অধিকার: বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন শহিদদের স্মরণে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অন্নদাশঙ্কর রায় প্রমুখ, কলকাতা, ২৬ মে ১৯৯৮। —ফাইল চিত্র।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিনটি অনেক লিটল ম্যাগাজ়িনের কবি-লেখক মিলে পালন করলেন। অনেকে তাঁর নামে পুরস্কার দিলেন। তাঁর নামে কবিসম্মেলন হল, নাটক
হল। এক জন লেখকের পক্ষে সবচেয়ে বড় লড়াই হয়তো মৃত্যুর পরে বেঁচে থাকা। অনেক কবি মৃত্যুর পরে সবচেয়ে বড় পুরস্কার পান, যেমন জীবনানন্দ দাশ। ইংল্যান্ডে জন ডান, চারশো বছরের ভস্ম থেকে তাঁকে তুলে এনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এলিয়ট, এলিজ়াবেথান কবিতার ‘চিনি’ থেকে ব্রিটিশ কবিতাকে বাঁচিয়েছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তা নন, জীবদ্দশায় বিখ্যাত। ভারতবিখ্যাত বাঙালি লেখক আমাদের সময়ে আমরা খুব একটা দেখিনি: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং শঙ্খ ঘোষ। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বড় লেখক, কিন্তু তিনি অন্তর্মুখী, ভারতমুখী নন, হিল্লিদিল্লি তাঁর দূর অস্ত্। তিনি নিজেও বলেন, “সুনীল আর আমি পাশাপাশি বসে কত বছর চাকরি করেছি, হাসিঠাট্টা করেছি কত, কিন্তু দু’জনে দুই মেরু।”
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের পরে দ্বিতীয় বাঙালি সুনীল যিনি সাহিত্য অকাদেমির সভাপতি হয়েছিলেন। তৃতীয় কেউ হবেন, অদূর ভবিষ্যতে তার কোনও চিহ্ন দেখি না। শুধু সাহিত্য-যশ দিয়ে হবে না, সাহিত্য-ভোটেও পারদর্শী হতে হবে। সাহিত্য অকাদেমি একটি মান্য প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান এক জন লেখককে মঞ্চ দিতে পারে, প্রচার দিতে পারে, লেখক করে দিতে পারে না। লেখক যদি মঞ্চে উঠে মাইক ব্যবহার করতে না পারেন সে দোষ লেখকের। সুনীল প্রতিষ্ঠানকে মর্যাদা দিয়ে নিজেকে এক জন ‘প্যান-ইন্ডিয়ান’ লেখক হিসাবে ভারতে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। সুনীতিবাবুদের সময়ে বুদ্ধদেব বসু-সুভাষ মুখোপাধ্যায়দের হাত ধরে বোদল্যেয়র, রিলকে, নেরুদা কলকাতায় প্রথম ঢুকতেন, তার পর তাঁরা ভারতে ঢুকতেন। এখনকার নেরুদারা কালিকট দিয়ে ঢোকে। কলকাতাই তখন ছিল ভারতের ‘ইন্টেলেকচুয়াল গেটওয়ে’। এখন কলকাতা থেকে এক জন অমিতাভ ঘোষ উঠে আসেন, কিন্তু তিনি তো গ্লোবাল লেখক। ইসরো-র ‘প্রজ্ঞান’-এর পিছনে এত বাঙালি বিজ্ঞানী, তাঁরা আমাদের গর্ব। কিন্তু আজ আমাদের এক জন সত্যেন বসু দরকার।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চলে গেছেন বারো বছর হল। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে ইউ আর অনন্তমূর্তি এক সাক্ষাৎকারে (ভাষানগর পত্রিকায় প্রকাশিত) বলেছিলেন, “বেঙ্গল’স সুপ্রিমেসি ইজ় ওভার’’। অর্থাৎ মেধায় মননে সাহিত্যে বাঙালি যে চূড়া স্পর্শ করেছিল তা আর নেই। বাঙালির নবজাগরণ যেমন গোটা দেশকে আলো দেখিয়েছিল তার উচ্চপ্রশংসা করে বাঙালির ‘সৃজন উচ্চতা হ্রাস’ নিয়ে দুঃখ করেছিলেন অনন্তমূর্তি। সুনীলদাকে গিয়ে বললাম সংস্কার-এর লেখকের আক্ষেপের কথা। সুনীলদা চুপ করে শুনলেন, একটু ভাবলেন, তার পর হালকা সুরে বললেন, “কর্নাটকের নাটক ফিল্ম ভাল হচ্ছে, অনন্তমূর্তি নিজে এক জন বড় লেখক, তার মানে এই নয় যে কন্নড় সাহিত্য বাংলা সাহিত্যের জায়গা নিয়ে নিয়েছে।”
তখন সুনীলদা বাংলা ভাষা নিয়ে, বাংলা ভাষার দাবি নিয়ে তেড়েফুঁড়ে রাস্তায় নামছেন প্রতি দিন। রাস্তায় কেন বাংলা অক্ষর দেখা যাবে না? হোর্ডিংগুলোতে কেন বাংলা থাকবে না? হিন্দি-ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকেও রাখতে হবে। এক দিন কার্জ়ন পার্কে দাঁড়িয়ে প্রেস মিট করে আমাদের নিয়ে মিছিল করে হাঁটতে লাগলেন। রাস্তায় সবাই জানতে চাইছে, এটা কাদের মিছিল? সুনীলদা বললেন, এটা ভাষা-মিছিল। হাঁটতে হাঁটতে মিছিল এসে দাঁড়াল গ্র্যান্ড হোটেলের সামনে। সভাপতি বললেন, এ বার আমরা গ্র্যান্ড হোটেলে গিয়ে দাঁড়াব। পিছন থেকে আর এক কৃত্তিবাসী লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় স্বভাবসিদ্ধ চুটকি কাটলেন, “মিছিল সবাই কাকদ্বীপ ডায়মন্ড হারবার দিয়ে শুরু করে, সুনীলের শুরু গ্র্যান্ড হোটেল দিয়ে।” গ্র্যান্ড হোটেলের জিএম, অত্যন্ত সুভদ্র এক পঞ্জাবি সন্তান, তিনি ছুটে এলেন সুনীলদাকে দেখে, করজোড়ে বললেন, “বলুন আমরা কী করতে পারি?” সুনীলদা চিরকাল লাজুক ও বিনীত, কিন্তু ভিতরে একটা বেজি আছে, খুব সুন্দর করে বললেন, “আপনাদের ঢোকার মুখে যেখানে ইংরেজিতে গ্র্যান্ড হোটেল লেখা সেখানে যদি বাংলাতেও লেখেন, আমরা খুশি হব।” পঞ্জাবি ভদ্রলোক বললেন, “কেউ আমাদের আগে এ কথা বলেনি, অতি সুপ্রস্তাব, আমরা কালকেই করে দেব।” ফেরার সময় সন্দীপনদা বললেন, “যাঃ, কোনও উত্তেজনা হল না, হাতাহাতি হল না, সুনীল গান্ধীর স্টাইলে বিপ্লব করে দিল।”
এখন কি আর কোনও লেখক আছেন যিনি বাংলা ভাষার জন্য রাস্তায় নামতে পারেন? সুনীলের সঙ্গে তখনকার মুখ্যমন্ত্রী মাননীয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের খুবই বন্ধুত্ব ছিল। নন্দনে নিয়মিত দেখা হত দু’জনের। তবু তিনি দাবি করেছিলেন স্কুলে ও সব সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বাংলা চালু করতে হবে। এমনকি লাতিন আমেরিকার স্টাইলে ভাষা-পুলিশ রাখতে হবে যারা বাংলা লেখা হচ্ছে কি না তার নজরদারি করবে। এর পর যা হওয়ার তা-ই হল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম সুনীল বঙ্গোপাধ্যায় বলে চালাতে লাগলেন এক শ্রেণির এলিট বাঙালি যাঁরা বাঙালির ভাষা-সাহিত্য নিয়ে কোনও ভালও দেখেন না, মন্দও দেখেন না।
আজ পর্যন্ত বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষার মান্যতা দিতে পারেনি কেন্দ্রীয় সরকার। এ পাশে ওড়িশা, তারাও ওড়িয়ার জন্য পেতে পারে, ও পাশে অসম, তারাও পেয়েছে ধ্রুপদী মর্যাদা, আমরা পাব না কেন? চর্যাপদ-এর অনেক আগে থেকে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব ছিল, না হলে রাতারাতি অত উন্নত কাব্য রচনা সম্ভব হত না। এক দিনে চর্যাপদ লেখা হয়নি, তার আগে একশো-দু’শো বছরের উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস থাকতে বাধ্য। ধ্রুপদী মর্যাদা ছিনিয়ে আনতে আন্দোলন দরকার, রাস্তায় নামা, কাগজে-কলমে বাংলার দেড় হাজার বছরের ইতিহাস তুলে ধরা দরকার। ভারতের কোনও ভাষায় যা নেই বাংলায় তা আছে— রবীন্দ্রনাথ। ২৭-২৮ কোটি লোক বাংলা বলতে পারে। রাস্তায় নামবে কে? আর এক জন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় দরকার। কে এনে দেবে?
বাঙালি এখন যে সময়খণ্ডের ভিতর দিয়ে চলেছে তাকে আমেরিকান পরিভাষায় বলা যায় ‘ফল’। পাতা ঝরার সময়। হেমন্তের অরণ্যে বাঙালি এখন পোস্টম্যান হতেও ভুলে গেছে, কেননা তার হাতে হাতে এখন ফেসবুক। বাঙালির এখন একটাই কাজ— ট্রোল করা এবং ট্রোলড হওয়া। বাংলা ভাষা ধ্রুপদী হল কি না তাতে কার কী! ডিএ পাচ্ছি কি না সেটাই হল ধ্রুপদী চর্চা। মাঝেমধ্যে র্যাগিং নিয়ে মণিপুর নিয়ে হরিয়ানার নুহ নিয়ে বলব, তা হলেই ধ্রুপদী থাকা যাবে।
সর্বভারতীয় স্তরে বলার মতো কোনও বাঙালি লেখক নেই আজ। আগামী ত্রিশ বছরেও দেখা যাবে কি না সন্দেহ। বিদ্যাচর্চা, মননচর্চা, সাহিত্য— এগুলো রাতারাতি আকাশ থেকে ঝরে পড়ে না। রাতারাতি এক জন ক্রিকেটার বা ফিল্ম স্টার উঠে আসতে পারে, উঠে আসতে পারে এমনকি এক জন ‘ওয়ান বুক ওয়ান্ডার’ লেখকও, কিন্তু এক জন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পিছনে থাকে ত্রিশ চল্লিশ পঞ্চাশ বছরের শ্রম, প্রতিভা ও সাধনা। আবার এই তিনটে থাকলেই হয় না। তার পরও একটা জিনিস লাগে। ‘সা’ । ত্রিশ বছর ধরে প্রতি দিন আট ঘণ্টা প্র্যাকটিস করেও বহু গায়ক, বহু লেখক ‘সা’ লাগাতে পারেন না। ‘সা’ সবার কাছে আসে না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে এসেছিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy