বর্তমান অর্থবর্ষে ভারতীয় অর্থব্যবস্থা কেমন করল, সেই প্রশ্নের উত্তর পেতে আরও একটু অপেক্ষা করা ভাল। কিন্তু, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে উদ্বেগের কারণ রয়েছে, তা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট। গত অর্থবর্ষের প্রথম তিন মাসের তুলনায় এই বছরের প্রথম তিন মাসে পণ্য বাণিজ্যের খাতে ঘাটতির পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছিল। তার প্রধান কারণ রফতানির শ্লথগতি। অক্টোবর মাসে গুরতর সংবাদ পাওয়া গেল— গত বছরের তুলনায় রফতানি কমেছে ১৭%, কোভিড-পরবর্তী সময়ে এই প্রথম রফতানির পরিমাণ কমল। সমস্যা আরও বাড়িয়েছে পরিষেবা রফতানির শ্লথ বৃদ্ধির হার।
গত বছর ছবিটা অন্য রকম ছিল। ২০২১ সালের শুরু থেকেই পণ্য রফতানির পরিমাণ চড়া হারে বেড়েছিল, কৃষিপণ্য ও শিল্পপণ্য, উভয় ক্ষেত্রেই। গত বছর ভারতের মোট পণ্য রফতানির পরিমাণ ছিল ৪২১০০ কোটি ডলার— ভারতের সর্বকালীন রেকর্ড, এবং প্রথম বার ৪০০০০ কোটি ডলারের সীমা অতিক্রম করা। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে পরিষেবা ক্ষেত্রেও রফতানির পরিমাণ রেকর্ড করেছিল, মোট অঙ্কটি ছিল ২৫৫০০ কোটি ডলার। আন্তর্জাতিক পরিষেবা রফতানিতে যে ক্ষেত্রগুলি ভারতের মূল শক্তি বলে পরিচিত, সেই টেলিকমিউনিকেশন এবং তথ্যপ্রযুক্তির রফতানির পরিমাণ চড়া হারে বৃদ্ধি পাওয়াতেই ভারতের মোট রফতানির পরিমাণও বেড়েছিল।
রফতানি বৃদ্ধির ফলে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার দু’টি তাৎপর্যপূর্ণ লাভ হয়েছিল। প্রথমত, দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা যখন দুর্বল, তখন আন্তর্জাতিক বাজার ভারতীয় অর্থব্যবস্থার আর্থিক পুনরুত্থানে সহায়ক হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, ২০২১-২২ অর্থবর্ষে ভারতে পণ্য ও পরিষেবা, উভয় রফতানির পরিমাণই বিপুল ভাবে বাড়লেও— যথাক্রমে ৬১৩০০ কোটি ডলার ও ১৪৭০০ কোটি ডলার, দুটোই রেকর্ড— রফতানির রেকর্ড বৃদ্ধির ফলে ভারতের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট বা চালু খাতে ঘাটতি ছিল মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মাত্র ১.২%। ফিসক্যাল ডেফিসিট বা রাজকোষ এফআরবিএম আইনের বেঁধে দেওয়া সীমার অনেক উপরে ছিল। এই অবস্থায় চালু খাতে ঘাটতি কম থাকায় অর্থব্যবস্থা পরিচালনার কাজটি তুলনায় সহজ হয়েছিল— ‘জোড়া ঘাটতির সমস্যা’য় পড়তে হয়নি। কিন্তু, বর্তমান অর্থবর্ষে চালু খাতে ঘাটতির হার বাড়ছে দ্রুত, ফলে যে সুবিধা অর্জন করা গিয়েছিল, তা হাতছাড়া হচ্ছে।
পণ্য রফতানির হার ধারাবাহিক ভাবে কমেছে, এবং আমদানি বেড়েছে। ফলে, বর্তমান অর্থবর্ষে এপ্রিল থেকে অক্টোবর, এই সাত মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭৪০০ কোটি ডলার, গত অর্থবর্ষের প্রথম ছ’মাসের বাণিজ্য ঘাটতির চেয়ে ৮৪% বেশি। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর, এই ছ’মাসে গত অর্থবর্ষের একই সময়কালের তুলনায় পণ্য রফতানি বেড়েছে ১৭%, আর পণ্য আমদানি বেড়েছে ৩৯%।
কেউ বলতে পারেন যে, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম যে ভাবে বেড়েছে, তাতে ভারতের আমদানির ব্যয় বেড়ে বাণিজ্য খাতে ঘাটতির পরিমাণ বৃদ্ধি এড়ানোর উপায় ছিল না। এই যুক্তিটি কত দূর গ্রহণযোগ্য, তা বুঝতে গেলে পরিপ্রেক্ষিতটা স্পষ্ট হওয়া দরকার। প্রথমত, অপরিশোধিত তেল আমদানির খরচ বৃদ্ধির পাশাপাশি ভারতে সার, কাপড়, কয়লা ইত্যাদি পণ্যের আমদানি তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধের আগের ছ’মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে তিনটি অপরিশোধিত তেলের— যথাক্রমে ডেটেড ব্রেন্ট, ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট এবং দুবাই ফতেহ-র— স্পট প্রাইস ২৭% বেড়েছিল, কিন্তু মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরে তা ৫% হ্রাস পেয়েছে। তা ছাড়াও, যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর থেকেই ভারত রাশিয়া থেকে অপেক্ষাকৃত সস্তায় তেল কিনছে, ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা তুলনায় কম লেগেছে। এপ্রিলে ভারতের মোট অপরিশোধিত তেল আমদানির ৬% ছিল রাশিয়া থেকে, সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬.৩%। অর্থাৎ, ভারতের বাণিজ্য খাতে ঘাটতির সমস্যাটিকে সম্পূর্ণত তেলের দামজনিত সমস্যা বললে ভুল হবে।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ভারতে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে যে দুশ্চিন্তার উদ্রেক হচ্ছে, তা আমদানি-নির্ভর অর্থব্যবস্থার সমস্যা। বস্তুত, ভারতের দু’টি প্রধান রফতানি পণ্য— পেট্রোপণ্য এবং মণিরত্ন ও গয়না— উভয়ই বিপুল ভাবে আমদানি-নির্ভর। ফার্মাসিউটিক্যালস এবং ইলেকট্রনিক পণ্যের মতো রফতানি পণ্যের ক্ষেত্রেও কথাটি সত্যি। গত তিন দশকের বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় ভারতীয় অর্থব্যবস্থার যে কাঠামোগত চরিত্র তৈরি হয়েছে, তাতে আমদানির উপর নির্ভরশীলতা অপরিহার্য। কিন্তু, আমদানি বাড়লেও ভারতের রফতানি তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়েনি। বিশেষত, ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবরে ভারতের রফতানি ক্ষেত্রে সার্বিক বৃদ্ধির হার যেখানে ১২%, সেখানে পেট্রোপণ্য-বহির্ভূত ক্ষেত্রে রফতানি বেড়েছে তিন শতাংশেরও কম।
২০২২-২৩ অর্থবর্ষের প্রথম সাত মাসে পরিষেবা ক্ষেত্রও পণ্য বাণিজ্যের অনুসারী হয়েছে— গত অর্থবর্ষের একই সময়কালের তুলনায় আমদানির চেয়ে রফতানির পরিমাণ বেড়েছে কম হারে। পরিষেবা ক্ষেত্র নিয়ে এখনই দুশ্চিন্তার বিশেষ কারণ নেই বটে, কিন্তু এই ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার যদি ধারাবাহিক ভাবে শ্লথ হয়, তা হলে ভারতের পণ্য ও পরিষেবা বাণিজ্যের ঘাটতির ছবিটি আরও করুণ হবে।
বাণিজ্যের এই পরিস্থিতি প্রভাব ফেলেছে ভারতের চালু খাতে ঘাটতির পরিমাণেও। গত অর্থবর্ষের শেষ তিন মাসে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল জিডিপির ১.৫%, অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকেই তা পৌঁছে গেল জিডিপির ২.৮%— রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সহনসীমা তিন শতাংশের চৌকাঠের একেবারে কাছে। দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের হিসাব এলে সম্ভবত দেখা যাবে যে, ঘাটতির পরিমাণ আরও বেড়েছে, কারণ পণ্য ও পরিষেবা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ঘাটতির পরিমাণ প্রথম ত্রৈমাসিকের পরের তিন মাসে তিন গুণ হয়েছে— ৩৭০০ কোটি ডলার থেকে ৯৯০০ কোটি ডলার।
বলা হয়ে থাকে যে, চালু খাতে ঘাটতি পুষিয়ে দিতে ঋণ-বহির্ভূত বিদেশি পুঁজির উপর নির্ভর করা ভাল। তার মধ্যে প্রধানতমটি হল ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই) বা প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ। কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবর্ষের পরিসংখ্যান বলছে যে, সে বছর দেশ থেকে সর্বকালের সর্বোচ্চ পরিমাণ প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি বেরিয়ে গিয়েছে। ফলে, চালু খাতে ঘাটতি ঢাকতে এই লগ্নির উপর কতখানি নির্ভর করা যাবে, সে প্রশ্ন থাকছেই। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে ভারতে মোট এফডিআই এসেছিল ৮৪৮০ কোটি ডলার, এবং ভারত থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল ২৮৬০ কোটি ডলারের লগ্নি। অর্থাৎ, নেট লগ্নি এসেছিল ৫৬২০ কোটি ডলার। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক জানাচ্ছে যে, সেই অর্থবর্ষে লগ্নি থেকে প্রত্যক্ষ আয় অথবা ডিভিডেন্ড ও অন্যান্য খাতে বিদেশি লগ্নিকারীরা তুলে নিয়েছিলেন ৩৭০০ কোটি ডলার। মেধাস্বত্বের খাতে— মূলত ভারতে ব্যবসা করে, এমন বিদেশি সংস্থার ট্রেডমার্ক ও পেটেন্ট বাবদ খরচে— বেরিয়ে গিয়েছে আরও ৯০০ কোটি ডলার। সব হিসাব ধরলে, ২০২১-২২ অর্থবর্ষে ভারতে নেট প্রত্যক্ষ লগ্নির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে মাত্র ১০২০ কোটি ডলার।
ঘটনা হল, ভারতের নীতিনির্ধারকরা দীর্ঘ দিন ধরেই প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে অবহিত— এই পুঁজির উপর নির্ভর করে চালু খাতে ঘাটতি ঢাকার নীতি যে বিপরীত ফলদায়ী হতে পারে, তাতে নীতিনির্ধারণের স্তরে সন্দেহ থাকার কথা নয়। ফলে, সরকারের হাতে পড়ে থাকে একটাই পথ— ভারতীয় রফতানিকে আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিযোগিতায় লড়তে পারার মতো সক্ষম করে তোলা।
সেন্টার ফর ইকনমিক স্টাডিজ় অ্যান্ড প্ল্যানিং, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy