নাম প্রজ্ঞা দেবনাথ। বাড়ি হুগলির ধনেখালিতে। নিরুদ্দেশ ২০০৯ থেকে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশে গ্রেফতার হল প্রজ্ঞা। তত দিনে সে আয়েশা জান্নাত মোহনা— জেএমবি মহিলা শাখার প্রধান আসমানি খাতুনের ডান হাত। বাংলাদেশ তথা পশ্চিমবঙ্গে আইএস-এর প্রধান রিক্রুটার মেহেদি মাসরুর বিশ্বাস। বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার গোপালপুরে। পরিশ্রমী এবং মেধাবী ছাত্র। নিতান্তই গোবেচারা। ২০১৪ সালে বেঙ্গালুরু থেকে গ্রেফতার। ভারতে আইসিস-এর অন্যতম প্রধান টুইটার হ্যান্ডলার। সাইফুল্লাহ ওজাকি অথবা আবু ইব্রাহিম অল হানিফ যে নামেই ডাকুন না কেন, পিছনে রয়েছে সুজিতচন্দ্র দেবনাথ, পিতা জনার্দনচন্দ্র দেবনাথ। স্মার্ট, অর্থনীতির ছাত্র, ক্রমে হয়ে গেল আইএস-এর তরফ থেকে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত আমির বা প্রধান কর্তা। এদের সবার দুটো জায়গায় মিল— এক, সবাই আইএস-এর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিল; এবং দুই, সবাই আপাতনিরীহ, এবং মেধাবী। কেউ টেরও পাননি, ছেলেমেয়েগুলো কখন পা বাড়াল জেহাদের অন্ধকার পথে।
আইএস-এর আমির থাকাকালীন এই সুজিতচন্দ্র দেবনাথ বা আবু ইব্রাহিম আল হানিফ কয়েক বছর আগে আইএস-এর মুখপত্র দাবিক-এ একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিল, বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ তাদের কার্যক্রমের জন্য ঠিক কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। বলেছিল, ইরান-ইরাক-আফগানিস্তান-পাকিস্তান হয়ে ভারত-বাংলাদেশ জুড়ে যে বিশাল খিলাফতি শাসন প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন নিয়ে এগোচ্ছে আইএস, তার পথে ভারত সবচেয়ে বড় বাধা। ভারতকে পশ্চিম প্রান্তে পাকিস্তান-আফগানিস্তান, আর পূর্ব প্রান্তে বাংলাদেশ থেকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে হবে। আর তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে বাংলাতে ছড়িয়ে থাকা মুজাহিদরা।
এই ভয়াবহ বিপদের হাত থেকে কী ভাবে রক্ষা করব নিজের পরিবারকে, নিজের দেশকে? পেশাগত সূত্রে জেহাদি সংগঠনগুলোর কাজকর্ম সম্বন্ধে বিস্তারিত খবর রাখতে হত। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমি বিশ্বাস করি যে, এটা একটা অসুখ। আমাদের অসুখের চিকিৎসা করতে হবে; অসুখকে নিশ্চিহ্ন এবং নির্মূল করতে হবে— অসুস্থকে নয়। শুধু আসুরিক চিকিৎসার চেষ্টা যদি চলতে থাকে, তাতে হিতে বিপরীত হওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা আছে, থাকবে।
একটা সাধারণ ছেলে বা মেয়ে কেন বেছে নেয় চরমপন্থী মৌলবাদের পথ? তার একাধিক কারণ আছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, মানসিক, ঐতিহাসিক বা মতাদর্শগত কারণে সংঘর্ষ বা সংঘাত অনেক সময় চরম সীমায় পৌঁছে কিছু মানুষকে চরমপন্থী পথ বেছে নিতে উস্কানি দেয়। এমনও দেখা গিয়েছে যে, যখন কোনও ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠী কোনও কারণে অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত বা কোণঠাসা হয়ে পড়ে, একটা সময় সেই জনগোষ্ঠীর এক অংশ সশস্ত্র বা অত্যন্ত হিংসাত্মক প্রতিরোধকেই প্রতিবাদের একমাত্র পথ হিসেবে বেছে নেয়।
এই পুরো ব্যাপারটা কিন্তু এক দিনে হয় না। ধীরে ধীরে একটা অত্যন্ত সুশৃঙ্খল প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে চরমপন্থী মৌলবাদের দীক্ষা হয়। এই প্রক্রিয়ার মূলত চারটি ভাগ রয়েছে— মৌলবাদের বা চরমপন্থার প্রতি প্রাথমিক আকর্ষণ; নিজসত্তার অনুসন্ধান; নিজেকে উদ্বুদ্ধকরণ; এবং শেষে জেহাদে দীক্ষা নেওয়া। এই চারটে প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই যেতে হয় এক জন চরমপন্থী মৌলবাদীকে। অভিজ্ঞতা আর গবেষণা একই কথা বলছে— যখন কেউ এই চারটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাবে, বিশেষ করে কোনও তরুণ-তরুণী, তার আচার ব্যবহারে নিশ্চিত ভাবেই কতকগুলো পরিবর্তন নজরে আসবে। এই সমস্ত তরুণ-তরুণী নিজের বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করবে; যখনই কথাবার্তা বলবে, এমনকি সাধারণ আলাপ-আলোচনার মধ্যেও, মনে হবে যেন শেখানো কথা বলছে; হঠাৎ করে অন্যদের সম্পর্কে বা অন্য ধর্ম সম্পর্কে একটা প্রচণ্ড বিদ্বেষ বা ঘৃণা জন্মাবে। এবং, মোবাইল ব্যবহারের সময় অথবা কম্পিউটার, ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় এরা অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করতে চাইবে। নেহাত চোখ বন্ধ করে না থাকলে এতগুলো পরিবর্তন চোখে পড়বেই।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে যখন কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ প্রচণ্ড ভাবে বেড়ে যায়, তখন দেশের তৎকালীন সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে, কাশ্মীরের পুলিশ এমনকি কিছু ক্ষেত্রে আধা সামরিক বা সামরিক বাহিনীও এই ধরনের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট প্রশিক্ষিত বা দক্ষ নয়। সেই ভাবনা থেকেই গড়ে ওঠে ‘রাষ্ট্রীয় রাইফেলস’। সামরিক বাহিনী এবং অন্যান্য জায়গা থেকে বেছে নেওয়া হয় বাহিনীর সদস্যদের। তাঁদের অত্যন্ত গভীর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় শুধুমাত্র সন্ত্রাসদমনের কাজের জন্য। তার ফলাফল কিন্তু অচিরেই দেখা যেতে শুরু করে। গত দুই দশক ধরে কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ দমনে রাষ্ট্রীয় রাইফেলস অসামান্য ভূমিকা নিয়েছে।
খাগড়াগড়ের মতো দু’একটা ছুটকোছাটকা ঘটনা ছাড়া বাংলা যে হেতু এখনও তেমন কোনও বড় মাপের নাশকতামূলক কাজ বা সন্ত্রাসবাদের সম্মুখীন হয়নি, বাংলার পুলিশ এখনও তৈরি হয়নি সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলা করার জন্য, বিশেষ করে রাজ্য পুলিশ এবং জেলা পুলিশ। কোনও সন্দেহ নেই যে, কলকাতা পুলিশ, তাদের এসটিএফ, বা রাজ্য পুলিশের এসটিএফ যথেষ্ট ভাল কাজ করছে। কিন্তু তাদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পুরো রাজ্য জুড়ে কাজ করার পরিকাঠামো এই মুহূর্তে তাদের নেই।
এই ধরনের বিপদের সঙ্গে লড়তে গেলে জরুরি একেবারে নিচুস্তরের গোয়েন্দা বিভাগকে সক্রিয় করে তোলা, যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া। সেটাতে খামতি থেকে যাচ্ছে। সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলা করতে গেলে কেন্দ্র এবং রাজ্যের দুটো সরকারকেই যৌথ ভাবে কাজ করতে হবে। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস অত্যন্ত জরুরি, বিশেষত যেখানে সন্ত্রাসবাদ দমনের প্রশ্নটি জড়িয়ে রয়েছে। রাজ্য সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ যেমন তার সীমিত পরিকাঠামো নিয়ে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের চক্রকে ভাঙতে পারবে না, ঠিক তেমনই কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলোও রাজ্যের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে স্থানীয় গোয়েন্দা বাহিনীর সাহায্য ছাড়া কোনও রকম খবর সংগ্রহ করতে পারবে না।
এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের যেটা সবচেয়ে জরুরি, তা হল, প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে সর্বনিম্ন স্তর অবধি মৌলিক ভাবনাচিন্তার আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা সব থেকে আগে।
প্রাক্তন ডেপুটি কমান্ড্যান্ট, এনএসজি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy