—ফাইল চিত্র।
ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যস্থলের তালিকায় যুক্ত হয়েছে শান্তিনিকেতন। এই ঐতিহ্যের কেন্দ্রে কী আছে তা নিয়ে নানা মত থাকতে পারে, কিন্তু ইউনেস্কোর পরিচিতি অনুযায়ী, শান্তিনিকেতন ছিল একটি আবাসিক বিদ্যালয় ও কলাকেন্দ্র যার ভিত্তি প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সীমানা পেরোনো মানব-ঐক্য।
মুদ্রণ ও গ্রন্থসংস্কৃতির আঞ্চলিক সীমানাও পেরোতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর সেই চেষ্টার পরিচয় নিয়ে শতবর্ষে পা দিল তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ। বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার পরে-পরেই তার প্রতিষ্ঠা। রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় এ দুইয়ের যে একটা সংযোগ ছিল তা বোঝা যায় ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯২২, গ্রন্থনবিভাগ প্রতিষ্ঠার কয়েক মাস আগে ইলাহাবাদে ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস-এর স্বত্বাধিকারী চিন্তামণি ঘোষকে লেখা চিঠিতে, “শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠানটিকে যথাবিধি সর্ব্বসাধারণের হস্তে সমর্পণ করিয়াছি। আমার সমস্ত বাংলা বইগুলির স্বত্ব লেখাপড়া করিয়া বিশ্বভারতীর হাতে দিয়া আমি সম্পূর্ণ নিষ্কৃতি লইয়াছি। এক্ষণে এই অধিকারের হস্তান্তর উপলক্ষ্যে আমার গ্রন্থপ্রকাশের কোনো একটি সন্তোষজনক ব্যবস্থা হইতে পারিলে আমি অত্যন্ত নিশ্চিন্ত হইতে পারিব।”
এর একটা উদ্দেশ্য অবশ্যই ছিল বিশ্বভারতীর জন্য অর্থসংগ্রহ। বছর দশেক আগেই নোবেল পেয়েছেন তিনি। ১৮৭৮-এ যে তরুণ কবির প্রথম বই কবি-কাহিনী প্রকাশিত হয়, তিনি মোটেই জনপ্রিয় ছিলেন না। জীবনস্মৃতি সাক্ষী, “শুনা যায় সেই বইয়ের বোঝা সুদীর্ঘকাল দোকানের শেল্ফ্ এবং তাঁহার চিত্তকে ভারাতুর করিয়া অক্ষয় হইয়া বিরাজ করিতেছিল।” সেই তরুণ কবি ১৯২০-র দশকে রীতিমতো বেস্টসেলার।
কিন্তু নিজের বহু বিক্রীত বই বিশ্বভারতী থেকে ছাপিয়ে লাভের অর্থ বিশ্বভারতীর স্বার্থেই খরচ করা, প্রকাশনায় তাঁর উদ্যোগ কেবল এ কারণে ছিল না। গ্রন্থনবিভাগ সূচনারও আগে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন শান্তিনিকেতন প্রেস। যে ছোট্ট ছাপার যন্ত্র দিয়ে তার সূচনা, শান্তিনিকেতনের ছেলেদের তা উপহার দেন আমেরিকার নেব্রাস্কার লিঙ্কন শহরবাসী। ৮ জানুয়ারি ১৯১৭ স্কুলের অর্থসংগ্রহের জন্য রবীন্দ্রনাথ সেখানে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সে দিনই উপহার পেলেন ‘দ্য লিংকন প্রেস’, গায়ে ধাতুর পাতে খোদাই করা, ‘প্রেজ়েন্টেড টু দ্য বয়েজ় অব শান্তিনিকেতন’। কোন শান্তিনিকেতন? মাস তিনেক আগে, ১১ অক্টোবর ১৯১৬ রথীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিতে যে শান্তিনিকেতন ঘিরে তাঁর সঙ্কল্পের কথা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ, “শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়কে বিশ্বের সঙ্গে ভারতের যোগের সূত্র করে তুলতে হবে... সর্ব্বমানবের প্রথম জয়ধ্বজা ঐখানে রোপণ হবে।”
রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় তত দিনে প্রতিষ্ঠা করেছেন ইন্ডিয়ান প্রেস। ১৯০৮ থেকে ১৯২৩, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগের সূচনাবর্ষটি পর্যন্ত ওই প্রেসই রবীন্দ্রনাথের বইয়ের মুখ্য প্রকাশক। বোলপুরের প্রান্তরে কবির যে ছাপাখানার সূচনা হয় তার নামে শান্তিনিকেতন রইল, পাশে অবলীলায় বসল ইংরেজি ‘প্রেস’ শব্দটি। পরে এই ছাপাখানাতেই ‘বিশ্বগ্রন্থপ্রকাশের ব্যবস্থা’ করতে চাইলেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বগ্রন্থ মানে বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ গ্রন্থমালা, যার পরিকল্পনা বিদ্যার বিশ্বব্যাপী ধারার সঙ্গে বাঙালির প্রাথমিক পরিচয় ঘটানোর লক্ষ্যে।
বৃহত্তর প্রাচ্যের নিজস্ব আধুনিকতার যে বৈশিষ্ট্যে আজ শান্তিনিকেতন আবহমান ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত, তার এক প্রান্তসীমায় শান্তিনিকেতন প্রেস ও বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগও কি নেই? ঘরে বাইরে-র নিখিলেশ চেষ্টা করেছিল স্বদেশকে তার নিজস্ব স্বনির্ভর অর্থনীতিতে প্রতিষ্ঠার। রবীন্দ্রনাথও শান্তিনিকেতনের এক সাঁওতাল ছাত্রকে বই বাঁধাইয়ের কাজ শিখতে পাঠিয়েছিলেন কলকাতায়। সুরেন্দ্রনাথ কর লন্ডনের ‘কাউন্টি কাউন্সিল স্কুল অব এনগ্রেভিং অ্যান্ড লিথোগ্রাফি’তে লিথোগ্রাফি ও বই বাঁধাইয়ের কাজ শিখে এসে তা শেখালেন কলাভবনের ছাত্র বীরভদ্র রাও ও বিশ্বভারতীর কর্মী শোকলা সাঁওতালকে। নইলে যে পরিপূর্ণতা পায় না তাঁর বিদ্যালয়ের আদর্শ, “এই বিদ্যালয়... ছাত্র শিক্ষক ও চারিদিকের অধিবাসীদের সঙ্গে জীবিকার যোগে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হইবে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের ঔপনিবেশিক ধারণার উল্টো দিকে হেঁটে রবীন্দ্রনাথ যেমন তৈরি করতে চেয়েছিলেন বিশ্বভারতী, তেমনই ‘ইউনিভার্সিটি প্রেস’-এর কেমব্রিজ অক্সফোর্ড প্রিন্সটন হার্ভার্ড-এর আদর্শের পাশ কাটিয়ে তৈরি করেন বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ। এই প্রকাশনার প্রথম বই বসন্ত, একটি নাটক। তাঁর অমল পণ্ডিত হতে চায়নি, তাঁর প্রকাশনাও গবেষণাগ্রন্থ দিয়ে যাত্রা শুরু করল না। তাঁর ছাপাখানাও শুরু করেছিল গানের বই গীত-পঞ্চাশিকা দিয়ে। শান্তিনিকেতন যে পাঁচিলহীন ভাবনার খোলা মাঠের খেলা!
গ্রন্থনবিভাগের বইপত্রেও তা-ই। প্রচ্ছদে খোলা জায়গা, খোয়াইয়ের প্রান্তরের রঙে। সেই উদার প্রান্তরে লেখকেরই হাতের লেখার ছাঁদে নিরাসক্ত সংযমে নামাঙ্কন: “মলাটে সাদা অক্ষরে বীথিকা যেন লেখা থাকে, আমি অলঙ্কৃত করে দেবো না৷” আবার, লেখকের প্রাণের সঙ্গে পাঠকের প্রাণকে একতানে মেলাতেই হয়তো জার্মানির প্রযুক্তি ব্যবহার লেখন-এ, হাতের লেখায় বই ছাপানোর জন্য। সে বই আমাদের প্রাচীন পুঁথি-সংস্কৃতিকে মনে পড়ায়। রবীন্দ্রনাথ নিঃশব্দে বদলে দিয়েছিলেন বাংলা প্রকাশনার গতিপথ, স্বাজাতিক সঙ্কীর্ণতা পেরিয়ে গ্রন্থ-সংস্কৃতির সর্বজাতিক মনুষ্যত্ব চর্চার পথে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy