Advertisement
E-Paper

সবটুকু অগ্রগতি ধ্বংস?

রাষ্ট্র সত্য হলে যুদ্ধ সত্য। তা সে ‘হিংসা থেকে রাষ্ট্রের জন্ম’ বলেই হোক, অথবা ‘শোষণের হাতিয়ার’ মতবাদ ধরেই হোক, যে ভাবে খুশি ভাবা যায়।

—প্রতীকী ছবি।

আবির্ভাব ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৭:৫৯
Share
Save

একটি নয়, এখন দু’টি। পৃথিবীর দু’টি প্রান্তে এখন চলছে দু’টি প্রত্যক্ষ যুদ্ধ। আর এই দু’টি যুদ্ধকে সঙ্গে নিয়েই আমরা নতুন ইংরেজি বছরে প্রবেশ করেছি। আশির দশকের কবি রাজকুমার রায়চৌধুরী তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নবাবের অস্ত্রের ঘরে যেন জল ঢেলে দেন ঈশ্বর।’ সেই আবেদন নামঞ্জুর হয়েছে। শুধু আমেরিকা কেন, কোনও রাষ্ট্রই তার অস্ত্রের ঘরে জলের ছিটে-ফোঁটা ঢুকতে দেয়নি। বিপরীতে কখনও লুকিয়ে, কখনও প্রকাশ্যে বাড়িয়ে গিয়েছে অস্ত্রের আয়োজন। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে, নিয়ম করে প্রতি বছর বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে গিয়েছে প্রতিরক্ষা খাতে। সম্ভব হলে সাগর সিঞ্চন করেও তারা খুঁজে বার করতে পারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাণঘাতী অস্ত্রের ভান্ডার।

আশ্চর্যের হল এই যে— পৃথিবীর কাছে একটা নয়, দুটো বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস আছে। পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগের ভয়াবহতা এবং তার ফলাফল জানা সত্ত্বেও, পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসাবে পরিচয় দেওয়াটা কী ভাবে যেন শ্লাঘার বিষয়। অথচ, বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মানুষ এই পৃথিবীর উপর, নিজের প্রজাতির উপর যে বিপুল লাঞ্ছনা চালিয়েছে, সেই বিচারে এই পরিচয় তার লজ্জার কারণ হওয়ার ছিল। অথচ, মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, প্রকৃত প্রস্তাবে নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিগুলি শুধুমাত্র কাগজের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়।

রাষ্ট্র সত্য হলে যুদ্ধ সত্য। তা সে ‘হিংসা থেকে রাষ্ট্রের জন্ম’ বলেই হোক, অথবা ‘শোষণের হাতিয়ার’ মতবাদ ধরেই হোক, যে ভাবে খুশি ভাবা যায়। যুদ্ধে কী হয়? প্রাথমিক ভাবে, প্রাণক্ষয় হয়। যারা যুদ্ধে যায়, সেনা, তারা আসলে নাগরিক, মানুষের ঘরের সন্তান। তারাই সর্বাগ্রে মারা পড়ে। যুদ্ধ ঘোরতর হলে, রাষ্ট্রের আহ্বানে ইচ্ছা-নিরপেক্ষ ভাবে যুদ্ধে যেতে হয়। যদিও জাতীয়তাবাদ আজ আর শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় সীমান্ত দ্বারা নির্ধারিত নয়; তবুও, যুদ্ধের সময় রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদের উগ্রতা বেড়ে যায়। আর সেটা যে কোনও রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষে, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অথবা অন্য কোনও রকম জটিল সঙ্কট মোচনে নিজেকে প্রাসঙ্গিক করে ক্ষমতায় ফেরানোর সহজ পন্থা। যদিও সকলেই জানে, এই যুদ্ধের পরেই আসে অর্থাভাব, অনাহার, মন্দা এমনকি মহামারির মতো সঙ্কট।

যুদ্ধের সময় জীবনহানির সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশি যেটা হয়, তা হল মানুষের সম্মানের হানি। এখন সব দেশের হাতেই রয়েছে শক্তিশালী সব ক্ষেপণাস্ত্র, যার দাপটে মুহূর্তেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় একটি গোটা শহর। প্রাণ তো যায়-ই, সঙ্গে বহু মানুষ হয়ে যায় গৃহহীন। দূর-দূরান্তে বসেই বোতাম টিপে শয়ে শয়ে মানুষকে পরিণত করা যায় উদ্বাস্তুতে। তখন সম্ভ্রমের সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও হারাতে হয় এই সর্বস্বান্ত মানুষগুলিকে। শুধু তা-ই নয়, যুদ্ধের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে নারী ও শিশুদের উপরে, এই সময়ে যাদের উপরে বাড়ে লাঞ্ছনার মাত্রা। প্রতি দিনের খবরে এখন নিয়ম করে দেখতে পাওয়া যায়— গত ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবীর কোন প্রান্তে যুদ্ধের বলি হল কত জন। উঠে আসে শিশু থেকে সাংবাদিক— সব মৃত্যুর পরিসংখ্যানই।

যুদ্ধে শুধু মানুষ মারা যায় না, ক্ষতি হয় প্রকৃতিরও। চাষের জমি নষ্ট হওয়ায় নষ্ট হয় আগামী দিনের ফসলের সম্ভাবনা। প্রভাবিত হয় বৈশ্বিক অর্থনীতিও। যুদ্ধের আঁচ স্থল থেকে জলেও ছড়ালে ব্যাহত হয় আমদানি-রফতানির স্বাভাবিক গতিবিধি। ঘুরপথে চলাফেরার কারণে স্বাভাবিক ভাবেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে জ্বালানি— দাম বাড়ে সব কিছুরই। এর প্রভাব পড়ে সব দেশেই, তবে উন্নয়নশীল দেশগুলির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি।

এখন একটা যুদ্ধ মানে, যুদ্ধের সমান্তরালে জেগে ওঠে আরও যুদ্ধক্ষেত্র। পৃথিবীর সব প্রান্তের মানবাধিকারের উপর আঘাত আসে। এখন তৃতীয় প্রজন্মের মানবাধিকারের কথা বলা হয়। প্রথম প্রজন্মে বা প্রথম স্তরের যে অধিকার, তা একক অধিকার— জীবনের অধিকার; দ্বিতীয় প্রজন্মে সেই অধিকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আর তৃতীয় স্তরের অধিকারগুলি বিশ্বজনীন। সেই মানবাধিকারগুলির প্রকৃতি চূড়ান্ত ভাবে সমষ্টিধর্মী। সারা পৃথিবীকে এক হয়ে এই সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্যসঙ্কট— এ কালের বহুচর্চিত বিষয়গুলিকে এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসাবে ধরা যেতে পারে। তা ছাড়া, কিছু দিন আগেই আমরা পেরিয়ে এসেছি একটা অতিমারিকে।

যে কোনও একটি ভূখণ্ডের উপর ক্রমাগত ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে, বহু মানুষকে বাস্তুহারা করে, কয়েকটি প্রজন্মকে ধ্বংস করে দেওয়া যায়। ঠিক তেমনই প্রতিরক্ষা না কি আত্ম-পরিচিতি, কোন পক্ষে যুদ্ধ যুক্তিসঙ্গত— এই নিয়ে ভেবে একটা পক্ষ নিলেই আসলে তা যুদ্ধের অনুকূলে যাওয়া হয়। আর যুদ্ধের অনুকূলে গেলে তৃতীয় স্তরের অধিকার নিয়ে ভাবার মুহূর্তে দাঁড়িয়ে প্রথম দুই স্তরের অধিকারের সবটুকু অগ্রগতিই ধ্বংস হয়ে যায়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

War human life Society

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}