বর্তমান মন্দা বা আর্থিক শ্লথতার ধরন আলাদা। প্রতীকী ছবি।
ধনী আর গরিব দেশের মধ্যে একটা তফাত হল, ধনী দেশে জিনিসপত্রের দাম হুহু করে বাড়ে না। পোশাকি ভাষায় বললে, উন্নত দেশে মূল্যবৃদ্ধির হার উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় কম হয়, সচরাচর। আমেরিকায় পাউরুটির দাম ভারতের তুলনায় বেশি বটে, কিন্তু হিসাব কষলে দেখা যাবে যে, এক বছরে সে দেশে দাম যত বাড়ে এখানে তার থেকে চড়া হারে বাড়ে। দেশ উন্নত, তাই মূল্যবৃদ্ধির পাগলা ঘোড়াকে বাগে মানাতে সফল, এমনটা কেউ ভাবতে পারেন।
তবে ‘সচরাচর’ শব্দটা লক্ষণীয়। সম্প্রতি উন্নত দেশেও পাগলা ঘোড়া তুর্কি নাচন নাচছে। আমেরিকা, ব্রিটেনে মূল্যবৃদ্ধির হার ১০%-এর কাছাকাছি পৌঁছেছে। ইউরোপের অন্য দেশগুলোর হালও তথৈবচ। অথচ সচরাচর এদের মূল্যবৃদ্ধি ২-৩%-এর কাছাকাছি থাকে— গত ৪০ বছরের অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। মূল্যবৃদ্ধি তিনগুণ বেড়ে যাওয়া মানে এই নয় যে, নুন আনতে পান্তা ফুরোচ্ছে। তবে খরচের ধাক্কা সামলাতে সাধারণের জমানো টাকায় টান পড়ছে, খরচ কাটছাঁট করতে হচ্ছে।
একা মূল্যস্ফীতিতে রক্ষা নেই, আর্থিক মন্দা দোসর। খবরে প্রকাশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো শিগগিরই মন্দার কবলে যাবে, বা ইতিমধ্যেই চলে গিয়েছে। আমেরিকায় পর পর দু’বার জাতীয় আয় কমেছে, যা মন্দার লক্ষণ। অবশ্য অর্থনীতির অন্য ইঙ্গিত দেখে বলা যাচ্ছে না যে, মন্দা এসেছে। তবে মন্দাতে না পড়লেও আমেরিকার অর্থনীতি শ্লথ হয়েছে।
বর্তমান মন্দা বা আর্থিক শ্লথতার ধরন আলাদা। মন্দাকে সাধারণত শ্রমিক ও কর্মী ছাঁটাইয়ের সঙ্গে এক করে দেখা হয়। মূল্যবৃদ্ধি মন্দাতে কম থাকে। ২০০৮-০৯ সালের মন্দা, বা ১৯২৯ সালের মহামন্দার ধরন এ রকমই ছিল। এখনকার সঙ্কটে কিন্তু লোকের কাজ যাচ্ছে না— বেকারত্বের হার কম। উল্টো দিকে জিনিসপত্রের দাম চড়চড় করে বাড়ছে। রহস্যটা কী?
প্রথমত, বিশ্বায়নের ফলে উৎপাদনের শৈলী বিচিত্র ও জটিল হয়ে উঠেছে; তার উপর কোভিডের ফলে উৎপাদনের শিরা-ধমনীগুলি বিপর্যস্ত। একটা মোবাইল ফোনের কাঁচামাল হয়তো শ’খানেক কোম্পানি থেকে আসে। কোম্পানিগুলোর সাকিন এক দেশে নয়— তারা ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন দেশে। অতিমারির দরুন কোনও দেশে লকডাউন হলে গোটা সাপ্লাই চেন, বা জোগানপ্রবাহ থেমে যাবে। বাজারে মোবাইল মিলবে না, বা দাম বেড়ে যেতে পারে। কোভিড মোকাবিলার জন্য চিন অতি কঠোর জ়িরো-কোভিড নীতি নিয়েছিল। ফলে চিনের উৎপাদন কমে যাওয়ায় বাকি দুনিয়া উৎপাদনের প্রয়োজনীয় উপাদান, কাঁচামাল পাচ্ছে না। কম পরিমাণে উৎপাদন হচ্ছে। ফল আর্থিক শ্লথগতি।
অন্য দিকে, কোভিড বিধিনিষেধগুলো উঠে যাওয়ার পর চাহিদা বেড়েছে। কোভিডকালের কেনাকাটার অপূর্ণ চাহিদা বাজারে আসছে, বহু ক্রেতা পণ্য কিনতে চাইছেন। কোভিড মোকাবিলায় সরকারি খরচ বাড়ানো হয়েছিল। সেই খরচও বিপুল চাহিদা তৈরি করেছে। ফলে দাম বাড়ছে। কারখানার কর্তারা চাইছেন চাহিদার মাপে উৎপাদন করতে, তাই ছাঁটাই নেই, বেকারত্ব কম।
দ্বিতীয় কারণ, কোভিড-বিপর্যস্ত জোগান ব্যবস্থাকে কাহিল করেছে রাশিয়ার যুদ্ধ। রাশিয়া ও ইউক্রেন দুনিয়ার প্রথম পাঁচ গম রফতানিকারক দেশের মধ্যে পড়ে। অন্যান্য কৃষিজাত ও খনিজ দ্রব্যও এই দুই দেশ থেকে বিশ্বের বাজারে যায়। জার্মানির মতো ইউরোপের অনেক দেশ রুশ খনিজ তেল ও গ্যাসের উপরে নির্ভরশীল। যুদ্ধ ও রুশ পণ্য বয়কটের কোপ পড়েছে পণ্যের জোগানের উপরে। জ্বালানির দাম বাড়ছে, উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
হাজার পতন অভ্যুদয়ে বিশ্ব যে দিগ্বিজয়ে চলছে, তাতে আমাদের কী এল-গেল? এই প্রশ্নের জবাবে অন্তত তিনটি কথা বলা যেতে পারে। এক, বিশ্বায়িত ভুবনে ভারত বাকি দুনিয়ার সঙ্গে অসংখ্য লেনদেনে সংযুক্ত। ধনী দেশগুলোর অর্থব্যবস্থা মন্দায় পড়লে তারা ভারতীয় পণ্য বা পরিষেবা ততখানি কিনবে না, ভারতের আর্থিক গতি, কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশ্বায়িত দুনিয়ায় রোগভোগ দ্রুত ছড়ায়।
দুই, আমরাও অন্য দেশের পণ্য কিনি প্রচুর। উদাহরণ, ভারতের যত খনিজ তেল দরকার, তার বেশির ভাগ বিদেশ থেকে আমদানি হয়। রাশিয়ার যুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। হয়তো তেলের মার আমাদেরও ভোগ করতে হত, কিন্তু ভাগ্যক্রমে রুশ তেলের আমদানি আম আদমিকে স্বস্তি দিয়েছে। এখন ভারতের তেলের এক নম্বর জোগানদার রাশিয়া। কিন্তু স্বস্তি কত দিন স্থায়ী হবে? পশ্চিমি চাপে রুশ তেল আমদানি বন্ধ করলে মূল্যবৃদ্ধির ঘোড়া বেলাগাম হতে পারে। ধনী দেশের ক্রয়ক্ষমতা বেশি, আক্রার বাজারে তারা বেশি টাকা ফেলে মালপত্র কিনছে, দাম আরও বাড়ছে। গরিব দেশগুলোর সমস্যা দ্বিগুণ হচ্ছে। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানের নাভিশ্বাস স্মর্তব্য।
তিন, উন্নত বিশ্ব মূল্যবৃদ্ধির মোকাবিলা করছে সুদের হার বাড়িয়ে। সুদের হার বাড়ানোর পিছনের যুক্তি— সুদ বেশি হলে লোকে ধার করবে কম, জিনিসপত্র কম কিনবে, ফলে দাম তত বাড়বে না। এই যুক্তি বাস্তবে কাজ করে কি না তা তর্কের বিষয়, তবে দুটো কথা এই প্রসঙ্গে আসবে। এক, সুদ বাড়ানোর কঠোর নীতি অর্থব্যবস্থাকে গভীর মন্দার দিকে ঠেলে দিতে পারে। গত শতকের সত্তরের দশকে খনিজ তেলের দাম বাড়ার ফলে বল্গাহীন মূল্যবৃদ্ধি হয়, যার মোকাবিলায় আমেরিকা সুদ বাড়ায়, ও তার পর আসে আর্থিক মন্দা। দুই, বিভিন্ন দেশের সুদের হারের মধ্যে সাযুজ্য থাকে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ফেডারাল রিজ়ার্ভ যে হারে সুদ বাঁধে, তা গোটা দুনিয়াকে প্রভাবিত করে। আমেরিকায় সুদ বাড়লে দুনিয়ার লগ্নিপুঁজি সে দিকে উজিয়ে যায়— পুঁজি ধরে রাখতে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কও সুদ বাড়ায়। যাঁরা সঞ্চয়নির্ভর, চড়া সুদ তাঁদের পক্ষে সুখবর, কিন্তু চড়া সুদের চাপ পড়ে সরকারি তহবিলের উপরে, কেননা ঋণবাবদ সরকারকে সুদ দিতে হয়। সুদের হার চড়া হলে সরকারের খরচ বাড়ে। খরচ চরমে পৌঁছলে ঋণের বোঝায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়। অতিমারির খরচ, আমদানির মূল্যবৃদ্ধির ঝাপ্টা সামলে অনেক দেশের সরকারের তহবিল ইতিমধ্যে নড়বড়ে হয়ে পড়েছে।
সুদের খরচ বাড়লে সরকারের কাছে উপায় কী? এক, বেশি ঋণ নেওয়া, যাতে অন্য সরকারি খরচ বহাল রাখা যায়। এতে সমস্যা হল, বেশি ঋণ নিলে তহবিলে ঘাটতি বেড়ে যাবে। দুই, ঋণের খরচ সামলাতে অন্য খরচ কাটছাঁট করা, যাতে ঘাটতি না বাড়ে। তিন, কর বাড়িয়ে আয় বাড়ানো— এতে ঘাটতি বাড়বে না, অন্য খরচ আগের মতো বহাল থাকবে। আজ সারা দুনিয়াতে যখন সুদের হার চড়ছে, আসন্ন কেন্দ্রীয় বাজেট ইঙ্গিত দিতে পারে যে, তহবিল সামলাতে সরকার কোন পন্থা নেবে। বাজার অর্থনীতির সমর্থকরা চাইবেন দু’নম্বর পথে হেঁটে অন্যান্য খরচ কমাতে। কোপ পড়বে সামাজিক ক্ষেত্রে খরচের উপরে— যেমন রেশন, বা স্বাস্থ্য, বা গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পের খরচ। কিন্তু, এ বছরই অনেক রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন; ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচন। রাজনীতির হিসাব কষে কি শেষে সামাজিক ক্ষেত্রের খরচ বহাল রাখা হবে, এক নম্বর রাস্তাতেই চলা হবে? এক আর দুইয়ের চক্করে তিন নম্বর রাস্তার কথা চাপা পড়ে যাবে হয়তো। সম্পদ কর, বা কর্পোরেট কর বাড়িয়ে সরকারের আয় বাড়ানো যায়। ধনকুবেরদের থেকে কর আদায় করলে আমাদের লজ্জাজনক আর্থিক অসাম্য কিছুটা কমে। কিন্তু বাজারের বা রাজনীতির ব্যাপারী— দু’পক্ষের কাছেই এই নীতি অস্পৃশ্য।
শতাব্দী বদলে যায়, সমাজ ও অর্থনীতির রূপ পাল্টায়, নতুন আর্থিক সমস্যার জন্ম হয়। অথচ সমাধান করার জন্য পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার কাছে যে হাতিয়ারগুলো আছে, সেগুলো যেন মান্ধাতার আমলে পড়ে আছে। মূল্যবৃদ্ধি আটকানোর জন্য পুরাতন দাওয়াই সুদ বাড়ানো। আবার আমেরিকা সুদ বাড়ালে দেশের সুদ বাড়ানো, সঙ্গে সরকারি ঘাটতির সঙ্কট ডেকে আনা। মুক্ত বাজার অর্থনীতির প্রতিশ্রুতি ছিল পছন্দসই পথ বাছার স্বাধীনতা পাওয়া যাবে। বিশ্বায়িত ভুবনে এসে দেখছি, পছন্দ করার মতো পথ খুব বেশি আসলে নেই।
অর্থনীতি বিভাগ, ইন্ডিয়ান ইস্টিটিউট অব টেকনোলজি, গুয়াহাটি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy