়ছিলাম। যেখানে মেসির সতীর্থ লিখেছিলেন, ‘বড় ফুটবলারদের প্রায় প্রত্যেকেরই পেরিফেরাল ভিশন থাকে। না তাকিয়েও তারা চোখের কোণ দিয়ে দেখে নিতে পারে, দলের কোন ফুটবলার আশপাশে কোথায় আছে। সেই অনুযায়ী তারা ঠিকানা লেখা পাস বাড়ায়। কিন্তু মেসির তার চেয়েও বেশি কিছু আছে। ড্রোন ভিশন। ও মাঠটা সকলের মাথার উপর থেকে দেখতে পায়। কী করে দেখতে পায় জানি না। কিন্তু পায়।’
সেই ড্রোন ভিশন লিয়োনেল মেসিকে কী বলছিল সেই রাতে লুসেইলের স্টেডিয়ামে? সেই দিব্যদৃষ্টিতে কি তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন তাঁর গোটা বিশ্ব? যে বিশ্ব আকুল আকুতি নিয়ে চাইছে, এই বিশ্বকাপটা তাঁর হোক। শুধু তাঁর! তাই কি পেনাল্টিটা নেওয়ার আগে এক বার দু’চোখ বুজলেন মেসি? ফুটবল দেবতার কাছে প্রার্থনার নৈবেদ্যটুকু সাজিয়ে দিলেন কি?
সারা মাঠে পিনপতন নীরবতা। জালে বলটা জড়াতে শব্দব্রহ্মের বিস্ফোরণ হল আবিশ্ব। অবাক হয়ে দেখলাম, গোল করার পর মেসি ‘স্লাইড’ করলেন মাঠে। স্বভাববিরুদ্ধ। এই প্রথম তাঁকে মনে হল রক্তমাংসের মানুষ। এই প্রথম তাঁর প্রতিভার বিচ্ছুরণ ছাপিয়ে বেরিয়ে এল শ্রমিকের ওভারঅল। ঘামে-ভেজা নীল-সাদা জার্সিগুলো যখন তাঁর টান টান চেহারার উপর শুয়ে পড়ছিল আনন্দের আতিশয্যে, মনে হচ্ছিল, মেসি চাপা পড়ে রয়েছেন স্তূপীকৃত স্বপ্নের নীচে।
সেই স্বপ্ন একা চুরমার করে দিতে বসেছিলেন এক তেইশের তরুণ। ৭০ মিনিটের পর একা খেলা ঘুরিয়ে দিয়ে। দেড় মিনিটের তফাতে। ৭৯তম মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল। তার ৯৭ সেকেন্ডের মাথায় তাঁর দ্বিতীয় গোল (আসলে ‘গোলা’) বুঝিয়ে দিয়ে গেল, আগামী আট থেকে দশটা বছর এই তরুণের। রাশিয়া বিশ্বকাপে তিনি নেহাতই ‘সাইড শো’ ছিলেন। কাতার বিশ্বকাপে তিনিই আসল। যাবতীয় আলো তাঁরই মুখে।
সেই আলো শেষ পর্যন্ত নিভেই গেল। ওই ড্রিবল, ওই রকম গতি আর ওই ফিনিশ! ফাইনালের শেষ কুড়ি মিনিটের ঝড়, ভয়াবহ গতিতে বুলডোজ়ারের মতো আর্জেন্টিনার ডিফেন্স গুঁড়িয়ে দেওয়া, অতিরিক্ত সময়ে পিছিয়ে পড়েও পেনাল্টিতে গোল শোধ। হ্যাটট্রিক! তবু হল না। টাইব্রেকারে কাপ জিতে নিয়ে চলে গেল আর্জেন্টিনা।
লুসেইল স্টেডিয়ামের ঘাসের উপর বসে আছেন জাতীয় দলের এক ফুটবলার। হসপিটালিটি বক্স থেকে নেমে এসে পাশে হাঁটু গেড়ে বসে দেশের প্রেসিডেন্ট তাঁর পিঠে রাখছেন সান্ত্বনার হাত— এই ফ্রেম সম্ভবত ফুটবল বিশ্বকাপের চিরকালীন ফ্রেমে ঢুকে গেল।
তার কিছু পরে তৈরি হল আরও একটা ফ্রেম।
জুলজুল করে তাকানো বোধ হয় ওটাকেই বলে। হাতে গোল্ডেন বুট। মুখে হাসি নেই। দু’চোখ তাকিয়ে আছে সামনের পোডিয়ামের উপর রাখা সোনালি বিশ্বকাপের দিকে। অপলক। কত কাছে। অথচ চার-চারটে বছর দূরে!
বিশ্বকাপ ফাইনালের পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে ভোম্বল হয়ে-যাওয়া কিলিয়ন এমবাপেকে দেখতে দেখতে একটা বোধিজ্ঞান হল। মনে হল, আমাদের জীবনে প্রতিটি বিষয়ের জন্য তো আলাদা আলাদা ভগবান আছেন। যেমন ফুটবলেরও আছেন। ফুটবলের সেই ভগবান কি মেসিকে তাঁর পেশাদারি ফুটবল জীবনের উপান্তে বিশ্বকাপটা দিয়ে গেলেন? প্রায় তর্কাতীত ভাবে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ফুটবলারের জীবনে প্রাপ্তির বৃত্ত সম্পূর্ণ করলেন? না কি আসলে এমবাপেকে এখনই দিয়ে দিলেন না?
মনে হল, ফুটবলের ভগবান সম্ভবত দেখলেন, সবে ২৪ হতে যাচ্ছে, এমন একটা সময়ে একটি তরুণের এমন একটি সর্বনাশ হতে দেওয়া উচিত হবে না। গোল্ডেন বুট। গোল্ডেন বল। এবং বিশ্বকাপ। যে বিশ্বকাপ তাঁর চার বছর আগেই একবার ছোঁয়া হয়ে গিয়েছে। এ বারেও বিশ্বকাপ জিতলে তো এমবাপে পেলের সমতুল হয়ে যাবেন! বাকি থাকবে কী!
ফুটবলের ভগবান সম্ভবত সে কারণেই তাঁর বরহস্ত তেইশের তরুণের মাথা থেকে সরিয়ে রাখলেন তিরিশের পাগলাটে আর্জেন্টিনীয় গোলরক্ষকের মাথায়। সম্ভবত ফুটবল দেবতা ভাবলেন, এই কাঁচা বয়সে সবই এই ফরাসি তরুণের হাতে তুলে দিলে গোলমাল হবে। ২৪ বছরেই জীবনের উত্তুঙ্গ সাফল্যের শিখরে আরোহণ করে গেলে এর পরে তো খালি পতন! বাকি জীবনটা কী করবে! কারণ, এই সাফল্যের পর বিশ্ব ফুটবলে আর তো সাফল্য হয় না। আর তো শৃঙ্গ নেই সামনে। এর পরে তো শুধু এক পা এক পা করে নীচে নামা!
তাই ফুটবল দেবতা এমবাপেকে আরও চারটে বছর সময় দিলেন। বা আটটা বছর। আসলে ফুটবলের ভগবান লিয়োনেল মেসিকে তাঁর জীবনের উপান্তে বিশ্বকাপটা দেননি। আসলে তিনি কিলিয়ন এমবাপেকে তাঁর ফুটবল জীবনের প্রাক্-মধ্যাহ্নে বিশ্বকাপটা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেই মহাজাগতিক কারণেই সম্ভবত থুরামের হেড করার চেষ্টা ব্যর্থ হল একচুলের জন্য। অথবা ১৩৩ তম মিনিটে কোলো মুয়ানির শটটা মার্তিনেজের বাড়ানো পায়ে লেগে ছিটকে গেল। নইলে তো সেই রাতের ইতিহাসটা অন্য রকম ভাবে লেখা হত। কিন্তু ফুটবলের দেবতা সেটা হতে দিতে চাননি। জুলজুল করে তাকাতে তাকাতে বিশ্বকাপের পাশ দিয়ে এমবাপের হেঁটে যাওয়াটাই সঙ্কেত— এখনও সময় আসেনি!
যেমন সেই রাতে অগ্রজ হিতৈষীর সঙ্গে আর টেক্সট চালাচালি হয়নি। স্বাভাবিক। ৭০ মিনিটের পর টালিগঞ্জ অগ্রগামীর নির্মোক টান মেরে খুলে ফ্রান্সের অবতারে হাজির হয়েছিলেন এক তখনও-তেইশ তরুণ! যাঁকে ফুটবলের ভগবান বঞ্চিত রাখবেন। ভবিষ্যতে উজাড় করে দেওয়ার জন্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy