যদি একটি চিঠি লিখি এই রকম: প্রিয় রাহুল গাঁধী, দিনের পর দিন ভারতীয় গণতন্ত্রের অবয়বটিকে এমন ভাবে তছনছ করা হচ্ছে যে, তা মেরামত করে গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করা কঠিন। দেশে একটি সতেজ বিরোধী শক্তি থাকলে এমনটা হওয়ার কথা নয়। নরেন্দ্র মোদী যদি ভারতের ট্র্যাজেডির একটি দিক হন, তবে অন্যটি হলেন আপনি, আপনার সমস্ত সৌজন্য এবং সদিচ্ছা সত্ত্বেও। আজ যে আধিপত্যবাদের পথে দেশের দ্রুত পতন ঘটছে, তার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছিল মোদী জমানার প্রথম দফাতেই, বিভিন্ন স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানকে পরিকল্পিত ভাবে দুর্বল করে তোলার মধ্য দিয়ে। এই শাসকরা আরও এক বার ক্ষমতায় ফিরলে দেশের কী হাল হতে পারে, আপনাকে সেটা এক বার ভেবে দেখতে বলছি। তেমনটা যদি ঘটে, তার অনেকখানি দায় আপনার উপর বর্তাবে। কারণ, দু’বার ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের পরেও আপনি আপনার দলের— বিজেপিকে বাদ দিয়ে একমাত্র সর্বভারতীয় দলের— শীর্ষপদ ছেড়ে দিতে রাজি হননি। পর পর দু’টি নির্বাচনে ভোটদাতারা যে বিকল্পটিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, তৃতীয় বারেও যদি তাঁদের সামনে ঠিক সেটাই পেশ করা হয়, তবে তাকে আর বিকল্প বলা যায় না, সেটা তাঁদের অপমানের শামিল হয়ে দাঁড়ায়।
পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন আসছে। আপনার দলের উচিত ছিল এক জন পূর্ণ সময়ের নেতা বা নেত্রীর খোঁজ করা। তার বদলে কংগ্রেস নেতৃত্ব স্থির করার কাজটা মুলতুবি রাখল— ভোটের প্রস্তুতির স্বার্থে নয়, এই নির্বাচনগুলিতে দলের অবশ্যম্ভাবী পরাজয়ের লজ্জা থেকে আপনাকে বাঁচাতে! আবারও বোঝা গেল, কংগ্রেসের পরিচালকমণ্ডলীর প্রথম ও প্রধান কর্তব্য আপনাকে রক্ষা করা— নির্বাচনে জয়ী হওয়া নয়। দুনিয়ার সমস্ত পরিণত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেখা যায়, রাজনৈতিক দল ভোটযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাদের নেতা নির্বাচন করে। ভোট আসছে বলে দলনেতা স্থির করার কাজটা স্থগিত রাখা হচ্ছে— এমন সিদ্ধান্ত একমাত্র ভারতের জাতীয় কংগ্রেসই নিতে পারে।
কংগ্রেসের রণকৌশল বলে যদি আদৌ কিছু থাকে, তা হলে সেটা বোধ হয় এই যে, দেশের ভোটদাতারা মোদীকে নিয়ে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়বেন এবং তখন তাঁরা কংগ্রেসের কাছেই ফিরে আসবেন, কারণ আর কোনও সর্বভারতীয় বিকল্প নেই। এবং, অগতির গতি হিসেবে, জনসাধারণের হতাশার ফসল কুড়োবেন আপনি। সত্যিই যদি আপনার এমন ধারণা থাকে, তা হলে বুঝতে হবে আপনি এক মস্ত বিভ্রমের শিকার। এই জ্বলন্ত সত্যটি স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেওয়ার মধ্যে আপনাকে অপমান করার কোনও প্রশ্ন নেই যে— কংগ্রেস দলটিকে যে ভাবে গাঁধী পরিবারের আঁচলে বেঁধে রাখা হয়েছে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে যে ভারতীয়রা আজও ধর্মনিরপেক্ষতার মূল্য দেন, তাঁদের যে ভাবে নাবালক বলে গণ্য করা হয়েছে, সেটা মোদীর পক্ষে এক অসাধারণ উপহার হিসেবে কাজ করেছে। মোদীর পাশাপাশি আপনার জীবনকাহিনি লোকের মনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তা তুলনা করে দেখুন। আপনার দয়ালু এবং সহৃদয় স্বভাবকে আড়াল করে লোকের কাছে বড় হয়ে ওঠে আপনার উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বিশেষ সুযোগ এবং স্বত্বাধিকার। অন্য দিকে, মোদী কী ভাবে সমাজের প্রান্ত থেকে ক্ষমতার কেন্দ্রে উঠে এসেছেন, তার কাহিনি— বাসন-মাজা মা এবং চা-বিক্রি-করা বাবার কাহিনি মানুষের চোখে যে বিরাট মহিমা অর্জন করে, সেটা তাঁর রাজনীতির অশুভ মূর্তিকে ঢেকে দেয়। এই ভাবমূর্তি ২০১৪ সালে তাঁকে সিংহাসনে বসতে বিরাট সাহায্য করেছিল।
তার পর প্রায় ছ’বছরের শাসনপর্বে তাঁর নেতৃত্বে বিজেপি দেশের এমন অনেক অঞ্চলে পা রেখেছে, যেখানে আগে হিন্দুত্ববাদের বিরোধিতা নিয়ে মানুষের গর্ব ছিল। বর্ধিত সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসার এক বছর পরে বিজেপি দলীয় নেতৃত্বে নানা নতুন মুখ নিয়ে আসে। কংগ্রেসে একমাত্র যে নতুন নেত্রীকে আরও সামনে আনার উদ্যোগ হয়, তিনি আপনার বোন। যে নেতৃত্ব পর পর দু’টি নির্বাচনে দলকে ডুবিয়েছে, তার সামর্থ্য সম্পর্কে কেউ বিন্দুমাত্র সংশয় প্রকাশ করলেই তাঁকে একঘরে করা, তাঁর অপমান করা এবং তাঁকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করাই আপনার দলের কর্তৃপক্ষের এক নম্বর কাজ। দলের ভিতরে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের দাবি উঠলে তা দমন করার জন্য ওয়ার্কিং কমিটি আপনার ‘হাত শক্ত করার’ প্রস্তাব নিয়ে বলে: আপনার নেতৃত্ব নাকি ‘ভারতীয়দের একটি প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা’ দিয়েছে! এই বক্তব্যের এক আনাও যদি সত্য হত, তা হলে ভারতে মোদী সরকার হত না। এক দিন যে দল দুনিয়ার মহান রাজনৈতিক দলগুলির অন্যতম বলে গণ্য হত, তার অস্তিত্বের শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি পরিবারের উপাসনা করে চলা এবং তার নিরঙ্কুশ আধিপত্য বজায় রাখা। আপনি দেশকে ভালবাসেন বলে দাবি করেন। সেই দাবি সত্য হলে নিজের দলের এই আত্মঘাতী চাটুকারবৃত্তির কুৎসিত ও করুণ দৃশ্য দেখে আপনার ঘৃণা হওয়া উচিত, এর বিরুদ্ধে অন্তর থেকে বিদ্রোহ করা উচিত। সত্য এই যে, কংগ্রেস নামক দলটি তার মালিকদের ক্ষুদ্রস্বার্থের সেবায় আত্মনিয়োগ করার ফলে বিরোধী দলের প্রকৃত দায়িত্ব পালন করেনি এবং তার পরিণামে দেশের একটি প্রজন্মের বিপুল ক্ষতি হয়ে গিয়েছে।
আপনি বলে থাকেন, মোদী ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে ভারতীয় গণতন্ত্রের উদ্ভব, তাকে একটি পরিবারতন্ত্রের কুক্ষিগত রেখে গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার করা যায় না। ব্রিটিশ লেবার পার্টির এক অত্যন্ত সম্মানিত নেতা সম্প্রতি আমাকে বলেছেন, আপনার দলের নেতৃত্ব দিতে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার রাস্তাটুকুও কারও সামনে খোলা নেই— এটা শেষ বিচারে ‘ভারতে এবং বৃহত্তর পরিসরেও গণতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর’। কংগ্রেসে অন্তত তিন জন নেতার কথা বলা যায়— শশী তারুর, ওয়াই সিদ্দারামাইয়া এবং পি চিদম্বরম— যাঁরা সমর্থ, দক্ষ এবং অভিজ্ঞ, অথচ এ এমনই এক দল যেখানে তাঁদের আগে থেকেই ধরে নিতে হয় যে তাঁদের পদোন্নতি একটা স্তরে গিয়ে আটকে যাবেই, হাজার যোগ্যতা থাকলেও তাঁদের কেউ কেউ ‘অতিথি শিল্পী’ থেকে যাবেন। আপনার দলের এই আনুগত্যের সংস্কৃতি আমাদের গণতন্ত্রকে বিপন্ন করেছে। গণতান্ত্রিক ভারতকে যদি বাঁচতে হয়, তা হলে কংগ্রেসের অতিথি শিল্পীদের নায়কের ভূমিকা পাওয়ার একটা সুযোগ দেওয়া জরুরি— অন্তত একটা অডিশন।
আমাদের দেশের ভবিষ্যৎকে নিরাপদ রাখতে হলে কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতেই হবে, আর সে কাজে আপনি উদ্যোগী না হলে চলবে না। দলকে একের পর এক বিপর্যয়ের গহ্বরে নিয়ে যাওয়ার পরে ভারতের পুনরুদ্ধারের পথিকৃৎ হতে চাইলে আপনার সামনে পথ একটিই— আমাদের জিগমে সিংয়ে ওয়াংচুক হয়ে ওঠা। ভুটানের এই প্রাজ্ঞ এবং দূরদর্শী ভূতপূর্ব শাসক তাঁর রাজকীয় ক্ষমতা ব্যবহার করেই রাজার গুরুত্ব খর্ব করেছিলেন। অনুগত সভাসদরা রাজাকে দেবতা জ্ঞান করতেন, তাঁরা আকুল আপত্তি জানিয়েছিলেন, কিন্তু সেই আপত্তি অগ্রাহ্য করে রাজা দেশে নতুন সংবিধান প্রবর্তন করেছিলেন— যে সংবিধান গণতন্ত্রকে প্রসারিত করে, রাজতন্ত্রের ক্ষমতা খর্ব করে, ৬৫ বছর বয়স হলেই রাজাকে গদি ছাড়তে বলে এবং রাজার ইমপিচমেন্ট-এর অবকাশ তৈরি করে দেয়।
আপনিও নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে কংগ্রেসে নেতা নির্বাচনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার আয়োজন করতে পারেন— একটি সত্যিকারের খোলামেলা, প্রতিযোগিতামূলক, স্বচ্ছ নির্বাচন। যে সংগঠন বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের সূচনা করেছিল, তার পক্ষে তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতাই যথোপযুক্ত হবে। সে জন্য দলের বিধিনিয়মে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনুন। দলের প্রত্যেক নির্বাচিত সদস্য যেন ইচ্ছা করলে নেতৃপদের প্রার্থী হতে পারেন। প্রতি সদস্যের একটি ভোট থাকুক। প্রতি প্রার্থীকে প্রচারের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হোক, প্রয়োজনীয় সাহায্যও। মোসাহেবদের বিতাড়ন করুন। যে পা-চাটা আনুগত্যজীবীরা বাতিল হওয়ার ভয়ে অন্তর্ঘাতের চেষ্টা করবে তাদের হাত থেকে প্রক্রিয়াটিকে নিরাপদ রাখার ব্যবস্থা করুন।
পরের ভোট আসতে তিন বছর বাকি। সেই ভোট নির্ধারণ করে দেবে, আমাদের সাধারণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতাদের চিন্তায় তার যে ধারণা ছিল সেটি বজায় থাকবে, না তার অবসান ঘটবে। এক দিন যে দল একটি বিরাট এবং মহিমময় সংগঠন হিসেবে স্বীকৃত ছিল, তার এখন দায়িত্ব নিজের সংস্কার সাধন করা, নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলা এবং নতুন যুদ্ধের অস্ত্র সংগ্রহ করা, যে যুদ্ধ আমাদের আত্মরক্ষার যুদ্ধ। ভারত কোন দিকে যাবে, তার অনেকটাই নির্ভর করবে কংগ্রেস কী করবে তার উপর, আর কংগ্রেস কী করবে তা নির্ভর করবে আপনি কী করবেন তার উপর। ভারতের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কৃতজ্ঞ চিত্তে আপনাকে স্মরণ করতে পারে এক জন স্বার্থবোধমুক্ত দেশপ্রেমী হিসেবে, যিনি দেশের প্রবীণতম রাজনৈতিক দলটিতে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনে তাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য নিজের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া অধিকারকে ব্যবহার করেছিলেন। অথবা, আপনি হতে পারেন ইতিহাসের তীব্র ভর্ৎসনার পাত্র, যে নিজের উত্তরাধিকার আঁকড়ে থাকার তাড়নায় দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়েছিল এবং তার ফলে ভারতে গণতন্ত্রের অবসান ঘটাতে সাহায্য করেছিল।
ম্যলেভোলেন্ট রিপাবলিক: আ শর্ট হিস্ট্রি অব নিউ ইন্ডিয়া গ্রন্থের লেখক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy