—প্রতীকী ছবি।
বিশ্বখ্যাত ভারতীয় টেনিসতারকাকে ভারতখ্যাত সংবাদ উপস্থাপক জিজ্ঞেস করেছিলেন, টেনিসতারকা কখন ‘সেট্ল ডাউন’ করবেন? কবে মা হবেন? তারকার সংযত প্রতিপ্রশ্ন ছিল, “আপনি কি মনে করেন না আমি ইতিমধ্যেই সেট্ল ডাউন করেছি?” তারকা ছিলেন সানিয়া মির্জ়া। প্রশ্নকর্তা ক্ষমা চেয়ে বলেন, পুরুষ খেলোয়াড়কে এই প্রশ্ন করতেন না। সানিয়া প্রশ্ন তুলেছিলেন, “কতগুলো উইম্বলডন জিতলে, কত বার বিশ্বসেরা হলে মহিলা খেলোয়াড় সেট্ল ডাউন করেছেন বলে মনে করা হবে?” দুর্ভাগ্যের বিষয়, ভারতীয় সমাজ স্ত্রী ও গর্ভধারিণী না হলে নারীকে ‘সফল ও প্রতিষ্ঠিত’ বলে মানে না। এমনকি লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণের পরও সমাজমাধ্যমে ভাইরাসের মতো প্রশ্ন ছেয়েছিল— কেন বিবাহ করেননি? অসফল প্রেমের গল্প আছে?
১২ জুন ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’ লিঙ্গ ব্যবধানের তালিকা প্রকাশ করেছে। তাতে প্রমাণিত, বিশ্বে নারী-পুরুষের লিঙ্গসাম্য দিবাস্বপ্ন। আগামী ১৩৪ বছরে এই বৈষম্য দূর হওয়ার আশা নেই। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ, শিক্ষায় প্রাপ্তি, স্বাস্থ্য, রাজনৈতিক সামর্থ্য— কোথাও নারী-পুরুষ সমস্তরে নেই। মেয়েরা অধিকারে, অর্জনে, উপভোগে সর্বত্র পিছিয়ে। সংসারজীবনে সেবিকা রূপে সফল না হলে পেশায় বা জীবনের অন্যান্য দিকে সাফল্য সমাজে স্বীকৃত নয়। অথচ সেই বহুবন্দিত সংসারেও নারীকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমানাধিকারের দিক থেকে পুরুষের সমকক্ষ মনে করার সুস্থ চেতনা সমাজপতিরা অর্জন করতে পারেননি।
২০২৩-এ ভারত লিঙ্গ ব্যবধানের তালিকায় ১৪৬টি দেশের মধ্যে ১২৭তম ছিল, ২০২৪-এ হয়েছে ১২৯তম। এগোবার বদলে দু’ধাপ পিছিয়ে বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটানের নীচে রয়েছে। এখন ভারতে লিঙ্গ ব্যবধান ৬৪.১%। সরকারের নজরে এটি দেশকে ‘নীচা’ দেখানোর চক্রান্ত। কিন্তু অস্বীকারের উপায় নেই যে দিনে দিনে ভারতীয় নারী-স্বাধীনতা, স্বাধিকার, সম্মান এবং নিরাপত্তা হারাচ্ছেন। বাল্যবিবাহ, অকালমাতৃত্ব, ধর্ষণ, গার্হস্থ হিংসার থাবা থেকেও মুক্তি মেলেনি। উল্টে স্বাধীনতা আন্দোলন এবং বিভিন্ন নাগরিক সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতীয় পুরুষ সামন্ততান্ত্রিকতা থেকে মুক্তমনস্কতার দিকে যেটুকু এগিয়েছিল, সেই গতিমুখও আবার বিপরীতে বদলে গিয়েছে। এতটা রক্ষণশীলতায় নারীকে ‘সহযাপক’ হিসাবে সসম্মানে গ্রহণ কঠিন।
করোনাকালে কর্মহীনতার সঙ্গেই বেড়েছিল নারীর বিরুদ্ধে হিংসা। সঙ্গে মন্দা, ঋণকষ্টে বহু দেশ পীড়িত। ফলে মেয়েরা আরও দারিদ্র, আরও অসম্মানের কবলে। বিশ্বের ৯০% মহিলা পরিবারের খাবার তৈরিতে সবচেয়ে বেশি জড়িত। অথচ অপুষ্টি, জলের স্বল্পতার অভিশাপ তাঁদের উপরে নেমে আসে সবেগে। কৃষিকাজে নারী পুরুষের সমান শরিক। কিন্তু জমির মালিকানা, কৃষক সমিতিতে নারী-প্রতিনিধিত্ব আণুবীক্ষণিক। গার্হস্থ শ্রমকে ‘উৎপাদনমূলক’ কাজের মর্যাদা দিয়ে উপার্জনের আওতায় আনা যায়নি। নারীকে ‘মাতৃত্ব’ দিয়ে বিচারকারী ভারত প্রজনন-স্বাস্থ্যে চির উদাসীন। মা-শিশুর অপুষ্টি, যৌন রোগ, ঋতুস্রাবের সমস্যা, প্রসূতি-মৃত্যু ইত্যাদি রাষ্ট্রের সমস্যা-সারণিতে গুরুত্ব পায় না। ১৫-৪৯ বছরের প্রায় ২০% নারীর ওজন প্রয়োজনের চেয়ে কম, ৫৩% নারী রক্তাল্পতায় ভুগছেন।
শ্রমের বাজারে অংশগ্রহণ, ক্ষমতায়ন ইত্যাদিতে শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। সাক্ষরতার হারে পুরুষের চেয়ে মেয়েরা বিশ্রী রকম পিছিয়ে (১৭.২%)। ‘অর্থনৈতিক লিঙ্গসমতা’য় ভারত বিশ্বে তলানিতে (৩৯.৮%)। মহিলাদের অধিকাংশই অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন, পুরুষের রোজগারের অর্ধেকও পান না। শ্রম-আয়ের ৮২% পুরুষেরই দখলে।
সংসদে গত বার গিয়েছিলেন ৭৮ জন মহিলা জনপ্রতিনিধি। এ বার সেখানে ‘ভারত কি বেটি’ কমে হয়েছেন ৭৪। অর্থাৎ জনসংখ্যার অর্ধেকের প্রতিনিধিত্বে মাত্র ১৩.৬% নারী। অন্তত মেয়েদের সমস্যা তুলে ধরতে আইনসভায় তাঁদের প্রতিনিধিত্ব বাড়া জরুরি। পঞ্চায়েতে সেই প্রতিনিধিত্বই রয়েছে কেবল ‘অঙ্গুঠা ছাপ’-এর খাতায়। আসল শাসন চলছে ‘স্বামী’য়ানার নীচে। স্থলবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীতে নারী যথাক্রমে ৩.৮%, ৬%, ১৪%। অথচ প্রজাতন্ত্র দিবসে ‘নারীশক্তি’র ঢক্কানিনাদের শেষ নেই। সুপ্রিম কোর্টে নারী বিচারপতি মাত্র ৯.০৯%, হাই কোর্টগুলিতে ১৩.৫%। পরিসংখ্যানের নামে কেবলই পরিণতিহীন পরিতাপ।
কিন্তু যে দেশে কাঠুয়া গণধর্ষণের বিচার বিলম্বিত হয়ে বিলাপে পর্যবসিত, উন্নাওয়ের নির্যাতিতার পরিবার খুন হয়, বিলকিসের ধর্ষকরা মালা পরে জেলের বাইরে আসে, বিভিন্ন সামাজিক দ্বন্দ্বে প্রথম নিগৃহীত হন মেয়েরা— সেখানে নারীর অবস্থা ও অবস্থান জানতে পরিসংখ্যান লাগে না। প্রশ্ন হল, আলোকপ্রাপ্ত নারীরাও কি সমাজের সেই অন্ধকারে ‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ হয়ে পৌঁছতে চান, যেখান থেকে তাঁরা উঠে এসেছেন? নারীর সপক্ষে প্রবল আন্দোলন গড়ে তুলতে ‘সফল’ নারীরা কি সকলেই প্রস্তুত? তথাকথিত শিক্ষিতারাও অনেকেই পুরুষের অতি-অধিকারের নীরব সমর্থক। সংসদের সেই ১৩.৬% নারী কি বাকি মেয়েদের উন্নতির জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাবেন? ঈশ্বরচন্দ্র, রামমোহনদের খোয়াব আর কেউ দেখে না। কিন্তু সরলা দেবী, বেগম রোকেয়াদের নবজন্মের আশাও কি আর আছে?
বাকি বিশ্ব হয়তো ১৩৪ বছরে লিঙ্গসাম্যে পৌঁছে যাবে। আর আমরা?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy