কোভিড-১৯’কে নিয়ন্ত্রণে আনতে দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা ও তার প্রয়োগ, বড় ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন তো বটেই, কিন্তু এই মুহূর্তে তার সঙ্গেই প্রয়োজন কিছু জরুরি কিন্তু তুলনায় সহজ পদক্ষেপ করা। প্রথম কাজ হল ‘টেস্ট আর্লি, ট্রিট আর্লি’— শরীরে উপসর্গ দেখা দেওয়ার পর দ্রুত পরীক্ষা করে রোগ নির্ণীত হলে শুরু থেকে ঠিকঠাক চিকিৎসা করা যায়; তাতে সব রকম ঝুঁকিই কমে। কারও কোভিড ধরা পড়লে বাড়ির উপসর্গবিহীন লোকজনের পরীক্ষা করানো, নিভৃতবাসও জরুরি।
অনেকেই নানান অজুহাতে পরীক্ষা করাচ্ছেন না। আবার, বহু মানুষ পরীক্ষা করাতে চেয়েও করিয়ে উঠতে পারছেন না। দূরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার লোক নেই, গাড়ি নেই, হাসপাতালে পরীক্ষার কিট নেই— এমন হরেক সমস্যা। অন্য দিকে, বিভিন্ন উপসর্গ থাকা অবস্থায় রোগীরা হাসপাতালে গিয়ে ভিড় করে লাইন দিলে সেটা সংক্রমণের ‘সুপারস্প্রেডিং ইভেন্ট’ হয়ে উঠতে পারে। বাড়িতে এসে নমুনা সংগ্রহের পরিকাঠামোও অপ্রতুল। এই ক্ষেত্রে বিকল্প হতে পারে র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট। এর সুবিধা অসুবিধা দুই-ই আছে। আরটি-পিসিআর অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য, তাতে সন্দেহ নেই। র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টের সেনসিটিভিটি ৫০%— অর্থাৎ, ৫০% পজ়িটিভ কেসে নেগেটিভ দেখাতে পারে, যাকে বলা হয় ‘ফলস নেগেটিভ’। কিন্তু, এই টেস্টে ফলস পজ়িটিভ খুব কম। অর্থাৎ, পজ়িটিভ এলে সেটা অবশ্যই পজ়িটিভ। আর সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, এই পরীক্ষায় ফলাফল মেলে মাত্র পাঁচ মিনিটে, অনেক কম খরচে। ফলস নেগেটিভের সমস্যা দূর করার ব্যবস্থাও আছে। এর আগে বহু গাইডলাইনেই এসেছে। র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টে যদি নেগেটিভ আসে, তবে রোগীকে তখনই পরীক্ষার ফল না জানিয়ে সেই নমুনাই আরটি-পিসিআর’এর জন্য পাঠাতে হবে। আর, র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টে যদি পজ়িটিভ আসে, তবে আরটি-পিসিআর’এর দরকারই নেই। এর ফলে আরটি-পিসিআর’এর উপর চাপও অনেক কমবে।
পাড়ায়-পাড়ায়, বা কয়েকটি পাড়া মিলে একটা র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট-এর বুথের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আইসিএমআর-এর সাম্প্রতিক গাইডলাইনেও সে কথা বলা হয়েছে। শুধু খোলামেলা বড় জায়গা হতে হবে। পাড়া আর আশেপাশে যাঁরা টেস্ট করাতে চাইবেন, দূরত্ব বিধি মেনে এসে করিয়ে যেতে পারবেন। খুব অসুস্থ হলে খবর দিতে হবে— তাঁদের বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহ করা যেতে পারে। মোবাইল বুথেরও ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এই পরীক্ষার কাজ সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী, এমপিডব্লিউ, এএনএম-রা করতে পারেন। প্যারামেডিক্যাল কর্মী, নার্সিং প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা, এমনকি শিক্ষার্থীরাও এক-দু’দিনের প্রশিক্ষণ পেলে আর পিপিই কিট পেলে এই কাজ করতে পারেন। কেন র্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করানো প্রয়োজন, সে বিষয়ে বিপুল প্রচার চালানোও দরকার।
কোভিড-১৯ এ বার জেলায় জেলায়, গ্রামে গ্রামে অনেক বেশি ছড়াচ্ছে। আরও বেশি ছড়াবে বলেই আশঙ্কা। এই চটজলদি লকডাউনের ঘোষণায় যত সংখ্যক মানুষ গাদাগাদি ভিড়ে বাসে-গাড়িতে কলকাতা থেকে জেলা শহর, গ্রামে ফিরতে বাধ্য হলেন, তাতে এর পরে সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা আরও বেশি। এটা মস্ত বিপদের কথা, কারণ বহু গ্রামাঞ্চলেই স্বাস্থ্য পরিকাঠামো কার্যত নেই। কাজেই, অতি সাবধান হওয়া জরুরি। কেউ বাইরে থেকে এলে তিনি যথাসম্ভব নিভৃতবাস করবেন, বাড়িতে সবাই মাস্ক পরবেন ইত্যাদি। ছোট শহর, গ্রামেও র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টিং বুথ দরকার। আশাকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে জ্বরের তথ্য সংগ্রহ করবেন। এই কাজে আশাকর্মী আর স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি নানা সংগঠনের সহায়তায় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরি হোক।
টিকার গণ-জোগান, সবার জন্য বিনামূল্যে টিকাকরণের সুযোগ প্রয়োজন তো বটেই। সঙ্গে দরকার পাড়ায় পাড়ায় টিকা দেওয়ার বন্দোবস্ত করা। এক জন ডাক্তার, সেবিকা, ডিএমএলটি, বিএমএলটি বা নার্সিং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী, এবং তাঁদের সঙ্গে এখন যাঁদের অন্যান্য কাজকর্ম বন্ধ বা চাপ কম, এমন চাকরিজীবী, স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে দল তৈরি করা যেতে পারে। গ্রামে গ্রামে এই কাজ এএনএম-রা করতে পারেন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আশাকর্মীরাও করতে পারেন। এমনকি ‘হাতুড়ে ডাক্তার’রাও পারেন। টিকা নেওয়ার পরে কোনও প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য ডাক্তার লাগবেই কি না, তা নিয়েও কথা হোক। পাড়ার ক্লাব বা নিকটবর্তী স্কুলগুলোকেও এই কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। আর, বিকেল পাঁচটা থেকে রাত এগারোটা অবধি টিকা দিলে দিনের বেলায় রোদে লাইন দেওয়া এড়ানো সম্ভব। টিকাদাতাদের বাড়তি ডিউটির কথা বলছি না, শুধু দুপুরের বদলে সন্ধ্যা।
বহু উপসর্গযুক্ত বা পজ়িটিভ রিপোর্ট আসা নিভৃতবাসে থাকা মানুষের কাছে পালস অক্সিমিটার নেই। বহু পরিবারের পক্ষেই তিন-চার হাজার টাকা খরচ করে এটি কেনা সম্ভব নয়, জোগাড় করাও মুশকিল। অথচ নিয়মিত অক্সিজেনের মাত্রা মাপার উপর চিকিৎসার সাফল্য অনেকাংশে নির্ভরশীল, কারণ কোভিড-১৯ হ্যাপি হাইপোক্সিয়া তৈরি করে, যেখানে অক্সিজেন মাত্রা কমতে শুরু করলেও প্রথমে শ্বাসকষ্ট হয় না অনেক ক্ষেত্রেই। যখন হয়, তখন রোগীকে বাঁচানো কঠিন। এই পরিস্থিতিতে সরকার থেকে পাড়ায়-পাড়ায়, বা গ্রামে-গ্রামে অন্তত একটা করে পালস অক্সিমিটার দেওয়া হোক— এক জন ব্যবহারের পর স্যানিটাইজ়ারে ভেজানো কাপড় দিয়ে মুছে যা পরের জন ব্যবহার করতে পারেন। অক্সিমিটার দেখারও বিশেষ কিছু পদ্ধতি আছে— অন্তত ৫ মিনিট বসে বিশ্রামের পর রিডিং নিতে হবে; রিডিং যত ক্ষণ না স্থির হচ্ছে, যন্ত্রটি ধরা যাবে না; আঙুল যেন ঠান্ডা না থাকে; আঙুলে নেলপালিশ বা ভোটের কালি না থাকে। এই বিধিগুলোও অক্সিমিটার পাঠানোর সময় জানানো হোক।
গত কয়েক দিনে অনেকেই মোবাইল ফোনের অ্যাপ-ভিত্তিক অক্সিমিটার ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। কাজটা খুবই গোলমেলে। ভুল রিডিং আসছে, স্বাভাবিক অক্সিজেন মাত্রা থাকলেও অনেক কম দেখাচ্ছে। আতঙ্কিত হয়ে লোকজন ডাক্তারবদ্যি করছেন, এমনও হচ্ছে। অক্সিজেন মাপার নীতি অনুযায়ীই মোবাইল দিয়ে মেপে সঠিক রিডিং আসতে পারে না। এখানে বিস্তারিত আলোচনায় যাব না। শুধু অনুরোধ, এটা দিয়ে অক্সিজেন মেপে আতঙ্কিত হবেন না।
পাড়ায় পাড়ায় সেফ হোম, আইসোলেশন সেন্টার তৈরি হোক ক্লাবে, স্কুলে, কমিউনিটি হলে। সরকারি নির্দেশবিধি মেনে, সরকারি সহায়তায় স্থানীয় সংগঠন, আবাসন কমিটিরা এই কাজে এগিয়ে আসুক। যে সব ক্ষেত্রে রোগীর অক্সিজেন লেভেল ৯৪-৯৫%’এর উপরে আছে, কিন্তু বাড়িতে কেউ দেখার নেই; বা যাঁদের বাড়িতে আলাদা থাকার মতো একাধিক ঘর, বাথরুম নেই, তাঁদের জন্য।
যাঁদের অবস্থা মাঝারি থেকে খারাপ, অক্সিজেন স্যাচিয়োরেশন ৯৩%-এর নীচে, তাঁদের জন্য হাসপাতালে ব্যবস্থা করার জন্য যেটুকু সময় প্রয়োজন, সেটা সেফ হোম দিয়ে হবে না। তাঁদের বেশি মাত্রায় অক্সিজেন দিতে হবে, দরকারে ইঞ্জেকশনও দিতে হবে। এর জন্য দরকার অক্সিজেনেটেড বেড ফেসিলিটি, যার জন্য সরকারি গাইডলাইন আছে। বাড়ি বাড়ি অক্সিজেন সিলিন্ডার না রেখে বরং এ রকম অক্সিজেনেটেড বেড ফেসিলিটি তৈরি করা হোক, যেখানে দিনে দু’বার কোনও ডাক্তার দেখে যাবেন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীরা থাকবেন নজরদারির জন্য।
মৃদু উপসর্গ নিয়ে যাঁরা বাড়িতেই সেরে উঠতে পারেন, তাঁদের কী কর্তব্য— কোন সময় থেকে সতর্ক হতে হবে, পরিবারে কারও সংক্রমণ থাকলে বাকিরা কী ভাবে সাবধান হবেন, মাস্কের যথাযথ ব্যবহার, অক্সিমিটার দেখার যথাযথ পদ্ধতি, অক্সিজেন স্যাচিয়োরেশন কত হলে কী করণীয়— এই কথাগুলি লিফলেট হিসেবে বিলি করা হোক। ফোনের কলার টিউন হিসেবে শোনানো হোক; রেডিয়ো, টিভিতে এই নির্দেশিকা বারে বারে প্রচার করা হোক; টিভিতে সিরিয়াল খবরের নীচে স্ক্রোল করে দেখানো হোক।
পাশাপাশি, অক্সিমিটার, মাস্ক, স্যানিটাইজ়ার, পিপিই কিট, শিল্ড, গ্লাভস, এপ্রন ইত্যাদির দাম ন্যায্য স্তরে বেঁধে দেওয়া হোক। কালোবাজারি বন্ধ করা হোক। এ সম্বন্ধে অভিযোগ জানানোর পদ্ধতি, নম্বর ইত্যাদি গণমাধ্যমগুলিতে প্রচার করা হোক। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের মধ্যে সমন্বয়সাধনের ব্যবস্থা করুক সরকার। তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হোক। প্রতিটি এলাকায় সুলভ ক্যান্টিন হোক, কিন্তু সেখানে লাইনে যেন দূরত্ব বিধি বজায় থাকতে পারে, সেটি দেখা হোক। প্রস্তাব মতো দুয়ারে রেশন যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি চালু হোক— চাল-ডালের সঙ্গে থাক ছোলা, সয়াবিন জাতীয় প্রোটিন। এই রেশনেই আসুক এন ৯৫ বা ত্রিস্তরীয় মাস্ক, স্যানিটাইজ়ার। এবং, অসংগঠিত ক্ষেত্রের জন্য ভাতার ব্যবস্থা হোক। মানুষ খেতে না পেলে এই রোগের সঙ্গে লড়বেন কী করে, শারীরিক বা মানসিক ভাবে?
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy