Advertisement
০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
চার উপনির্বাচন তৃণমূলের কাছে হেরে না-যাওয়ার চ্যালেঞ্জ
Politics

জয় এবং কিছু বার্তা

প্রথমে কেন্দ্রগুলির জনমত-চিত্রের দিকে তাকানো যাক। একটু ফিরে দেখলে স্পষ্ট হবে, যে চারটি বিধানসভা কেন্দ্রে এখন ভোট হচ্ছে, ২০২১-এর বিধানসভা ভোটের নিরিখে তার একটি মাত্র তৃণমূলের দখলে ছিল।

—প্রতীকী ছবি।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০২৪ ০৮:১৫
Share: Save:

লোকসভা ভোটের জের না কাটতেই চারটি বিধানসভার উপনির্বাচন চলে এল। সাধারণত একটি বড় নির্বাচনের পরে ছোট, অর্থাৎ এ রকম উপনির্বাচন হলে তা নিয়ে বড় একটা মাথা ঘামানোর প্রয়োজন হয় না। আগের হাওয়াতেই পরের ভোট মোটামুটি উতরে যায়। কিন্তু এ বারের পরিস্থিতি ঠিক তত সহজে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। বরং, লোকসভা ভোটের তথ্য ও সংশ্লিষ্ট বিধানসভা কেন্দ্রগুলির রাজনৈতিক বিন্যাসের দিকে তাকালে এক নজরে মনে হচ্ছে যে, এই চারটি উপনির্বাচনের ফলাফল রাজ্য রাজনীতিতে নানা দিক দিয়ে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রা নিতে পারে। যার অভিঘাত শুধুমাত্র বাইরেই নয়, তৃণমূলের অন্দরেও অর্থবহ হয়ে উঠতে বাধ্য।

প্রথমে কেন্দ্রগুলির জনমত-চিত্রের দিকে তাকানো যাক। একটু ফিরে দেখলে স্পষ্ট হবে, যে চারটি বিধানসভা কেন্দ্রে এখন ভোট হচ্ছে, ২০২১-এর বিধানসভা ভোটের নিরিখে তার একটি মাত্র তৃণমূলের দখলে ছিল। সেটি উত্তর কলকাতার মানিকতলা। বাকি তিনটিতেই জিতেছিল বিজেপি। পরে দল ভেঙে রায়গঞ্জের কৃষ্ণ কল্যাণী, রানাঘাট (দক্ষিণ)-এর মুকুটমণি অধিকারী এবং বাগদার বিশ্বজিৎ দাস তৃণমূলে যোগ দিয়ে রাজনীতির অঙ্গনে শাসক দলের বিধায়ক হিসাবে গণ্য হয়েছেন।

আবার ওই তিন জনই লোকসভায় তৃণমূলের প্রার্থী হয়ে সদ্য হেরেছেন। তার চেয়েও বড় কথা, এঁদের সকলের এ বার নিজেদের ছেড়ে আসা বিধানসভা কেন্দ্রগুলিতে বিজেপির কাছে পরাজয়ের ব্যবধান ২০২১-এর চেয়ে অনেক বেড়ে গিয়েছে। যদিও কৃষ্ণ ও মুকুটমণিকেই তাঁদের পুরনো দুই কেন্দ্রে বিধানসভা উপনির্বাচনে ফের বেছে নিয়েছে তৃণমূল। শোনা যায়, এই উপনির্বাচনে লড়তে বিশ্বজিৎ নাকি রাজি হননি। সেখানে তৃণমূলের নতুন প্রার্থী মতুয়া-ঠাকুরবাড়িরই মেয়ে মধুপর্ণা।

বিজেপির টিকিটে ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে কৃষ্ণ রায়গঞ্জে তৃণমূলকে হারিয়ে জিতেছিলেন প্রায় একুশ হাজার ভোটে। এ বার লোকসভায় তৃণমূলের প্রার্থী হয়ে সেই রায়গঞ্জ বিধানসভা ক্ষেত্রটিতেই বিজেপির কাছে তাঁর পিছিয়ে থাকার ব্যবধান ৪৭,০০০ ছুঁইছুঁই। মুকুটমণি গত বিধানসভায় তাঁর কেন্দ্রে তৃণমূলকে হারিয়েছিলেন ১৬,৫০০ ভোটে। এ বারের লোকসভা নির্বাচনে সেই রানাঘাট দক্ষিণ বিধানসভা ক্ষেত্রে বিজেপি তাঁর চেয়ে প্রায় ৩৭,০০০ ভোটে এগিয়ে ছিল। একই ভাবে ২০২১-এ বাগদা বিধানসভায় বিজেপিতে থাকা বিশ্বজিতের জয়ের ব্যবধান ছিল ৯৭৯২। এ বার লোকসভায় তৃণমূলের প্রার্থী হয়ে এই বিধানসভা ক্ষেত্রে তিনি ২০৬১৪ ভোটে বিজেপির কাছে পিছিয়ে।

রাজ্যের শাসক দলের এগিয়ে থাকা একমাত্র কেন্দ্র মানিকতলাতেও লোকসভার নিরিখে ভোটের ব্যবধান গত বিধানসভার চেয়ে অনেকটা কম। রাজ্যের প্রয়াত মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে বিধানসভায় এখান থেকে একটানা জিতে আসার রেকর্ড গড়েছিলেন। গত বারেও কুড়ি হাজারের বেশি ভোটে জিতেছিলেন তিনি। তবে লোকসভায় এ বারেও জয়ী তৃণমূলের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় মানিকতলায় বিজেপির তাপস রায়ের থেকে মাত্র সাড়ে তিন হাজারে এগিয়ে।

পরিসংখ্যানগুলি ভেবে দেখার। কারণ লোকসভার এই জয়-পরাজয়গুলির পিছনে বহু যুক্তি-তর্ক-ব্যাখ্যা রয়েছে। রানাঘাট ও বনগাঁ-তে মতুয়া ভোট তৃণমূলের পক্ষে না-যাওয়া, রায়গঞ্জে সংখ্যালঘু ভোটে কংগ্রেসের ভাগ বসানো, কলকাতা-উত্তরে তৃণমূলের একাংশের অন্তর্ঘাতের চেষ্টা, শহরাঞ্চলগুলিতে তৃণমূলের ভোট-ভিত আলগা হওয়ার প্রবণতা ইত্যাদি নানা উপকরণে সেগুলি সাজানো। কারণগুলি হয়তো উড়িয়ে দেওয়ারও নয়। তা সত্ত্বেও, তৃণমূল রাজ্যে সামগ্রিক ভাবে ২৯টি আসনে জিতে বিজেপি-কে ১২টিতে বেঁধে ফেলায় দলীয় নেতৃত্ব যে ভোটের ফলকে কর্মী-সমর্থকদের ‘মনোবল’ বৃদ্ধির টনিক হিসাবে ব্যবহার করতে চাইবেন, তাতে সংশয়ের কিছু নেই। বিশেষত ২০২৬-এর বিধানসভা ভোট মাথায় রাখলে তাঁদের পক্ষে এটা তো খুবই স্বাভাবিক।

তবে বিপরীত অবস্থাটিও দৃষ্টি এড়ানোর নয়। ঠিক সেখানে আসন্ন চার উপনির্বাচন তৃণমূলের সামনে এই মুহূর্তে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। সোজা কথায়, হেরে না-আসার চ্যালেঞ্জ। কারণ, সবাই বোঝেন, লোকসভায় সদ্য বিপুল আসন জয়ের পরেই এই উপনির্বাচনগুলিতে তৃণমূল যদি ভাল ফল দেখাতে না পারে, তা হলে লোকসভায় হতোদ্যম হয়ে পড়া বিজেপি সেই পরিস্থিতির ‘সদ্ব্যবহার’ করতে ঝাঁপাবে। তৃণমূলের আম-পাবলিকের মনেও তার একটি প্রতিক্রিয়া হবে। রাজনৈতিক তত্ত্ব বা ভোটের অঙ্ক-শাস্ত্র দিয়ে যার মোকাবিলা করার কাজটি জটিল। সত্যি বলতে, নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের আবডালে থাকা বিজেপির রাজপুরুষেরা ‘সময়’ বুঝেই কেন্দ্র বেছে ভোটের চালটি চেলেছেন।

লোকসভা ভোটের ফলের প্রেক্ষিতে রাজ্যে মোট ন’টি বিধানসভা আসন খালি হয়েছে। সঙ্গে রয়েছে দীর্ঘ দিন মামলায় আটকে থাকা মানিকতলা। রাজনীতির ছকেই তৃণমূল চেয়েছিল দশটিতে এক সঙ্গে উপনির্বাচন হোক। তাতে হয়তো সংখ্যায় তাদের সুবিধা হতে পারত। কারণ লোকসভা ভোটের প্রবণতা অনুযায়ী ওই দশটির নিরিখে অধিকাংশে তাদের আধিপত্য বজায় রাখার সম্ভাবনা তুলনায় বেশি। এ সব চেনা রাজনীতি।

কিন্তু যেটা দৃষ্টিকটু, তা হল নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা। একই লোকসভা ভোটে খালি হওয়া ন’টি বিধানসভার মধ্যে এমন তিনটিকে এই উপনির্বাচনের জন্য নির্দিষ্ট করা হল, যেগুলিতে তৃণমূলের লড়াই দৃশ্যত কঠিন। তথাকথিত ‘নিরপেক্ষ’ কমিশনের এই সিদ্ধান্ত তাই প্রশ্ন জাগায়। কেউ একে কুশলী ভেদ-বিচার বলতেই পারেন।

লোকসভার ভোটে দেশে ২৪০ এবং বঙ্গে ১২ পাওয়া বিজেপির এ বার বিজয়োল্লাস করার জ্বালা অনেক। এই প্রথম শরিকদের কাঁধে ভর করে নরেন্দ্র মোদীকে সরকারে বসতে হয়েছে। রামলালা-র অযোধ্যা থেকে মোদীর বারাণসী— কোথাও বিজেপি চওড়া হাসি হাসতে পারেনি। অপর দিকে কংগ্রেস নিজেদের আসন প্রায় দ্বিগুণ করে নিতে পেরেছে। নস্যাৎ হয়েছে কংগ্রেস সম্পর্কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চল্লিশ পেরোবে না’-র ভবিষ্যদ্বাণীও। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট হলে তৃণমূলের আসন সম্ভবত আরও কয়েকটি বাড়ত। আপাতত সেই পর্বও অতীত।

তবে দেশজোড়া ভোট-পণ্ডিতদের প্রায় কেউই এ বার তৃণমূলের জন্য ২৯ আসন বরাদ্দ করেননি। অতএব রাজ্যে তৃণমূলের উৎসব করার যুক্তি রয়েছে। ২১ জুলাইয়ের সমাবেশ অবশ্যই তার এক প্রকৃষ্ট পরিসর। ঠিক তার আগে ১০ জুলাই ওই চার উপনির্বাচন। ১৩ জুলাই ফল প্রকাশ। এখানেও কি ‘ক্রোনোলজি’? সে সব হয়তো শাহজি জানবেন! সোজা বুদ্ধিতে আমরা বুঝি, লোকসভার পরে এ বারের ২১ জুলাইয়ের সমারোহ চেহারা-চরিত্রে অধিক ‘চমকদার’ করে তোলা প্রকৃতপক্ষে তৃণমূলের আরও একটি পরীক্ষা। দুয়ারে উপনির্বাচন যেন তারই প্রশ্নপত্র!

ঠিক এই সময়েই দলের কাজ থেকে সাময়িক অব্যাহতি নিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কত দিনের জন্য, তা বলেননি। শুধু বলেছেন, চিকিৎসার কারণে তাঁর এই ‘স্বল্প’ সরে থাকা। যে কারও পক্ষেই এমন ছুটির প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু স্মৃতি বলে, তাঁর ক্ষেত্রে অতীতে কখনও এ ভাবে ঘোষণা করে ‘ছুটি’ নেওয়ার নজির নেই। জল্পনাও তাই থেমে নেই। জল্পনার সূত্র তাঁরই দেওয়া বার্তা।

লোকচক্ষে মমতার পরেই দলে অভিষেকের অবস্থান। সংগঠনে তাঁর ছায়া এখন দীর্ঘ। লোকসভা ভোট পর্যন্ত তাঁর নেতৃত্বের প্রসার ও প্রতিফলন দেখা গিয়েছে। এই জয়ে তিনি প্রশংসা পেয়েছেন স্বয়ং তৃণমূল নেত্রীর। তিনিই ছুটি নেওয়ার সময় বার্তা দিয়েছেন, অবকাশে থাকাকালীন তিনি সাধারণ মানুষের ‘প্রয়োজনের দিকগুলি’ খতিয়ে দেখবেন। তিনি চান, কেন্দ্র-রাজ্য ‘সংঘাত’-এ গৃহহীনদের আবাস (যোজনা) যেন ‘অবহেলা’র শিকার না হয়। এমনকি, তৃতীয় দফা তৃণমূল সরকারের প্রায় শেষ লগ্নে পৌঁছে তিনি এখন ‘বিশ্বাস’ করতে চান, অভাবীদের ‘সুবিচার’ দিতে সরকার সব রকম ভাবে সচেষ্ট হবে।

এই আবহে উপনির্বাচন। তার পরেই ২১ জুলাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Politics West Bengal BJP TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE