—প্রতীকী চিত্র।
অর্থনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হল ব্যবসার মালিকানা। এই মালিকানা কার দখলে, তা অনেক ক্ষেত্রেই নির্ধারণ করে যে, দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি কাদের জন্য বেশি লাভজনক। তাই ব্যবসার মালিকানা যে কোনও সামাজিক গোষ্ঠীর উল্লম্ব গতিশীলতার অন্যতম উপায়, বিশেষ করে প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীগুলির জন্য, যাদের অধিকাংশই ঐতিহাসিক ভাবে ভূমিহীন এবং সম্পদ থেকে বঞ্চিত। আমাদের দেশের অর্থনীতিতে ব্যবসার মালিকানায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব ঠিক কতটা, এবং ১৯৯০-এর উদারনীতি-পরবর্তী সময়ে তা কী ভাবেই বা বদলেছে? সদ্য প্রকাশিত আজ়িম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বছরের স্টেট অব ওয়ার্কিং ইন্ডিয়া প্রতিবেদনে এ বিষয়গুলি নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ রয়েছে।
ভারতের প্রান্তিক জাতিগুলির ব্যবসার মালিকানায় প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি নিয়ে চর্চা শুরু হয় মূলত একবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে। ২০০২ সালের জানুয়ারিতে মধ্যপ্রদেশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দলিত বুদ্ধিজীবী এবং কর্মীদের সম্মেলনে যে ভোপাল ঘোষণাপত্রটি গৃহীত হয়েছিল, তার মূল দাবি ছিল জমির পুনর্বণ্টন এবং পুঁজির গণতন্ত্রীকরণ, যাতে দলিত সম্প্রদায় দেশের সম্পদে তার ন্যায্য অংশ দাবি করতে সক্ষম হয়। এর পরেই ২০০৫ সালের এপ্রিলে প্রতিষ্ঠিত হয় দলিত ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিআইসিসিআই)।
কিন্তু দলিত সম্প্রদায় ব্যবসায়িক মালিকানা থেকে সত্যিই কতটা বঞ্চিত? তথ্য কী বলছে? এর মাপকাঠি হিসাবে আমরা সর্বশেষ প্রকাশিত ২০১৩-র ‘ইকনমিক সেন্সাস’ থেকে ব্যক্তিগত মালিকানার তথ্যের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জন্য একটি মালিকানার প্রতিনিধিত্ব সূচক তৈরি করি। এই সূচকের সাহায্যে বোঝা যায় জাতি-ভিত্তিক বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত মালিকানায় প্রতিনিধিত্ব আনুপাতিক ভাবে কতটা। এখানে বলে রাখা দরকার, ইকনমিক সেন্সাসে ব্যক্তিগত মালিকানার ব্যবসা বলতে এমন সব ব্যবসাকে বোঝায় যার মালিক এক জন ব্যক্তি, এবং তাই মালিক কোন সামাজিক জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্গত তা পরিষ্কার ভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব। অর্থাৎ, অংশীদারি ব্যবসা বা প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি এর আওতায় পড়ে না।
এই সূচকটি আসলে কী? এটি হল আমাদের দেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মোট ব্যক্তিগত মালিকানা এবং মোট কর্মরত মানুষের ভাগের অনুপাত। অর্থাৎ, মোট কর্মরত মানুষের মধ্যে যদি ২০ শতাংশ মানুষ কোনও এক জাতির হন, এবং মোট ব্যক্তিগত ব্যবসার মালিকদের মধ্যে সেই জাতির মালিকদের ভাগ যদি ১০ শতাংশ হয়, তা হলে মালিকানার প্রতিনিধিত্ব সূচকের মান হবে ০.৫ (১০/২০)। কোনও জাতিগোষ্ঠীর জন্য সূচকের মান ১-এর কম হলে বলা যায় যে সেই জাতিগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত মালিকানায় প্রতিনিধিত্ব আনুপাতিক ভাবে কম এবং ১-এর বেশি হলে, তাদের মালিকানায় প্রতিনিধিত্ব আনুপাতিক ভাবে বেশি। ব্যক্তিগত মালিকানায় কোনও জাতি-ভিত্তিক পক্ষপাত না থাকলে, সূচকের মান হওয়া উচিত ১।
এই সূচক থেকে দেখা যাচ্ছে তফসিলি জাতি-জনজাতিগুলির ব্যক্তিগত মালিকানায় ভাগ গড়ে মোট কর্মরত মানুষের মধ্যে তাদের ভাগের অনেক কম। ভারতের মোট কর্মরত মানুষের মধ্যে তফসিলি জাতির ভাগ ১৯.৩ শতাংশ কিন্তু মোট ব্যক্তিগত মালিকানায় তাদের ভাগ মাত্র ১১.৪ শতাংশ। অর্থাৎ, সূচকের মান ০.৬। উচ্চবর্ণের মালিকদের ক্ষেত্রে সূচকের মান গড়ে ১-এর বেশি (১.৫৫) এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির (ওবিসি) মালিকদের ক্ষেত্রে তা প্রায় ১-এর কাছাকাছি (০.৯৯)।
কিন্তু মালিকানারও আবার ভাগ আছে। ‘ওন অ্যাকাউন্ট এন্টারপ্রাইজ়েস’ অর্থাৎ কোনও শ্রমিক নিয়োগ না করেই এক জন কর্মীর যে ব্যবসা চলে, এমন ব্যবসায় মালিক-শ্রমিক পার্থক্য করা মুশকিল। তেমনই অনেক ছোট ব্যবসা চলে মূলত বিনা মজুরির পারিবারিক শ্রমের ভিত্তিতে। অনেক ক্ষেত্রেই এই ধরনের ক্ষুদ্র বা ছোট ব্যবসাগুলি জীবিকা-ভিত্তিক (যেমন মুচি, হকার, ঠেলাওয়ালা)। এগুলি মজুরি শ্রমিক নিয়োগ করা অপেক্ষাকৃত বড় পুঁজিবাদী ব্যবসার থেকে মৌলিক ভাবে আলাদা। অর্থাৎ, ব্যবসা যত বড়, অর্থনৈতিক ক্ষমতা তত বেশি। কোন ব্যবসা কত কর্মী নিয়োগ করে তা যদি ব্যবসার আয়তনের মাপকাঠি হিসাবে ধরা হয়, তা হলে তফসিলি জাতি-জনজাতিগুলির মালিকানায় প্রতিনিধিত্ব, এক জন কর্মী নিয়োজিত ক্ষুদ্রতম ব্যবসা থেকে ২০ জনের বেশি কর্মী নিয়োগ করা বড় ব্যবসা, সবেতেই অনেক কম। তবে ব্যবসার আয়তন যত বাড়তে থাকে, প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীগুলির প্রতিনিধিত্ব ক্রমাগত কমতে থাকে। ১১ জনের বেশি কর্মী-নিয়োগ করা ব্যবসায় (যার মধ্যে অনেক ব্যবসাই সংগঠিত ক্ষেত্রের আওতায় পড়ার কথা), তফসিলি জাতি-জনজাতির মালিকদের প্রতিনিধিত্ব সূচকের মান ০.৫-এরও কম। অর্থাৎ, বড় ব্যবসায় প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর মালিকানাস্বত্ব খুব কম।
অন্য দিকে, উচ্চবর্ণের মালিকদের ক্ষেত্রে সূচকের মান সব আয়তনের ব্যবসাতেই ১-এর বেশি। শুধু তা-ই নয়, ব্যবসার আয়তন যত বৃদ্ধি পায়, মালিকানায় উচ্চবর্ণের প্রতিনিধিত্বও ততই বাড়ে। ১৫ বা ততোধিক কর্মী নিয়োগকারী ব্যবসায় উচ্চবর্ণের মালিকদের সূচকের মান ২-এরও বেশি।
অর্থাৎ ব্যক্তিগত মালিকানার ব্যবসায় যে জাতি-ভিত্তিক বৈষম্য আছে, তা পরিষ্কার। কিন্তু এই বৈষম্য বিগত কয়েক দশকের পরিপ্রেক্ষিতে বেড়েছে, না কমেছে? ২০০৫ এবং ১৯৯৮-এর তথ্য ব্যবহার করে একই রকম প্রতিনিধিত্ব সূচক তৈরি করে দেখা যাচ্ছে, তফসিলি জাতি-জনজাতির মালিকদের ঘাটতি বরাবরই যথেষ্ট, তবে ১৯৯৮ থেকে, এবং বিশেষ করে ২০০৫ এবং ২০১৩-এর মধ্যে তফসিলি জাতিগুলির ব্যক্তিগত ব্যবসায় মালিকানার প্রতিনিধিত্ব কিছুটা বেড়েছে।
কিন্তু তফসিলি জাতির মালিকদের প্রতিনিধিত্বের এই বৃদ্ধির ফলে উচ্চবর্ণের মালিকদের অত্যধিক প্রতিনিধিত্ব একেবারেই হ্রাস পায়নি। না হলে বলা যেত যে মালিকানায় জাতি-ভিত্তিক বৈষম্য সময়ের সঙ্গে কমছে। বরং, উচ্চবর্ণের মালিকদের অত্যধিক প্রতিনিধিত্ব, বিশেষ করে বড় আয়তনের ব্যবসায়, ২০০৫ এবং ২০১৩-এর মধ্যে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৫ সাল থেকে ব্যক্তিগত মালিকানায় তফসিলি জাতি-জনজাতিগুলির প্রতিনিধিত্বের উন্নতি আসলে এসেছে অন্যান্য অনগ্রসর জাতিভুক্ত মালিকদের প্রতিনিধিত্বের পতনের বিনিময়ে। ২০০৫ এবং ২০১৩-র মধ্যে প্রায় সমস্ত আয়তনের ব্যবসায় ওবিসিদের প্রতিনিধিত্ব সূচক হ্রাস পেয়েছে। ফলস্বরূপ, মাঝারি বা বড় ব্যবসায়, ২০১৩ সালে ওবিসিদের প্রতিনিধিত্ব সূচকটি ১-এর থেকে কম তো বটেই, এমনকি ১৯৯৮-এর মানের থেকেও কম।
সুতরাং মালিকানায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব তুলনামূলক ভাবে দেখলে বোঝা যাচ্ছে যে, বিগত কয়েক দশকে তফসিলি জাতিগুলির ব্যক্তিগত মালিকানাস্বত্বে যেটুকু উন্নতি হয়েছে, তা ঐতিহাসিক বর্ণ শ্রেণিবিন্যাসের নীচের অংশে কিছু আলোড়নের ফলে। ব্যক্তিগত ব্যবসায় উচ্চবর্ণের মালিকদের আধিপত্য ধারাবাহিক ভাবে টিকে আছে এবং তা ২০০৫ সাল থেকে আরও শক্তিশালী হয়েছে। এর ফলে, অর্থনৈতিক ক্ষমতার ভরকেন্দ্রটিও উচ্চবর্ণের মালিকদের দিকেই ঝুঁকে।
এখন প্রশ্ন হল, অর্থনৈতিক ক্ষমতা বলতে কী বোঝায় এবং তার মাত্রা নির্ধারণ হবে কী ভাবে? মালিকানা প্রতিনিধিত্বের এই প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক ক্ষমতার অন্যতম মাপকাঠি হতে পারে মালিক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ভ্যালু অ্যাডেড বা মূল্য সংযোজনের পরিমাণ। উৎপাদন খাতে, আমরা সংগঠিত এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের এন্টারপ্রাইজ় সার্ভে থেকে গ্রোস ভ্যালু অ্যাডেড-এর তথ্য ব্যবহার করে অনুমান করার চেষ্টা করেছি প্রতিনিধিত্বের অভাবের ফলে প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীগুলির ক্ষতি টাকার অঙ্কে কতটা। অর্থাৎ, মালিকানায় প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীগুলির প্রতিনিধিত্বের ঘাটতির ফলে কত টাকার উৎপাদন তাদের নিয়ন্ত্রণের বদলে চলে যাচ্ছে উচ্চবর্ণের মালিকদের কাছে। আমাদের অনুমান অনুযায়ী, ২০১৩ সালে মালিকানায় প্রতিনিধিত্বের ঘাটতির ফলে প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠী (তফসিলি জাতি-জনজাতি এবং ওবিসি) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত উৎপাদন, যা ন্যায্য তার চেয়ে ৪২০০০ কোটি টাকা কম। এটি উৎপাদন খাতে সমস্ত ব্যক্তিগত মালিকানাধীন উৎপাদনের প্রায় ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ, ব্যক্তিগত ব্যবসার মালিকানায় জাতি-ভিত্তিক পক্ষপাত না থাকলে, ৪২০০০ কোটি টাকার মোট উৎপাদনের এক-চতুর্থাংশ যা উচ্চবর্ণের মালিকদের দখলে, তা আসলে প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর মালিকদের দখলে থাকত।
অর্থনৈতিক ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে এই ধরনের জাতি-ভিত্তিক স্তরবিন্যাসের অস্তিত্ব ঐতিহাসিক ভাবে অজানা নয়। কিন্তু ভাববার বিষয় হল এই যে, এই প্রবণতাগুলি ১৯৯৮ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি সত্ত্বেও অব্যাহত রয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy