Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪
BTS

বিনোদন বিশ্বে কোরিয়ার ঢেউ 

কে-ড্রামা, কে-ব্যান্ড প্রথমে চিন, পরে জাপানে উঠতি প্রজন্মকে মাতিয়ে তোলে। ‘আমেরিকান ড্রিম’-এর জায়গায় ঢুকে পড়ল ‘কোরিয়ান ড্রিম’।

A Photograph of BTS Band

দক্ষিণ কোরিয়ার বয় ব্যান্ড ‘ব্যাংটন সোনিয়েন্ডন’, সংক্ষেপে বিটিএস, মাতাচ্ছে ভারতের জেন জ়ি-কে। ফাইল ছবি।

সোহিনী মজুমদার
শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০২৩ ০৬:০৬
Share: Save:

কেমন করে সাজব, কেমন সঙ্গীর সঙ্গে পাতাব প্রেমের সম্পর্ক, কী গান শুনব, ভারতের বহু প্রজন্মের জন্য তা অনেকখানি নির্ধারণ করে দিয়েছে বলিউড। সম্প্রতি এক ওটিটি প্ল্যাটফর্মে যশ চোপড়া প্রযোজিত হিট ছবিগুলির অন্দরকাহিনি দ্য রোম্যান্টিকস তার মধুর স্মৃতি ফিরিয়ে আনল। আর সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হল বলিউডের সীমা। ভারতে ২০০০ সালের পরে যারা জন্মেছে, চলতি কথায় যাদের বলা হয় ‘জেন জ়ি’ প্রজন্ম, সেই ৪৭.২ কোটির মন বুঝতে কতটা সফল বলিউড, ভারতীয় টেলিভিশন আর ওটিটি মাধ্যমে প্রচারের জন্য তৈরি সিনেমা-সিরিয়াল? বরং গোলাপি-সাদা-সবুজ চুল, হালকা মেক-আপ, গলায় হার, কানে দুল, হাই-ফ্যাশনড জুতো পরা এক দল মিষ্টি ছেলে ঘরের দেওয়াল থেকে, ফোনের স্ক্রিন থেকে মন জুড়ে জায়গা করে নিচ্ছে। সাম্প্রতিক যে কোনও বলিউডি গানের চাইতে ‘আই নো হোয়াট আই অ্যাম/ আই নো হোয়াট আই ওয়ান্ট/...ইউ কান্ট স্টপ মি লাভিং মাইসেল্ফ’ অনেক বেশি পছন্দ আজকের ছেলেমেয়েদের।

কাদের এই নাচ-গান? বলিউড তো নয়ই, হলিউডও নয়। দক্ষিণ কোরিয়ার বয় ব্যান্ড ‘ব্যাংটন সোনিয়েন্ডন’, সংক্ষেপে বিটিএস, মাতাচ্ছে ভারতের জেন জ়ি-কে। কেবল নিখুঁত নাচ, চোখধাঁধানো প্রযোজনাই নয়, আজকের ছাত্রছাত্রীদের মতে তাদের গান নিরাপত্তাহীনতা, একাকিত্ব নিয়ে কথা বলে। আবার লড়াই করে তা কাটিয়ে মনের জোরে ঘুরে দাঁড়ানোর কথাও বলে। বাঙালি কলেজছাত্রীর কাছে বলিষ্ঠ, সুপার-পুরুষালি নায়কেরা সেকেলে; নারীবাদকে মহিমান্বিত করা বলিউডি মশলাও বিরক্তিকর। উঠতি প্রজন্মের একটা বড় অংশের কাছে লিঙ্গ-সাম্য নিঃশ্বাস নেওয়ার মতোই স্বাভাবিক। পুরুষ-নারী বিভাজনকে ছাপিয়ে লিঙ্গ বৈচিত্র, সম্পর্কের বৈচিত্র মানতেও তাদের অসুবিধা হয় না। দক্ষিণ কোরিয়া নাচ-গান-রোম্যান্সকে যে মোড়কে পরিবেশন করছে, তা ভারত, চিন, জাপানের উঠতি প্রজন্মের কাছে বিশ্বায়নের এক অন্য দরজা খুলে দিয়েছে। চেহারা, খাদ্যাভ্যাস, মূল্যবোধ এশিয়ার, অথচ পশ্চিমি আধুনিকতার স্বাক্ষর বহনকারী এই বিনোদনের মাধ্যমকে আপন করে নিতে দেরি হয়নি উত্তর-পূর্ব ভারতেরও, বলছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজ়ের শিক্ষক মানস ঘোষ। এই নতুন সংস্কৃতির ঢেউ নিয়ে একটি গবেষণা সঙ্কলনও প্রকাশিত হতে চলেছে এখন, যার নাম ‘হালয়ু,’ যার মানে ‘কোরিয়ার ঢেউ’। লেখকেরা দেশের বিভিন্ন কলেজ-পড়ুয়া।

নব্বইয়ের দশকে চিনে যখন কোরিয়ার পপ সংস্কৃতির জোয়ার আসে, তখন এক চিনা সাংবাদিক ‘হালয়ু’ নামটি দেন। টিভি সিরিজ় (কে-ড্রামা), ব্যান্ডের গান (কে-ব্যান্ড) প্রথমে চিন, পরে জাপানে উঠতি প্রজন্মকে মাতিয়ে তোলে। বছর দশেক আগে ইউটিউবে ভাইরাল হয়ে গেল কোরিয়ার পপ স্টার সাই-এর ‘গাংনাম স্টাইল’, ইউরোপ-আমেরিকাতেও ছড়িয়ে পড়ল হালয়ু। তবে মণিপুর ও ভারতের অন্য উত্তর-পূর্ব রাজ্যে নব্বইয়ের দশকের শেষ দিক থেকে ঢুকতে শুরু করে কোরিয়ার পপ গান, সিরিয়াল, সিনেমার সিডি, ডিভিডি, পোস্টার, টি-শার্ট। অবশ্যই পাইরেটেড এবং ‘কপি’ সামগ্রী হিসেবে। মণিপুরে হিন্দি সিনেমা-সিরিয়াল নিষিদ্ধ হয়ে গেলে হুহু করে আসে ‘হালয়ু’ তরঙ্গ। হালয়ুর দ্বিতীয় পর্যায়ে সংস্কৃতির মূলস্রোতে ঢুকতে শুরু করল কে-পপ, কে-ড্রামা, কে-ফ্যাশন, কে-বিউটি। ‘আমেরিকান ড্রিম’-এর জায়গায় ঢুকে পড়ল ‘কোরিয়ান ড্রিম’।

দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজ পিতৃতান্ত্রিক নয়, সমকামে তাদের ভীতি নেই, এমন নয়। তবে তাদের টিভি সিরিজ়, গানকে তারা আন্তর্জাতিক পণ্যের মোড়ক দেয় বলে তাতে পুরুষ আধিপত্যের রেশ থাকে না। বরং কোরিয়ার ছেলেদের একটা ‘ফ্লাওয়ার বয়’ বা নমনীয় টিন-এজ ভাবমূর্তি থাকে। ১৮-২৫ বছর বয়সি ছেলেমেয়েদের কাছে সেটা এখন আকর্ষণীয়। এরা সাজে, কাঁদে, ভয় পায়, লজ্জা পায়। এমন আবেগপ্রবণ ‘ইমো বয়’ অল্পবয়সি মেয়েদের হিরো। কে-ফ্যাশনের জামাকাপড় ফুটপাতে ঢালাও বিক্রি হয়, অনলাইন বাজারেও। ফলে খুব সহজেই অর্থনৈতিক শ্রেণি-ভেদে তা পৌঁছচ্ছে এই প্রজন্মের নানা স্তরে।

যে যেমন, তাকে তেমন ভাবে গ্রহণ করার বার্তা থাকে কে-পপ থেকে কে-ড্রামা, সবেতেই, মত মনস্তত্ত্বের এক ছাত্রীর। পশ্চিমি ‘উচ্ছৃঙ্খল’ জীবন-যাপনের চেয়ে এশীয় মূল্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতার ছাঁচকে ভাল মনে করছে বহু ভক্ত। তরুণ প্রজন্মের অনেকেরই বক্তব্য, সিরিজ়গুলো থেকে‘পিছিয়ে-পড়া’ চিন্তাভাবনার অংশ তারা ছেঁকে নিতে জানে। যে কারণে ছিপছিপে চেহারা, ‘নিখুঁত’ মুখের অসম্ভব সৌন্দর্যের মানদণ্ডকে বাদ দিয়ে বাকিটুকু নিতে অসুবিধা হয় না তাদের। কোরিয়ার ঢেউ অবশেষে পশ্চিমি সৌন্দর্যের ধারণা থেকে বিশ্বের নজর যে ঘুরিয়েছে, সেটা কাজের কথা, বলেছেন আইনের এক স্নাতকোত্তর ছাত্রী। ত্বকের রং বদলের চাইতে ত্বকের পরিচর্যায় বেশি গুরুত্ব দেয় এইনতুন সংস্কৃতি।

শুধু সাজ বা বিনোদন নয়, জেন জ়ির খাবার (কিমবাপ, বুলগোগি) চাইনিজ় বা কন্টিনেন্টালকে কড়া প্রতিযোগিতায় ফেলে দিচ্ছে। জীবনের গোড়া থেকেই যারা ডিজিটাল জগতের বাসিন্দা, তাদের মন স্পর্শ করা আজ ভারতীয় বিনোদন শিল্পের কাছে এক মস্ত চ্যালেঞ্জ। মূলস্রোতের ভারতীয় বিনোদন কি এখনও জানে, কেমন করে দেশীয় অথচ বিশ্বজনীন হতে হবে তাকে?

অন্য বিষয়গুলি:

BTS South Korean Movies entertainment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE