জাগতিক: মুম্বইয়ে আংশিক সূর্যগ্রহণ, ২৫ অক্টোবর, ২০২২। রয়টার্স
গত কয়েক সপ্তাহে দু’-দুটো গ্রহণ দেখা গেল আকাশে। ২৫ অক্টোবর অমাবস্যার দিন আংশিক সূর্যগ্রহণ, বিকেল চারটের পর। শেষ হওয়ার আগেই সূর্যাস্ত।
তার দু’সপ্তাহ বাদে ৮ নভেম্বর পূর্ণিমার সন্ধেবেলা চাঁদের গ্রহণ, বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ শুরু হল। কলকাতা-সহ পূর্ব ভারত থেকে সম্পূর্ণ গ্রহণ হিসাবে দেখা গেল, আমরা পশ্চিম ভারতে আংশিক দেখলাম।
এই গ্রহণই নাকি অশুভ! অনেকেই দরজা-জানলা বন্ধ করে বাড়ি বসে অনশন করেন, রান্না করা খাবারে আর জলে তুলসীপাতা দিয়ে রাখেন! তার উপর এ বার সূর্যগ্রহণের দুই সপ্তাহ পরই এই চন্দ্রগ্রহণ এল! অনেকেই শিউরে উঠলেন! এ নিশ্চয়ই অশুভ লক্ষণ? এ বার কি পৃথিবীর অন্তিমকাল ?
কিন্তু, সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণ জোড়ায় আসা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। প্রায়শই এক মাসের মধ্যে তিন বার হয়।
আমরা একশো বছর আগেও জানতাম না, কিন্তু এখন জানি, যে সূর্য জ্বলন্ত এক গ্যাসের বলয়, যার গভীর অন্তরালে পারমাণবিক ফিউশন চলছে, তাতে তৈরি হচ্ছে আলো, তাপ, শক্তি। পৃথিবী এক বিরাট প্রস্তর, সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে বছরে এক বার। চাঁদও এমনই পাথর, পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে চলে এক মাসে এক বার।
চাঁদের কিন্তু নিজস্ব আলো নেই। জ্যোৎস্না আসলে প্রতিফলিত সূর্যালোক। সূর্য এবং চাঁদের আপেক্ষিক অবস্থান অনুযায়ী চাঁদের কলা বদলায়। যখন পৃথিবীর এক পাশে চাঁদ আর ঠিক উল্টো দিকে সূর্য তখন পূর্ণিমা। আর যখন একই দিকে সূর্য ও চাঁদ তখন অমাবস্যা। মাঝখানে চন্দ্রকলা বদলায়। চাঁদ প্রতি মাসে এক বার পৃথিবীর চার পাশে ঘুরছে তাই এই চক্রটির প্রতি মাসে পুনরাবৃত্তি হয়।
মাঝে মাঝে সূর্য-পৃথিবী-চন্দ্র একই সরলরেখায় চলে আসে। এ অবস্থায় যখন পূর্ণিমার দিনে পৃথিবী সূর্য ও চাঁদের মাঝখানে আসে তখন পৃথিবীর ছায়া পড়ে চাঁদের উপর আর চন্দ্রগ্রহণ হয়। যখন অমাবস্যায় চাঁদ অন্য দু’টির মধ্যে আসে, তখন চাঁদের ছায়ায় সূর্যগ্রহণ হয়। বোঝার বিষয় হল, চাঁদের কক্ষপথের সমতল পৃথিবীর কক্ষপথের সঙ্গে ঠিক সরলরেখায় মেলানো নয়। এ ক্ষেত্রে, পাঁচ ডিগ্রি পর্যন্ত সংযোজনের অভাব হতে পারে। এই কারণেই প্রতি পূর্ণিমায় চন্দ্রগ্রহণ হয় না— শুধুমাত্র যে পূর্ণিমায় পৃথিবী, সূর্য ও চাঁদ এক রেখায় আসে তখনই এই ঘটনা দেখা যায়। তাই তার পরের অমাবস্যাতে সূর্যগ্রহণের সম্ভাবনা খুবই বেশি! তা একেবারেই কাকতালীয় নয়। কোনও অলৌকিক ঘটনা বা বিপর্যয় নয়।
এ সব কিন্তু নতুন নয়। ষষ্ঠ শতাব্দীর ভারতীয় গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্যভট্ট অঙ্কের যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছিলেন সূর্যগ্রহণ পৃথিবীর নির্দিষ্ট স্থানে চাঁদের ছায়া পড়ার কারণে ঘটে। তিনি অবশ্য তুলসীপাতার বিষয়ে কিছু বলেননি।
তেমনই চন্দ্রগ্রহণ হল চাঁদে পৃথিবীর গ্রহণের ছায়ামাত্র। পৃথিবীর উপর সে দিন আপনি যথাযথ জায়গায় থাকলে এই গ্রহণ বা ছায়াআঁধার দেখতে পাবেন। অন্যথায় নয়।
একটি সংবাদপত্রে এক ‘নিজস্ব সংবাদদাতা’ লিখেছেন— ধর্মীয় পুরাণে উল্লেখ ছাড়াও গ্রহণকালে জল বা খাবারে তুলসীপাতা দেওয়ার যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক কারণ আছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আর সেই ‘বৈজ্ঞানিক’ কারণ হিসাবে সংবাদদাতার ব্যাখ্যা, গ্রহণের সময়ে পরিবেশের বিভিন্ন জীবাণুরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তাদের খালি চোখে দেখা যায় না, বায়ুমণ্ডলে মিশে থাকা এমন কীটগুলির থেকে নিজেদের রক্ষা করতে তুলসীপাতা ব্যবহার করা যেতেই পারে!
অনেক চেষ্টাতেও এই ব্যাখ্যা বুঝলাম না। রাতে তো গ্রহণের চেয়ে বেশি অন্ধকার হয়। তখন এই জীবাণুগুলো যায় কোথায়? রাতে কি খাওয়াদাওয়া নিষেধ? তা হলে? গ্রহণের ছায়াসৃষ্ট আঁধারের কী বিশেষ দোষগুণ আছে? আর গ্রহণের সময় পরিবেশে জীবাণুসংখ্যা বাড়ে কি না, এ তো সহজেই পরীক্ষা করে দেখা যায়। এ নিয়ে বহু পরীক্ষা হয়েওছে, কিছুই পাওয়া যায়নি। বরং আমার বাগানের তুলসীগাছেই দেখি কীট পিলপিল করছে।
কেন গ্রহণের সময় খাবার সংক্রমিত হয়, টেলিভিশন আর ইন্টারনেটে সর্বত্র দৃশ্যমান এক জনপ্রিয় গুরু তার এক আজব যুক্তি দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য— চাঁদ এই গ্রহণের সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে পূর্ণিমা থেকে অমাবস্যা পর্যন্ত পুরো কলাচক্রের মধ্যে দিয়ে যায়! তাই চন্দ্রগ্রহণের কাল আসলে দু’সপ্তাহের সমান। তা কোনও খাবার ১৪ দিন ফেলে রাখলে খারাপ তো হবেই! আমরা জানতাম, গল্পের গরু গাছে ওঠে, সে চাঁদেও যায়?
অনেক সময় প্রাচীন জ্ঞানকে উচ্চতর বিজ্ঞতার শামিল ধরা হয়। তখন নাকি সব জ্ঞান-বিজ্ঞানই সকলেরই জানা ছিল ইত্যাদি। অথচ একশো বছর আগে আমাদের প্রপিতামহের আমলে অ্যান্টিবায়োটিক পর্যন্ত ছিল না, সামান্য অসুখে মৃত্যু হত। আমাদের শরীর কী ভাবে চলে তাই জানতেন না অধিকাংশ মানুষ। সে সময় লোকে না জেনেবুঝে গ্রহণের দিন কী করতেন আর কী না করতেন, তা এখন প্রাসঙ্গিক হবে কেন?
এই সব সংস্কার প্রাচীন সেই সব সময় থেকে আসছে যখন আমাদের পূর্বপুরুষেরা জানতেনই না চাঁদ-সূর্য আসলে কী, সেগুলি আমাদের থেকে কত দূরে আছে, আমাদের উপর তাদের প্রভাব কতটা হতে পারে। সে জমানায় বিজ্ঞান, দূরবিন, কম্পিউটার কোথায়? স্বাভাবিক ভাবেই সম্যক জ্ঞানের অভাবে মানুষের মনে ছিল ভয়। তাঁরা ভেবে নিয়েছিলেন, জ্বলন্ত সূর্য হয়তো দেবতা, ঘোড়ায় চড়ে আকাশ পার করেন।
বিজ্ঞানের যুগের আগে থেকে এই যে সব প্রাচীন জ্ঞান, এদের অনেকেরই বৈধতার মেয়াদ বহু দিন উত্তীর্ণ। এ সব ধারণাকে অন্ধ ভাবে বিশ্বাস করার আগে একটু তো বাজিয়ে নিতেই হবে।
এই ‘অবিজ্ঞান’ আসলে মূলধারার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রত্যাখ্যান। অথবা, অপ্রমাণিত বা ইচ্ছাকৃত ভাবে বিভ্রান্তিকর তত্ত্ব দিয়ে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিস্থাপন। এ সব ধারণা কোনও পরিবার বা সামাজিক গোষ্ঠীর উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কুসংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রায়শই রাজনৈতিক লাভের জন্য এ সবের প্রচার হয়।
অবিজ্ঞানের ধ্বংসাত্মক পরিণতির এক আদর্শ উদাহরণ জোসেফ স্তালিনের অধীনে ট্রোফিম লাইসেঙ্কো-র বিজ্ঞানবিরোধী তত্ত্বপ্রয়োগের ফলে ফসল বিপর্যয়। তার পরিণামেই লক্ষ লক্ষ কৃষকের দুর্ভিক্ষের কারণে মৃত্যু হয়।
আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের তৎকালীন সরকারের বিজ্ঞানবিরোধী বিভ্রান্তিমূলক প্রচারের ফলও আমরা দেখেছি। অতিমারির তীব্রতার অবমূল্যায়ন, কোভিডজনিত মৃত্যুর অন্যান্য কারণ নির্দেশ করা, হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের মতো অপ্রমাণিত ওষুধের প্রচার, মাস্ক-এর বিজ্ঞানসম্মত গুরুত্ব কমিয়ে দেখানো— এ সবের ফল লক্ষ লক্ষ মৃত্যু। ব্রাজিল, মেক্সিকো, ফিলিপিন্সেও একই ঘটনা। আমাদের দেশে অনেক এলাকায়, স্থানীয় নেতারা বিজ্ঞানকে উপেক্ষা করে কোভিড নিরাময়ের জন্য গোবর, কর্পূর, আরও কত কী ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছিলেন। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনকে অস্বীকার থেকে কোভিডের টিকা প্রত্যাখ্যান— বিজ্ঞানবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির ফলে সভ্যতার আসন্ন বিপর্যয়ের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে সর্বত্র।
গ্রহণের প্রসঙ্গে ফিরি। চন্দ্র আর সূর্যগ্রহণ বিরল আর অসাধারণ দৃশ্য— কিছু অজ্ঞ মানুষের কুসংস্কারের কারণে নিজেকে বঞ্চিত করবেন না। এ বার চন্দ্রগ্রহণ হলে, বেরিয়ে আসুন এক কাপ চা আর প্লেটে জলখাবার নিয়ে। পূর্ণচাঁদের দিকে তাকিয়ে ছায়ার মায়াখেলা উপভোগ করুন।
ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজ়িক্স (আয়ুকা), পুণে
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy