বিচারার্থী: বিলকিস বানোর ঘটনায় সুবিচারের আর্জিতে, কলেজ স্ট্রিট, কলকাতা, ২০ অগস্ট ২০২২। ছবি: পিটিআই।
দেখতে দেখতে আবার একটা বছর ঘুরতে চলল! তবে সময়ের সঙ্গে সব কিছুই কি ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে ফেলে দেওয়া যায়? কিছু কিছু জিনিস ব্যক্তিস্মৃতি ছাড়িয়ে জাতিস্মৃতিতে জায়গা নিয়ে নেয়। যেমন, বিলকিস বানোর কাহিনি। দাঙ্গা-কবলিত গুজরাতে ২০০২ সালের ৩ মার্চ পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা বিলকিসকে গণধর্ষণ করা হয়, অত্যাচারের জেরে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। তাঁর তিন বছরের মেয়েকে মেরে ফেলা হয়, খুন করা হয় তাঁর ১৪ জন আত্মীয়কেও। এত কিছুর পরেও ২১ বছরের সেই মেয়ে কী ভাবে প্রাণে বেঁচে বাইরের পৃথিবীকে রক্তলিপ্ত সেই আখ্যান শোনান, গত ২২ বছর ধরে ভারতীয় গণতন্ত্র তার সাক্ষী থেকেছে।
সেই ঘটনার বেশ কয়েক বছর পরে এই গণতন্ত্রই আবার সাক্ষী থাকবে, ওই ঘটনা যারা ঘটিয়েছিল, যে ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে তারা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা শুনেছিল, সেই তাদেরকেই এই সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার অনেক আগে মু্ক্তি দেওয়া হল। মুক্তির দিন জেলের বাইরে তাদের মালা পরিয়ে, মিষ্টি খাইয়ে বরণ করে নেওয়া হল। সেই উদ্যাপনের আবহে কয়েক জন আবার ব্রাহ্মণ্যবাদের জয়ধ্বনি তুলে নিদান দিলেন, দোষীরা ব্রাহ্মণ সন্তান, তারা কোনও খারাপ কাজ করতেই পারে না। এক বিজেপি বিধায়ক ওই অপরাধীদের ‘সংস্কারী’ আখ্যাও দিলেন। দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত ১১ জনের মধ্যে জেল থেকে মুক্তির আর্জি জানিয়েছিল মাত্র এক জন। কিন্তু পরে গুজরাত সরকারের সংশ্লিষ্ট কমিটি ১১ জনকেই মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁর জীবন যারা ছারখার করে দিয়েছিল, ভুবনজোড়া অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছিল তাঁকে, সেই তারাই যখন জেল থেকে হসিমুখে বেরিয়ে এল, সেই ছবি দেখে বিলকিস মন্তব্য করেছিলেন: “গত ২০ বছরের আতঙ্ক আবার আমাকে গ্রাস করল।”
এর কিছু দিন বাদে আইনের রক্ষক হয়ে দাঁড়াল সেই সুপ্রিম কোর্টই। এ ক্ষেত্রে অন্তত বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদেনি। ২০২২-এর ১৪ অগস্ট গোধরার জেল থেকে ধর্ষক ও খুনিরা ছাড়া পাওয়ার পরে সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ মামলা দায়ের হয় সুপ্রিম কোর্টে। এ বছরের জানুয়ারিতে সেই মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দেয়, অপরাধীদের ফের জেলে যেতে হবে। এ ব্যাপারে কোনও ওজর-আপত্তি সুপ্রিম কোর্ট কানে তোলেনি। এই মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্টের কয়েকটি মন্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন, বিচারপতি বি ভি নাগরত্ন বলেছেন, “আইনের শাসনের অর্থ কয়েক জন ভাগ্যবানকে রক্ষা করা নয়।” বিচারপতি নাগরত্ন ও বিচারপতি উজ্জ্বল ভুঁইয়ার বেঞ্চ তার রায়ে বলে, গুজরাত সরকার ‘অপরাধীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে’ তাদের অনৈতিক কাজে যোগ দিয়েছিল। গোটা ঘটনায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও তাদের দায় এড়াতে পারে না। কারণ, গুজরাত সরকারের ওই সিদ্ধান্তে ২০২২-এর ১১ জুলাই সিলমোহর দিয়েছিল তারা।
এই আবহে সুপ্রিম কোর্টের রায় কেন সুদূরপ্রসারী? কারণ, দেশের সর্বোচ্চ আদালত ফের এক বার আইনের শাসনের কথা শুনিয়েছে। দেশের সংবিধানের প্রতি বিচারব্যবস্থার দায়বদ্ধতার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। সর্বোপরি, সাধারণ মানুষের মনে কিছুটা হলেও এই বিশ্বাসটা ফেরাতে পেরেছে যে, যাদের আশীর্বাদের হাতই অপরাধীদের উপর থাকুক না কেন, মানবসভ্যতার পক্ষে বিপজ্জনক সেই লোকগুলিকে তাদের কাঙ্ক্ষিত মুক্তির স্বাদ দিতে নারাজ দেশের সর্বোচ্চ আদালত।
এমনিতেই তথাকথিত বন্দিত্বের সময়ে এই অপরাধীরা এক হাজার দিনেরও বেশি প্যারোলে ছাড়া ছিল। প্যারোলে থাকাকালীন তাদের অনেকে নানা দুষ্কর্মেও জড়িত ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। কারও কারও বিরুদ্ধে এফআইআর-ও দায়ের হয়। জেলে থাকাকালীন এই ব্যক্তিরা নাকি এত ‘ভাল ও ভদ্র’ হয়ে ছিল যে, মেয়াদ শেষের আগেই তাদের মুক্তির আদেশ দিয়ে দেয় গুজরাত সরকার! অথচ, সুপ্রিম কোর্ট বলছে, এই মুক্তির আদেশ দেওয়ার কোনও এক্তিয়ারই নেই গুজরাত সরকারের। তা ছিল একমাত্র মহারাষ্ট্র সরকারের, যে-হেতু সেখানেই এই মামলার বিচার হয়েছে। গুজরাত সরকার সম্পূর্ণ এক্তিয়ারবহির্ভূত ভাবে এই নির্দেশ দিয়েছে।
এই রায়ের পরে বিলকিস বানোর প্রতিক্রিয়া কী ছিল? তাঁর কথায়: “বুক থেকে পাহাড় নামল। আবার শ্বাস নিতে পারছি।” কিন্তু ক্ষমতাবানদের, প্রভাবশালীদের পক্ষে বিলকিসের এই মুক্তির শ্বাস নেওয়া সহ্য হবে তো? সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের ‘সবক’ শিখিয়েছে। ঘাড়ে ধরে উপলব্ধি করিয়েছে, উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ আইনের চোখে নেই। কিন্তু ‘সিস্টেম’ বিলকিসদের নিরাপদে থাকার সুযোগ দেবে তো?
এই প্রসঙ্গেই অবশ্য ভিন্নতর একটি ছবিও চোখের সামনে ভেসে উঠছে। উমর খালিদ-সহ আরও বেশ কয়েক জন বিচারের অপেক্ষায় দীর্ঘ দিন ধরে কারান্তরালে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা উমর খালিদকে দিল্লির সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামায় জড়িত থাকার অভিযোগে ২০২০-র সেপ্টেম্বরে গ্রেফতার করেছিল দিল্লি পুলিশ। কুখ্যাত বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনের (ইউএপিএ) বেশ কয়েকটি ধারা তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে পুলিশ। সেই থেকে তিনি জেলেবন্দি। তাঁর জামিনের আর্জি সুপ্রিম কোর্টে অন্তত চোদ্দো বার নানা কারণে স্থগিত হয়ে গিয়েছে। জামিনের আর্জি ছাড়াও ইউএপিএ-র জামিন সংক্রান্ত কয়েকটি ধারাকেও সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন উমর। কিন্তু অতি সম্প্রতি তাঁর আইনজীবী কপিল সিব্বল সুপ্রিম কোর্টে আর্জি জানিয়েছেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি’তে তাঁরা সুপ্রিম কোর্ট থেকে সরিয়ে নিম্ন আদালতে জামিনের আবেদন জানাতে চান। সেখানেই তাঁরা তাঁদের ভাগ্য পরীক্ষা করবেন। জামিনের আর্জি সরানোর অনুমতিও তাঁরা পেয়েছেন।
স্ট্যান স্বামীর কথাও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যাক। ঝাড়খণ্ডের এই জেসুইট ফাদারকে ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় এনআইএ গ্রেফতার করেছিল তাঁর রাঁচীর বাড়ি থেকে। এই মামলায় অভিযুক্ত অন্য বিদ্বজ্জন-কবি-আইনজীবী-মানবাধিকার কর্মী-অধ্যাপকদের সঙ্গে তাঁকেও রাখা হয়েছিল জেলে। গুরুতর অসুস্থ স্ট্যান স্বামী বার বার তাঁর জামিনের আর্জি জানান। মৃত্যুর মাত্র এক সপ্তাহ আগে নবি মুম্বইয়ের তালোজা জেল থেকে ভিডিয়ো কনফারেন্সে বম্বে হাই কোর্টের বিচারপতির উদ্দেশে হাতজোড় করে কাঁপা গলায় স্ট্যান জানিয়েছিলেন, জেলে দ্রুত তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। চিকিৎসার জন্য অন্তর্বর্তী জামিন না পেলে তিনি মারা যাবেন। তবুও জামিন পাননি তিনি। জামিনের আর্জির শুনানির দিন স্ট্যানিস্লাস লার্ডুস্বামীর আইনজীবী কোর্টে জানান, ফাদারের আর জামিনের প্রয়োজন নেই। জেল হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে তাঁর।
আমাদের ঘরের কাছের কামদুনির সেই নারীকে গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় দোষীদের মধ্যে দু’জনের ফাঁসির সাজা রদ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় হাই কোর্ট। তৃতীয় জনকে মুক্তির নির্দেশ দেয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছেন প্রতিবাদীরা ও রাজ্য সরকার। সেই মামলার শুনানি ও রায় যত দ্রুত সম্পন্ন হবে, ততই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন বিচারপ্রার্থীরা। এ রকম উদাহরণ আরও অনেক আছে। বিলকিস বানোর মামলায় এই রায় স্বাগত, কিন্তু পাশাপাশি আদালতের এই তৎপরতা ও আইনের শাসন মেনে চলতে বাধ্য করার লৌহমুষ্টি সব ক্ষেত্রেই দেখালে অনন্ত প্রতিস্পর্ধা নিয়ে অনাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো মানুষগুলো আরও একটু শক্তি পায়। কেবল গুজরাতে নয়, পশ্চিমবঙ্গেও। একটা সুবিচার দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দেশজোড়া বর্বরতার সামনে।
তা না হলে গুজরাতের ‘সংস্কারী’ ধর্ষক এবং পশ্চিমবঙ্গের সন্দেশখালির বেতাজ বাদশা শেখ শাহজাহানরা শুধু ‘সিস্টেম’-এরই নন, গণতন্ত্রেরও ‘অপরিহার্য অঙ্গ’ হয়ে ওঠেন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy