Advertisement
E-Paper

দেশ আর মাটির স্বপ্নগাথা

আখতারউজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা উপন্যাসে, ইতিহাস বাস্তব সময়ের মতো সরলরেখায় চলে না, তার বয়ান-কাঠামোয় একই সময়ের পেটে ঢুকে পড়ে অনেক কিছু।

A Photograph of Farmers

গ্রামবাংলার উপকথা-লোককথা-গল্পগাছার সৃষ্টিশীল ব্যবহারেই এই উপন্যাসের সিদ্ধি। প্রতীকী ছবি।

দেবযানী সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২৩ ০৫:৫১
Share
Save

তোমার তৈরি ইতিহাসের বিরুদ্ধে ফের পথে নেমেছে আমার স্মৃতি,” লিখেছিলেন কাশ্মীরের কবি আগা শহিদ আলি। এডওয়ার্ড সাইদও তাঁর কালচার অ্যান্ড ইম্পিরিয়ালিজ়ম গ্রন্থে জানিয়েছিলেন, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার স্বপ্নকল্পে লগ্ন হয়ে থাকে এক ভৌগোলিক বার্তা: “দেশীয় লোকেরা জানে, তাদের ঔপনিবেশিক দাসত্ব শুরু হয় বহিরাগতদের কাছে তাদের স্থানিকতা হারানোর পর থেকে। সেই হারানো ভূগোলটা খুঁজতে হবে, কোনও না কোনও ভাবে তাকে উদ্ধার করতে হবে। বহিরাগত ঔপনিবেশিক শক্তির উপস্থিতিতে দেশের মাটি, মানুষকে খুঁজে পাওয়ার প্রথম পথটাই হল কল্পনা।”

আখতারউজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা-য় এই উদ্ধার প্রক্রিয়াটা চলে ইতিহাস আর স্মৃতির জোড়া আলোয়। এই উপন্যাসে ইতিহাস বাস্তব সময়ের মতো সরলরেখায় চলে না, তার বয়ান-কাঠামোয় একই সময়ের পেটে ঢুকে পড়ে অনেক কিছু। একটার পর একটা ছবি, ঠিক ক্যালেইডোস্কোপের মতো। ইতিহাস তো শুধু কী ঘটেছিল, কেন ও কী ভাবে, তার আনুপূর্বিক বৃত্তান্ত নয়। সে তারও উপরে লেখে অনেক কিছু: লোককথা, উপকথা, প্রবাদ, স্থান-কালের মৌখিক ঐতিহ্য, মিথ। খোয়াবনামা-য় তাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে অষ্টাদশ শতকের ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ আর তেভাগা আন্দোলন পাশাপাশি রয়ে যায়, চেরাগ আলির ছড়ায় ঢুকে যায় মুনশির কথা, ইতিহাস ও স্বপ্ন পাশাপাশি পথ হাঁটে। ইলিয়াসের উপস্থাপনায় গ্রামবাংলার ছড়া আর লোককথা-উপকথা স্বপ্নের পথ ধরে বাস্তব পৃথিবীতে চলে আসে: তমিজের বাপ স্বপ্ন দেখে, ঘুমের মধ্যে হাঁটে। কেউ জানে না সে কখন জেগে, আর কখন সানকিতে ভাত আর মাছের চচ্চড়ি গিলে মাচায় শুয়ে গভীর ঘুমে। সে যা সত্যি বলে জানে, তার স্বপ্নে সেগুলিই ঘুরেফিরে আসে। সে মুনশির অস্তিত্বকে সত্যি বলে জানে, জানে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহে মুনশি বরকতুল্লা শাহ আর ভবানী পাঠক পাশাপাশি লড়াই করেছিল। জানে, গোরা সিপাইদের সর্দার টেলর সাহেবের গুলিতে মুনশি মারা যাওয়ার পর তার শরীর পুড়তে থাকে রহস্যময় লাল-নীল আগুনে, কেউ তার কাছে যাওয়ার সাহস পায় না। তখন গলায় জড়ানো শিকল আর মাছের নকশা-আঁকা লোহার পান্টি হাতে সে উঠে বসে কাৎলাহার বিলের উত্তর সিথানে পাকুড় গাছের মাথায়। ওখানেই তো তমিজের বাপ রোজ ঘুমিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায়। তমিজ তাই চেনে বিলের উত্তর কোণটা, শরাফত মণ্ডলের ইটভাটার লোক কেটে ফেলার আগে যেখানে মুনশির পাকুড় গাছটা ছিল। বৈকুণ্ঠ জানে, পোড়াদহের মেলায় ঠিক কোন জায়গাটায় ভবানী সন্ন্যাসী দেখা দেয়। এই জানাটা বই-পড়া বিদ্যে নয়। বাংলা সাহিত্যে ‘ওরা’ বইয়ের ‘খোয়াবের রাতদিন’ লেখায় শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, এ এমন এক জানা যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রয়ে যায়— জমির স্বপ্ন দেখা মানুষের মনে, ফসলের ন্যায্য ভাগ পাওয়ার স্বপ্নে, সাম্য আর সুবিচারের স্বপ্নে। পাকুড় গাছ কেটে ফেলা এখানে স্রেফ বাস্তুতন্ত্রের বিপর্যয় নয়। অতীতের যে ঘটনাগুলি ইতিহাস গড়ে তোলে, তারই সমূল উচ্ছেদ।

যমুনা ও করতোয়া দুই নদীর মাঝে (দিনাজপুর ও বগুড়ার মাঝামাঝি কোথাও) মাঝিপাড়া-অধ্যুষিত গ্রামগুলিতে স্থিত এই উপন্যাসে লেখকের রাজনৈতিক প্রেরণাটি স্পষ্ট: একই সঙ্গে তেভাগা আন্দোলন ও পাকিস্তানের জন্মকে তলিয়ে দেখতে চান তিনি। ইলিয়াসের সাহিত্য প্রোথিত তাঁর রাজনীতির বোধে, বিশেষত বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে জাতীয়তাবাদের পরিপ্রেক্ষিতে খুঁড়ে দেখায়। গরিব চাষা ও শহুরে নিম্নবর্গের সমাজবিপ্লবের আকাঙ্ক্ষার আতশকাচে একটা অঞ্চলের ইতিহাসকে ফিরে দেখে এই উপন্যাস, বৃহত্তর পরিসরে ভাষিক জাতীয়তাবাদের পথ বেয়ে বাংলাদেশের জন্মকেও ফিরে দেখে। তার দেশভাগ-বয়ান অন্য রকম; ভারত, পাকিস্তান বা বাংলাদেশের প্রচলিত জাতীয়তাবাদী বয়ানের বাইরে।

গ্রামবাংলার উপকথা-লোককথা-গল্পগাছার সৃষ্টিশীল ব্যবহারেই এই উপন্যাসের সিদ্ধি, কারণ উপকথা মিথ ও ইতিহাসের ফারাক ইলিয়াস মুছতে পারেন অনায়াসে। নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুনশি আর ভবানী পাঠকের যে প্রতিরোধ তমিজের বাপের স্বপ্নে ফিরে আসে, আজকের তেভাগা আন্দোলনের শিকড়ও সেখানেই। চেরাগ আলি ফকির একটা ছেঁড়া পুঁথি থেকে খোয়াবের মানে বলতে পারে, যে পুঁথি সে তমিজের বাপকে দিয়ে যায়— পুঁথির গানে অতীত ইতিহাস আর বর্তমান মিলেমিশে ভবিষ্যতের ইশারা দেয়। স্মৃতিকে যদি বলা যায় বাস্তবতার নির্মিতি, তা হলে স্বপ্নও তা-ই, তারও ব্যাখ্যা প্রয়োজন। ইলিয়াসের উপন্যাস এই স্বপ্নের প্রত্নতত্ত্বেই সওয়ার। তমিজের বাপের কাছে স্বপ্ন একই সঙ্গে সত্য ও প্রতীকী। গিরিডাঙা, নিজগিরিডাঙার লোকেরাও সে কথা জানে— খোয়াবের মানে বলার ছেঁড়া পুঁথিটা তমিজের বাপের কাছে আছে বলেই সে চেরাগ আলির উত্তরসূরি। কেরামত আলি এদের উত্তরসূরি হতে পারবে তখনই, যখন সে তেভাগার গান বাঁধবে। লড়াইয়ের স্বপ্ন এ ভাবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে যায়।

কাৎলাহার বিলের পাকুড় গাছ কাটা পড়ায় কি মুনশি একা বাস্তুহারা হল? তমিজও তার জমিছাড়া হয়। শহরের জনশূন্য হিন্দু বাড়িগুলোয় ভিড় করে শরণার্থীরা, গিরিডাঙার মুকুন্দ সাহা ও স্কুলের হিন্দু শিক্ষকেরা ইন্ডিয়ায় চলে যায়, নাতনি কুলসুমকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে আসতে হয় চেরাগ আলিকে। লোকচেতনা থেকে ভবানী পাঠক ও মুনশির স্মৃতি ধীরে ধীরে মুছে যায়। দেশছাড়া হওয়ার এই যাত্রা-প্রতিযাত্রার ছিটেফোঁটা তবু থেকে যায় মাটির গভীরে। অন্য প্রজন্ম সে কথা পড়ে নেয়, পুঁথিপড়া বিদ্যা এড়িয়ে বুঝে নেয় অন্তরকথা। এক ফালি জমির জন্য মানুষের যে সাধ, তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে পৃথিবীর অন্তহীন সঙ্গীত। জাতিরাষ্ট্রের রাজনীতি সে গান ধরতে পারে না, তার মুঠির ফাঁক দিয়ে অন্তহীন সেই গান গলে পড়ে যায়। জাতিরাষ্ট্রেরও আছে এক নিজস্ব শোষণের ছক, তেভাগার স্বপ্ন আত্মসাৎ করেও তাই পাকিস্তান থমকে যায়। ইলিয়াস পরিষ্কার দেখান, নবজাত পাকিস্তান তেভাগার এই স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে না। সেই রাজনৈতিক ইচ্ছাই তার নেই।

অতীতকে মনে রাখা তাই ক্ষমতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। স্মৃতিই মানুষকে বিদ্রোহে প্রণোদনা দেয়, মনে পড়ায় পুরনো প্রতিশ্রুতি, শোষণের বিরুদ্ধে অতীতের স্মৃতিকে জ্যান্ত করে তুলে ইন্ধন জোগায় সভ্যতার চিরন্তন যুদ্ধে— অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে। তমিজ ও বাকিরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেশভাগ এখানে কুয়াশার সরের মতো আস্তে আস্তে, কিন্তু অবশ্যম্ভাবী ভাবে এসে পড়ে। হিন্দু, মুসলিম, নমশূদ্র, কলুদের এত কাল পাশাপাশি থাকার বোধ, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সামূহিক জনস্মৃতি, প্রতি ঋতুতে করতোয়ার উথালপাথাল স্রোত এ বার বিপন্ন হবে— কিন্তু একেবারে শেষ হবে না। দিগন্ত জুড়ে, জখম চাঁদের নীচে জ্বলতে থাকা জোনাকির হেঁশেলে, তমিজের বাপ ও কুলসুমের স্বপ্নে, মাঝিপাড়ার প্রতিটি ঘরের কোণে, বিলের চোরাবালির ভূতে, বিলের উপর দিয়ে মণ্ডলবাড়ির শিমুলগাছ পেরিয়ে বকের উড়ানে, হারিয়ে যাওয়া পুঁথিতে রয়ে যাবে সেই স্বপ্নের চিহ্নগুলি। কেউ কেউ সেই প্রতীক বুঝবে, কারও কাছে তা রহস্যই রয়ে যাবে। স্মৃতি আর অবচেতনে চাপা পড়া সে রহস্য এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে বয়ে যাবে, আবার কখনও নবিতনের সেলাই-করা কাঁথায় ফুল-পাখির মতো হঠাৎ উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে, তমিজের বাপ তার ওস্তাদের কাছে শিখে নেবে স্বপ্নের মানে। খোয়াবনামা স্রেফ কিছু নির্দিষ্ট ও আঞ্চলিক বিশিষ্টতায় ভরা, প্রান্তিক মানুষের মহাকাব্যিক আখ্যানমাত্র নয়। পাকিস্তান আন্দোলন, মুসলিম লীগ থেকে তেভাগা, দেশভাগ হয়ে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম— সব কিছুর মধ্য দিয়ে এই উপন্যাস ফিরে দেখে জাতিরাষ্ট্র গঠনের পথে বর্তমান ও অতীতের টানাপড়েনকে। এ বই মানুষ ও প্রকৃতির, মানুষ ও তার ফসল-ফলানো আদুরে মাটির সংযোগ-সম্পর্কের স্বপ্ন-জড়ানো আখ্যান। সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপ্লবের সম্ভাবনা এই মাটিতেই নিহিত। সেই সম্ভাবনাতেই তমিজ আউশ ধান চাষের স্বপ্ন দেখবে। হয়তো এখনই ফলাতে পারবে না, তেভাগার স্বপ্ন এখনই পূরণ হবে না, কিন্তু মুক্তির বিপ্লবী স্বপ্ন রয়ে যাবে তমিজ, কুলসুম, ফুলজানদের স্বপ্নে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

A Brief History Of Time agriculture imperialism

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}