বিকল্প: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাসরুমে পঠনপাঠন আরম্ভ করার দাবিতে রাস্তায় ক্লাস করছেন ছাত্রছাত্রীরা। ১২ অগস্ট, কলকাতা। পিটিআই
অগস্ট মাসের গোড়ার দিকে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, কোভিড পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলে পুজোর পরে স্কুল খোলা হবে। মাসের তৃতীয় সপ্তাহে তিনি আবার, আরও এক বার সেই আশ্বাস দিয়েছেন। পুজো অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে, আশ্বিনের শেষে। কালীপুজো ভাইফোঁটা মিটিয়ে শারদোৎসবের পালা সাঙ্গ হতে হতে মোটামুটি নভেম্বর। তা, কার্ত্তিক মাসে স্কুল খুললেও খুলতে পারে, এই সুসমাচার শ্রাবণ মাসে ঘোষণা করার দরকার কী ছিল? অনুমান করা যায়, সরকার বাহাদুর এই আগাম ঘোষণার মাধ্যমে আসলে রাজ্যবাসীকে জানাতে চাইছেন যে, স্কুল খোলার ব্যাপারে তাঁরা মোটেই উদাসীন নন, এ নিয়ে তাঁদের ভাবনাচিন্তা চলছে। কিন্তু এত দিন যদি সঙ্কেত দেওয়ার প্রয়োজন না হয়ে থাকে, এখনই বা তা হল কেন? আবার অনুমান ভরসা। পশ্চিমবঙ্গে স্কুলের পড়াশোনা ফের চালু করার দাবি গত দু’তিন মাসে ক্রমশ প্রবল হয়েছে। সে-দাবি শেষ পর্যন্ত রাজনীতির ময়দানেও প্রবেশ করেছে, ইতস্তত বিক্ষোভও হয়েছে এই দাবিতে। সম্ভাব্য সংক্রমণের যুক্তি বা অজুহাত দেখিয়ে প্রশাসন সেই সব বিক্ষোভ দমনে তৎপর হয়েছে, যেমনটা প্রশাসনের পরিচিত রীতি। কিন্তু একই সঙ্গে শাসকরা টের পেয়েছেন, এ-বার কিছু একটা করা দরকার। অন্তত কিছু একটা করা হবে, এমন কথা বলা দরকার, যাতে লোকে মনে করে যে তাঁরা ঘুমিয়ে নেই, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন।
অনুমান যদি সত্য হয়, সমাজ এবং রাজনীতির চাপ অনুভব করেই যদি রাজ্যের শাসকরা ছোটদের লেখাপড়া নিয়ে চিন্তাভাবনার আশ্বাস দিয়ে থাকেন, সেটাও তুচ্ছ করার নয়। বস্তুত, পশ্চিমবঙ্গে তার গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। তার প্রথম কারণ এই যে, আমাদের নাগরিক সমাজ শিক্ষাকে তার সত্যমূল্য দেয় না। কথাটাকে আর একটু ভেঙে বলা দরকার। বড় বড় স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি এবং ঐশ্বর্যে আমরা যারপরনাই মুগ্ধ, তার চেয়েও বেশি মুগ্ধ বার্ষিক মেধা-তালিকার তুমুল উদ্যাপনে, অধ্যাপক অমর্ত্য সেন প্রদত্ত ‘ফার্স্ট বয়দের দেশ’ শিরোপাটি এই বঙ্গভূমির ক্ষেত্রে ভয়ানক রকমের সত্য— ইদানীং অবশ্য ‘ফার্স্ট গার্ল’দেরও দেখা যাচ্ছে, তবে তাতে আদিখ্যেতার রূপটা পাল্টায় না। এই আড়ম্বরের পাশাপাশি বিরাজ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছেলেমেয়ের শিক্ষা নিয়ে আমাদের অপার ঔদাসীন্য। তাদের লেখাপড়া কেমন চলছে, আদৌ চলছে কি না, কী করলে আর একটু ভাল চলতে পারে, এ-সব নিয়ে তথাকথিত নাগরিক সমাজের মগজে ও হৃদয়ে আলোড়ন দূরে থাকুক, মৃদু তরঙ্গও ওঠে না। এই নির্মম সত্যটিই অতিমারির কালে ভয়াবহ মূর্তিতে প্রকট হয়েছে। যাঁদের হাতে ক্ষমতা আছে এবং যাঁদের গলায় জোর আছে, সেই বর্গের নাগরিকদের সন্তানরা ‘ডিজিটাল সীমানা’র এ-ধারে এক রকম ভাবে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে, অসুবিধা তাদেরও হচ্ছে, ক্ষতিও কম হচ্ছে না, তবে সেটা অসহনীয় নয়। কিন্তু অধিকাংশ শিশু এবং কিশোরকিশোরী? যারা সীমানার ও-ধারে থাকে? তাদের একটা বিরাট অংশের পড়াশোনা কার্যত শিকেয় উঠেছে, অনেকের ক্ষেত্রেই ভবিষ্যতে তা শিকে থেকে নামার সম্ভাবনাই নেই। একটা গোটা প্রজন্মের সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। আবারও অধ্যাপক সেনের কথায় বলতে হয়, এই নিয়ে আমাদের রাতের ঘুম চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু যায়নি। তার কারণ, ওরা থাকে ও-ধারে।
এখানেই বিশেষ দায় এবং দায়িত্ব ছিল সরকারের। সংখ্যাগরিষ্ঠ ছেলেমেয়ের শিক্ষা যাতে থেমে না যায়, তার আয়োজন করার দায়। নিছক সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে নয়, তারা সুযোগবঞ্চিত বলে, তাদের নিজস্ব সামর্থ্য ও সক্ষমতার অভাব আছে বলে। অথচ, দুঃখের কথা, ক্ষোভেরও কথা— কী করে এই সর্বনাশের কবল থেকে ছেলেমেয়েদের বাঁচানো যায় তা নিয়ে শাসকদের কোনও যথার্থ উদ্যোগ বা আগ্রহ আমরা দেখিনি। যে কোনও ভাবে পরীক্ষার একটা ফল প্রকাশ করে দেওয়া এবং ভর্তির ব্যবস্থা করা সেই আগ্রহের প্রমাণ হতে পারে না। স্কুল খোলা নিয়ে তাঁদের অতিসতর্কতাকে এক কথায় ঠিক বা ভুল বলে দেওয়ার উপায় নেই, সংক্রমণের আশঙ্কা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যথেষ্ট রক্ষাকবচ বজায় রেখে, প্রয়োজনে বিভিন্ন সরকারি ভবন, ক্লাবঘর বা অন্য জায়গা কাজে লাগিয়ে স্কুলের পড়াশোনা অন্তত কিছুটা চালু রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করার দরকার ছিল।
এবং, প্রশ্নটা নিছক স্কুল খোলার বা না-খোলার নয়। নানা বিকল্প উদ্যোগে কী ভাবে লেখাপড়াটা যথাসম্ভব চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সে জন্য নানা দিক থেকে পরিকল্পনা করা জরুরি ছিল, জরুরি ছিল সমাজের বিভিন্ন স্তরে সেই পরিকল্পনা রূপায়ণের। সেই সব উদ্যোগ আকাশ থেকে পড়ত না, সে জন্য একটা সত্যিকারের যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সামাজিক আলোচনা আবশ্যক ছিল, যে আলোচনা অনেক পথ বলে দিতে পারত, যে আলোচনা গড়ে তোলার জন্য এবং তার থেকে উঠে আসা পরামর্শগুলিকে কাজে লাগিয়ে লেখাপড়া চালু রাখার জন্য সরকার তার সমস্ত সামর্থ্য নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারত। কিন্তু সে-সবের কিছুই হয়নি। তার ফলে যে ক্ষতি ইতিমধ্যেই ঘটেছে, তার খতিয়ান কষবে ভবিষ্যৎ। সেই খতিয়ান কেবল কলঙ্কের নয়, বিভীষিকার।
আজ যদি চাপে পড়েও সরকারি আচরণে একটু নড়েচড়ে বসার লক্ষণ দেখা যায়, তবে সেই চাপটা যথাসম্ভব বাড়িয়ে চলাই সমাজের কাজ। কিন্তু শাসকদের দিক থেকেও একটা প্রাথমিক কর্তব্য আছে। ক্ষমতার শিখর থেকে সব কিছু ঠিক করে দেওয়ার অভ্যাস তাঁদের ছাড়া দরকার, অন্তত কিছুটা কমানো দরকার। এটা সব বিষয়েই সত্য, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে স্কুলশিক্ষার ক্ষেত্রে বোধ করি সব থেকে বেশি সত্য। তার সহজ কারণ হল, অতিমারির কালে রাজ্যের সর্বত্র একই ভাবে শিক্ষার আয়োজন করা সম্ভব নয়। সংক্রমণের মাত্রায় তারতম্য আছে, স্কুলের পরিকাঠামো সর্বত্র এক নয়, স্কুলে বা স্কুলের বাইরে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে পঠনপাঠনের ব্যবস্থা এক-এক জায়গায় এক-এক ভাবে করতে হবে, শিক্ষকের সংখ্যা ও দক্ষতায় কমবেশি আছে, বিভিন্ন এলাকায় স্কুলশিক্ষক ছাড়াও অন্যান্য শিক্ষাব্রতী বা স্বেচ্ছাসেবীদের সহযোগিতা নেওয়ার বিভিন্ন সুযোগ থাকতে পারে, ছাত্রছাত্রীদের আর্থিক অবস্থা এবং পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশেও বৈচিত্র বিস্তর। অনন্ত আগ্রহ এবং সদিচ্ছা থাকলেও মর্তলোকের (বা দেবলোকের) কোনও নায়ক বা নায়িকার পক্ষে এই সমস্ত বিভিন্নতার হিসেব কষে শিক্ষা একটা ‘মাস্টার প্ল্যান’ করে দেওয়া সম্ভব নয়।
তার কোনও প্রয়োজনও নেই। বরং এই অভূতপূর্ব দুর্যোগ যথার্থ বিকেন্দ্রীকরণের একটা মস্ত সুযোগ এনে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের স্কুলশিক্ষকদের নিয়ে অনেক অভিযোগ, অনেক সমালোচনা। তার কারণও নিশ্চয়ই আছে, যেমন সমস্ত বৃত্তিতেই থাকে। কিন্তু তার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল এই সত্য যে, রাজ্যের বহু এলাকায় বহু শিক্ষক প্রচণ্ড কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে অস্বাভাবিক পরিশ্রম করে এবং উদ্ভাবনী শক্তি ও সহমর্মিতা সম্বল করে ছেলেমেয়েদের শিক্ষাকে যে ভাবে পারেন যতটা পারেন এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছেন, অন্তত তারা যাতে যা শিখেছে সেটাও ভুলে না যায় সে জন্য প্রাণপাত করছেন। তাঁদের অনেকের কথা আমরা গত এক বছরে পড়েছি, শুনেছি, জেনেছি। তার পাশাপাশি, যে নাগরিক সমাজের সামগ্রিক ঔদাসীন্যের কথা অনেক বেদনার সঙ্গে বলেছি, সেখানেও ব্যতিক্রমী মানুষ বিরল নন। তাঁরা কেবল শিক্ষার এই সঙ্কট নিয়ে আক্ষরিক অর্থে ছটফট করছেন না, তার মোকাবিলার উপায় খুঁজছেন, অত্যন্ত মূল্যবান পরামর্শ দিচ্ছেন এবং যে কোনও প্রয়োজনে যে কোনও ভাবে সাহায্যের স্বতঃপ্রণোদিত অঙ্গীকার করছেন। বিশ্ববিশ্রুত অধ্যাপক বারংবার বলছেন, তিনি সর্বতোভাবে এই কাজে সাহায্য করতে আগ্রহী। বিরাট সুযোগ ছিল সামাজিক আগ্রহ এবং উদ্যমের এই সংসাধনকে কাজে লাগিয়ে একটা সত্যিকারের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার। দল, মত, গোষ্ঠী এবং অন্য তেত্রিশ কোটি বিভাজনরেখাকে ‘নেই’ করে দিয়ে সে-কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া যেত। পশ্চিমবঙ্গ গোটা দেশের কাছে, গোটা দুনিয়ার কাছে একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকত। সেই সামাজিক উদ্যোগকে সম্ভব করে তোলার জন্য, তাকে গতি দেওয়ার জন্য সরকারকে কেবল তার পাশে দাঁড়িয়ে বলতে হত: আপনারা যে ভাবে সম্ভব কাজ করুন, আমরা সাহায্য করব, সমস্যা হলে মোকাবিলা করব।
কাল্পনিক? অসম্ভব? আপাতদৃষ্টিতে তা-ই। কিন্তু কল্পনাকে সত্য করে তোলা যায়। সেটা করতে গেলে সর্বাগ্রে শাসকদের বিশ্বাস করতে হবে যে, ক্ষমতা এবং অধিকার ভাগ করে দিতে পারলে সমাজের অন্তর্নিহিত শক্তিকে কাজে লাগানো যায়, যে শক্তি অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পারে। সেটাই একটি গণতান্ত্রিক সরকারের চালকদের প্রকৃত আত্মবিশ্বাস। ‘আমরা সব জানি’ মার্কা অহঙ্কার থেকে তার স্থান অনেক দূরে, অন্য লোকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy