—ফাইল চিত্র।
অতিমারির মরণকামড় সত্ত্বেও গত এক দশকে ভারতীয় অর্থনীতির মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের প্রকৃত বৃদ্ধির হার— অর্থাৎ, টাকার অঙ্কে উৎপাদনের পরিমাণ যতখানি বেড়েছে, তার থেকে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ বাদ দিলে যা পড়ে থাকে, সেই অঙ্কটির বৃদ্ধির হার— বছরে গড়ে পাঁচ শতাংশের চেয়ে বেশি। অস্বীকার করা যাবে না যে, এই বৃদ্ধির হার মন্দ নয়। প্রশ্ন হল, এই শ্রীবৃদ্ধি কি দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে বৈভব পৌঁছে দিয়েছে?
কলকাতার বস্তি অঞ্চলে এক দশকের ব্যবধানে আমরা দু’টি সমীক্ষা করেছিলাম, যার থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান উপরের প্রশ্নটির উত্তর সন্ধানে অন্তত খানিকটা সহায়ক হতে পারে। শুধু আয়-ব্যয় কমা বা বাড়ার হিসাব নয়, বস্তিবাসী মানুষের পেশাগত বিভাজন ও তার পরিবর্তনও বোঝা যায় এই সমীক্ষা দু’টি থেকে পাওয়া পরিসংখ্যানের মাধ্যমে। এটাও যাচাই করা যায় যে, দেশে নগর উন্নয়নের জন্য যে সব প্রকল্প গৃহীত হচ্ছে, সেগুলি এই পরিবর্তনের সঙ্গে সুসংহত কি না।
আমরা ২০১২ সালে সারা কলকাতা জুড়ে মোট ৩৭টি বস্তিতে সমীক্ষা চালিয়েছিলাম। ২০২১-২২ সালে আমরা আবার এই বস্তিগুলোতে সমীক্ষা করি। এর মধ্যে ২৯টি বস্তি আমরা খুঁজে পাই; বাকি বস্তিগুলি হয় আবাসনে পরিবর্তিত হয়েছে, বা উচ্ছেদ হয়ে গেছে। এই সমীক্ষার মাধ্যমে যেমন বস্তিবাসীদের পেশা ও প্রাক্-অতিমারি আয় সম্বন্ধে জানা গিয়েছিল, তেমনই জানা গেল তাঁদের অতিমারি-পরবর্তী সময়ের অর্থনৈতিক অবস্থা।
সমীক্ষায় দেখা গেল যে, এই এক দশকের ব্যবধানে বস্তিবাসীদের মুখ্য পেশাগুলির বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। দু’টি সমীক্ষাতেই দেখা গেল যে, এক-চতুর্থাংশ বস্তিবাসী অদক্ষ শ্রমিকের কাজ করেছেন। অন্য প্রধান পেশাগুলি হল দক্ষ বা স্বল্পদক্ষ শ্রম কাজ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি, এবং ক্ষুদ্র ব্যবসা।
অদক্ষ শ্রমের গুরুত্ব অপরিবর্তিত থাকলেও, এই এক দশকের মধ্যে অন্যান্য পেশার গুরুত্বের খানিক ওঠা-পড়া লক্ষ করা গিয়েছে। গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে ক্ষুদ্র ব্যবসার, যা অনেক ক্ষেত্রেই অন্য কোনও ভাল উপার্জনের পথ না থাকার জন্য মানুষ গ্রহণ করে থাকেন। এর সঙ্গে গুরুত্ব বেড়েছে ট্রাক চালানো ও পরিষ্কার করার (খালাসি) কাজ, এবং বাড়িঘর নির্মাণ সম্পর্কিত কাজ। যে সকল কাজের শতকরা ভাগ কমেছে, সেগুলি হল সরকারি বা বেসরকারি চাকরি, দক্ষ বা স্বল্পদক্ষ কাজ, এবং স্বনির্ভর কর্মসংস্থান (ছোট দোকান বাদে)। বস্তিতে স্বনির্ভর দর্জি আগের থেকে অনেকটাই কমে এসেছে এই এক দশকের ব্যবধানে।
বস্তিবাসীদের আয়-ব্যয়ের তুলনার জন্য আমরা ২০১২-র মূল্যস্তরে প্রকৃত আয় ও ব্যয় গণনা করেছি। ২০১২ এবং ফেব্রুয়ারি ২০২০ (প্রাক্-অতিমারি), এই দুই সময়কালে বস্তিতে সরকারি চাকুরেদের আয় সবচেয়ে বেশি আর গৃহসহায়ক বা গৃহসহায়িকাদের আয় সবচেয়ে কম ছিল। তবে এই সময়ের মধ্যে বস্তিবাসীদের আয়ের ব্যবধান কমেছে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে। অদক্ষ শ্রমিকদের আয় অনেকটা বাড়লেও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা ছোট দোকানিদের আয় ঠিক ততটাই কমেছে। সামগ্রিক ভাবে বস্তিবাসীদের আয় ৫ শতাংশ কমেছে ২০১২ ও ফেব্রুয়ারি ২০২০-র মাঝে। অর্থাৎ অতিমারির ধাক্কা লাগার আগেই কলকাতার বস্তিবাসীদের প্রকৃত আয় হ্রাস পায়; কমে আসে বস্তিবাসীদের মধ্যে আয়ের ব্যবধানও।
বস্তিবাসীদের এই অর্থনৈতিক সঙ্কোচন আশ্চর্যজনক নয়। পেশাগত ভাবে ক্ষুদ্র ব্যবসা বা ছোট দোকানিদের ভাগ ৯ শতাংশ বাড়লেও তাঁদের মাসিক প্রকৃত আয় ৩৩ শতাংশ কমেছে এই সময়ের মধ্যে। ট্রাকচালক বা খালাসিদের আয় কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু তাঁদের সংখ্যা খুবই কম।
অর্থনৈতিক অবস্থার এ-হেন অবনতি সত্ত্বেও বস্তিতে পুরুষদের বেকারত্বের হার ৭ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২ শতাংশে। অর্থাৎ, পুরুষরা বেকার থাকার বদলে অল্প আয়ের কোনও জীবিকা বেছে নিয়েছেন। অন্য দিকে, ২০১২ আর ২০২১-২২, এই দুই সময়েই ৮০ শতাংশ মহিলা গৃহিণী হওয়ায় বা গৃহকর্মে নিযুক্ত থাকায় উপার্জন করতে পারেননি। এটা খুবই আশ্চর্যের, কারণ দীনদয়াল অন্ত্যোদয় যোজনা— ন্যাশনাল আরবান লাইভলিহুডস মিশন (ডে-এনইউএলএম) মহিলাদের দক্ষতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠনের উপরে জোর দিয়েছে। অথচ তাঁদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সার্বিক কোনও উন্নতি হয়নি।
ডে-এনইউএলএম ২০২৪ সালের মার্চে সমাপ্ত হবে এবং তার পর শুরু হবে এর দ্বিতীয় পর্ব, যেখানে নির্মাণ শ্রমিক, রিকশাচালক এবং অন্য অসংগঠিত কর্মীদের উপার্জন বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া হবে। নির্মাণ শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ মহিলাদের উন্নততর কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে। দেখা গিয়েছে যে, ২০১২ সালে যেখানে নির্মাণ শিল্পে মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল না বললেই চলে, সেখানে ২০২১-২২ সালের মধ্যে অনেক মহিলা নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গবিভাজনের ভিত্তিতে দক্ষ বা স্বল্পদক্ষ কাজে মহিলাদের ভাগ বেড়েছে, আবার অদক্ষ কাজে মহিলাদের ভাগ কমেছে। সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায় যে, মহিলারা উন্নততর কর্মসংস্থানের দিকে বেশি আগ্রহ প্রকাশ করছেন।
কোভিড অতিমারিতে বস্তিবাসীদের তীব্র আর্থিক সঙ্কট থেকে রক্ষা করেছে সরকারি রেশন। আমাদের সমীক্ষার সকল পরিবারই এর সুবিধা পেয়েছে। তবে কেউ পেয়েছেন শুধু চাল-গম, আর কেউ এর সঙ্গে পেয়েছেন ডাল। এই সরকারি সহায়তা তাঁদের কোভিড-পরবর্তী সময়ের মূল্যস্ফীতি— বিশেষত বর্ধিত পরিবহণের খরচ— সামলাতে সাহায্য করেছে।
বস্তি উন্নয়নের উদ্যোগের ফলে কলকাতার বস্তি এলাকা সঙ্কুচিত হয়েছে। অবশিষ্ট বস্তি এলাকায় পাকা ঘরের সংখ্যা অনুপাতে অনেক কমে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রাজ্য নগরোন্নয়ন ও পুর বিষয়ক দফতরের তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালে কলকাতায় ৭২৭২টি গৃহহীন পরিবার ছিল। তাদের জন্য কলকাতায় চারটি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে, যাতে প্রায় ৫০০ গৃহহীন মানুষ থাকতে পারেন। আমাদের সমীক্ষা অনুযায়ী ২০২১-২২ সালে ২০১২ সালের তুলনায় বস্তিগুলিতে আরও ভাল পানীয় জলের সরবরাহ হচ্ছে। নর্দমাগুলি আগের চেয়ে অনেক বেশি ঢেকে দেওয়া হয়েছে। প্রায় প্রত্যেক বাড়ির দরজা থেকেই বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। স্থানীয় ভ্যাট থেকে বর্জ্য সংগ্রহ আগে কম হলেও এখন তার বেশ খানিকটা উন্নতি হয়েছে। বস্তির পরিবারগুলি আগের থেকে অনেক বেশি শৌচালয় ব্যবহার করছে। অর্থনৈতিক দুরবস্থা সত্ত্বেও, পুর পরিষেবাগুলির উন্নতি হওয়ার জন্য বস্তিতে বহুমাত্রিক দারিদ্র (মাল্টিডাইমেনশনাল পভার্টি) দূরীকরণের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ভবিষ্যতে দেশের গরিব মানুষের জন্য বেশি কাজের পাশাপাশি তৈরি করতে হবে আরও উন্নততর কাজ। অদক্ষ শ্রমিকদের উপার্জন বৃদ্ধি খুবই জরুরি। শহুরে কর্মসংস্থান পরিকল্পনার মাধ্যমে বাড়াতে হবে কাজ। এর সঙ্গে রাজ্যের শ্রম দফতরকে চালিয়ে যেতে হবে শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন সুরক্ষিত করার প্রচেষ্টা। বাজার সংযোগের দিকেও নজর দিতে হবে সরকারকে, যাতে দক্ষ শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য স্বনির্ভর কর্মকাণ্ডে যুক্ত মানুষেরা বেশি উপার্জন করতে পারেন। রাজ্য সরকারের তত্ত্বাবধানে স্বয়ংসিদ্ধা— স্টেট আরবান লাইভলিহুড মিশন-এর অধীনে এলাকা স্তরের সঙ্ঘগুলিকে (ফেডারেশন) আরও সক্রিয় করতে হবে। এটি ডে-এনইউএলএম’এর অধীনে আরও স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে তুলতে, তাদের আরও সক্রিয় করে তুলতে, সুসংহত ভাবে কাজ করতে এবং ভাল পরিষেবা পেতে সাহায্য করবে।
আমাদের সমীক্ষা ও দেশের সার্বিক উন্নতির তথ্য একত্রিত করলে অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান ও ক্রমহ্রাসমান ধারার যুগলবন্দি— যা দুই শ্রেণির মানুষকে ক্রমশ আলাদা করে দেয়— সেটা স্পষ্ট উপলব্ধি করা যায়। অতিমারির সময় দরিদ্রতম মানুষদের অর্থনৈতিক জীবনে সরকারের ভূমিকার গুরুত্ব বোঝা গিয়েছে। তাই সরকারি সাহায্যকে ‘রেউড়ি’ বা দয়ার দান হিসাবে না দেখে সরকারি আয়ের বৃদ্ধি ও তার যথাযথ ব্যবহারের কথাই ভাবা দরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy