সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে। —ফাইল চিত্র।
একটা ধাঁধা দিয়ে শুরু করি। ভারতের গ্রোস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট (জিডিপি) বা মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন এখন বিশ্ব তালিকায় পঞ্চম স্থান দখল করেছে; এবং প্রত্যাশিত যে, ২০৩০ সালের মধ্যে তা তৃতীয় স্থানে পৌঁছে যাবে। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের নিরিখে ভারতের অবস্থান ছিল বিশ্বে ১৭তম— তাই এই দিক থেকে ভারতের আপেক্ষিক অবস্থানের যে বেশ উন্নতি হয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় ভারতের স্থান ছিল ১৬১তম, এখন তা ১৫৯তম— অর্থাৎ, যে সময়কালে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের নিরিখে ভারত বিশ্বে ১৭তম স্থান থেকে পঞ্চম স্থানে উঠে এসেছে, সেই সময়কালেই মাথাপিছু আয়ের নিরিখে ভারতের আপেক্ষিক অবস্থান পাল্টায়নি বললেই চলে। কেন?
মনে হতেই পারে যে, এর কারণ হল জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার— যার ফলে মোট জাতীয় আয় বাড়লেও গড় মাথাপিছু আয় বাড়েনি। তা কিন্তু নয়। ঘটনা হল, জনসংখ্যার নিরিখে ভারতের আপেক্ষিক অবস্থান এই পুরো সময়কালে বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানেই ছিল, যদিও খুব সম্প্রতি ভারত সম্ভবত চিনকে টপকে বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল দেশ হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, আলোচ্য সময়সীমার মধ্যে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারের নিরিখে সারা বিশ্বের গড়ের সঙ্গে ভারতের বিশেষ কোনও ফারাক ছিল না; এবং, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও কমেছে। সবচেয়ে বড় কথা হল, ১৯৯১ আর ২০২১ সালের মধ্যে গড় মাথাপিছু আয় বেড়েছে সাত গুণের বেশি। তার থেকে যদি মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব বাদ দিই, তা হলে দেখা যাবে, গড় মাথাপিছু প্রকৃত আয় বেড়েছে প্রায় চার গুণ। তা সত্ত্বেও মোট জাতীয় আয়ের তালিকায় এতটা উন্নতি আর মাথাপিছু আয়ের তালিকায় প্রায় একই জায়গায় আটকে থাকার কারণ কী? উত্তরটি আছে উদারীকরণের পরবর্তী জমানা ধরে একটানা মাথাপিছু আয়ের আগের জমানার তুলনায় উচ্চ হারে বৃদ্ধির মধ্যে। একটি উদাহরণ দিই। ধরুন, কোনও দেশের এক দশকে মাথাপিছু আয় বেড়ে দ্বিগুণ হল। কিন্তু অন্য দেশগুলির তুলনায় তার আপেক্ষিক অবস্থানে খুব একটা ফারাক না-ও হতে পারে, যদি সেই দেশগুলোতে গড় মাথাপিছু আয় প্রথম থেকেই অনেকটা বেশি থাকে, বা তাদেরও যথেষ্ট ভাল হারে বৃদ্ধি হয়। কিন্তু, সেই দেশটির জনসংখ্যা যত বেশি হবে, মোট জিডিপির মান কিন্তু সেই অনুপাতে বেশি হবে। যেমন, তার যদি জনসংখ্যা যা তার দ্বিগুণ হত, মোট জিডিপি বাড়ত চার গুণ। এই ব্যাপারটাকে আমরা জনসংখ্যা গুণক বলতে পারি। তাতে জনসংখ্যায় বড় দেশটির অন্যান্য দেশের তুলনায় জিডিপির নিরিখে আপেক্ষিক অবস্থান অনেকটা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। এই বৃহৎ জনসংখ্যার গুণকের কারণেই ভারত নব্বইয়ের দশকের গোড়া থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ে জিডিপি র্যাঙ্কিংয়ের প্রথম সারিতে উঠতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ভারতের মাথাপিছু জিডিপি র্যাঙ্কিংকে টেনে তুলতে গেলে গড় বৃদ্ধির হার আরও বেশি হওয়া দরকার ছিল।
চিনের সঙ্গে তুলনা করলে দেখব, জিডিপির র্যাঙ্কিংয়ে ১৯৯১ থেকে ২০২১ সালে দেশটি একাদশতম স্থান থেকে উঠে এসেছে দ্বিতীয় স্থানে, আর মাথাপিছু গড় আয়ে তার অবস্থান ১৫৮ থেকে ৭৫-এ দাঁড়িয়েছে। এই সময়সীমায় তার মাথাপিছু জিডিপি বেড়েছে ৩৮ গুণ, যেখানে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি বেড়েছে মাত্র সাত গুণ। যে-হেতু চিনের জনসংখ্যা বেশি, জনসংখ্যার গুণকের প্রভাব আরও বেশি, কিন্তু তারা মাথাপিছু গড় আয় বাড়াতে অনেক গুণ বেশি সক্ষম হয়েছে, তাই তাদের মোট আয় এবং মাথাপিছু আয় দু’ক্ষেত্রেই আপেক্ষিক অবস্থানে উন্নতি হয়েছে অনেকটা বেশি।
এখন অবধি যা বলেছি, তা শুধুমাত্র পরিসংখ্যানের যুক্তি ব্যবহার করে বলেছি। জানা কথা যে, অসাম্যের উপস্থিতিতে মোট জাতীয় আয় সাধারণ মানুষের জীবনের মানের নির্ভরযোগ্য মাপকাঠি নয়, কারণ ধনীতম ১০%-এর আয় ১০% বাড়লে আর বাকি সবার আয় এক থাকলে দেখা যাবে যে, মোট জাতীয় যায় ১০% বেড়েছে। গড় জাতীয় আয় এ দিক থেকে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানের সূচক হিসাবে আর একটু নির্ভরযোগ্য, কারণ এই উদাহরণে তা বাড়বে মাত্র ১%।
উন্নয়নের দিক থেকে আসল প্রশ্ন হল মোট বা গড় জাতীয় বৃদ্ধির হারে কতটা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানের বৃদ্ধি প্রতিফলিত হচ্ছে। কিন্তু তা হলেও এটা মানতেই হবে যে, একটি জনবহুল দেশ যদি অনেকটা সময় ধরে মাথাপিছু আয় বাড়াতে পারে, তার জন্য কিছুটা কৃতিত্ব অবশ্যপ্রাপ্য। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়েছে নব্বইয়ের গোড়া থেকে মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধির হার বাড়তে শুরুর করার পর থেকে তিন দশক ধরে টানা সেই বৃদ্ধির হার একটা ন্যূনতম মানে বজায় রাখার কারণে। কিছু দিনের মধ্যেই ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হতে চলেছে— বর্তমান শাসকরা নিশ্চিত ভাবেই তার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দাবি করবেন, তা নিয়ে প্রচার করবেন বটে, কিন্তু মনে রাখা ভাল যে, গত এক দশকে বৃদ্ধির হার স্তিমিত হওয়ার লক্ষণ সুস্পষ্ট।
শাসকদের কৃতিত্ব দাবি করে প্রচারে বিশ্বদরবারেও খানিক সাড়া যে মিলছে, তার কারণ কী? অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে জগৎসভায় ভারতের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব অতি সম্প্রতি মেয়াদ শেষ হওয়া জি২০-র সভাপতিত্বে প্রতিফলিত। পণ্যের বাজারের দিকে শ্যেন চোখে নজর রাখা বহুজাতিক কর্পোরেশন বা বিনিয়োগে সর্বোচ্চ লাভের হার-সন্ধানী বিশ্বপুঁজি— এদের কাউকেই সহজে বোকা বানানো যায় না। ভারতকে একটি ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে দেখার কারণ কী?
এর উত্তর হল বাজারের আয়তন। গত তিন দশকব্যাপী বৃদ্ধির সুফলের সিংহভাগ মূলত জনসংখ্যার একটা ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হলেও, বাজার হিসাবে সেই গোষ্ঠীর আয়তন নগণ্য নয়— ব্রিটেন বা ফ্রান্সের সমগ্র জনসংখ্যা ভারতের জনসংখ্যার চার-পাঁচ শতাংশের কাছাকাছি। ছোট দেশগুলির মাথাপিছু আয় বেশি হতে পারে, বা তা আরও দ্রুত হারে বাড়তে পারে, কিন্তু নিছক বাজারের আয়তনের কারণেই ভারত গুরুত্বপূর্ণ।
তাই মোট জিডিপির মান বা তার বৃদ্ধির হার উন্নয়নের মাপকাঠি হিসাবে দুর্বল হলেও বা জনসংখ্যার একটা বড় অংশ দরিদ্র হলেও, একটি সম্পন্ন ও বিত্তবান গোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতার সূচক হিসাবে তা যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। অর্থনীতির এই অংশটি বিলাসবহুল গাড়ি বা অভিনব স্মার্টফোনের বাজার হিসাবে আয়তনের দিক থেকে অনেক ধনী দেশকে টেক্কা দিতে পারে। এই সম্পন্ন শ্রেণির ক্রয়ক্ষমতা এবং চাহিদার বিন্যাসের প্রতিফলন অর্থনীতির যে বাতানুকূল কক্ষে— যার প্রতীক ঝলমলে শপিং মল বা অন্যান্য বিলাসদ্রব্য ও পরিষেবা জোগানের পরিকাঠামো— তা দেখে কেউ সরল মনে জাজ্বল্যমান ভারতের রূপকথায় বিশ্বাস করে ফেলতে পারেন।
বাজারের আয়তনের জন্য ভারত যে বিশ্বপুঁজির কাছে আকর্ষণীয়, তার কারণ দু’টি। এক, বৃহৎ মাপের উৎপাদন শিল্পের জন্য সম্ভাব্য ক্রেতার পরিপ্রেক্ষিতে একটি নির্দিষ্ট আয়তনের বাজারের প্রয়োজন হয়। তা না হলে, বিনিয়োগ করা লাভজনক হয় না। এ হল ইনক্রিজ়িং রিটার্নস টু স্কেল বা ক্রমবর্ধমান উৎপাদন বিধির উদাহরণ। দুই, মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে যা-ই ঘটুক না কেন, যদি একটি বৃহৎ দেশের জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশও থাকে যাদের আয় একটি নির্দিষ্ট সীমা ছাড়িয়ে যায়, তাদের চাহিদা প্রয়োজনীয় সামগ্রী থেকে বিলাসদ্রব্যের দিকে চলে যায়।
কাজেই, জিডিপির পরিমাণের নিরিখে ভারতের উত্থানের প্রসঙ্গে যদি কেউ বলেন যে, এটা নেহাতই পরিসংখ্যানের খেলা, যাতে সাধারণ মানুষের জীবনের মান প্রতিফলিত হয় না, অথবা মাথাপিছু গড় আয় তো তত বাড়েনি— তিনি আসল গল্পটা ধরতে পারবেন না। তা হল, জনসংখ্যার একটি নির্দিষ্ট অংশ যার ক্রয়ক্ষমতা একটা মাত্রা অতিক্রম করেছে তাদের ক্রমবর্ধমান সমৃদ্ধি। সমস্যা হল, জনসংখ্যার ক্ষুদ্র একটি অংশের মধ্যে চাহিদা ও জোগানের খেলা আবদ্ধ থাকলে, আরও বড় পরিসরে ছড়িয়ে না পড়তে পারলে বৃদ্ধিপর্ব ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসতে বাধ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy