—প্রতীকী ছবি।
বিজ্ঞাপনের মেয়েটি রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ছুটছে আয়নার দিকে। ব্রণ হয়েছে না কি? অ্যান্টিসেপটিক ক্রিমটি সেই ভয় থেকে মুক্তি দিল। কিন্তু তত ক্ষণে নতুন নতুন ভয় তার সঙ্গী। মনে হচ্ছে, নাকের গড়নটা বদলানো দরকার। ঠোঁট, স্তনও পিতৃতন্ত্রের মাপকাঠিতে কল্কে পাবে না (প্রসঙ্গত, স্তন নিয়ে মেয়েদের উদ্বেগ সবচেয়ে বেশি)। বয়ফ্রেন্ড, গুণগ্রাহী জুটবে না। সমাজে, সমাজমাধ্যমে পিছিয়ে পড়বে। অনেক মজা থেকে বাদ যাবে, যাকে বলে ‘ফিয়ার অব মিসিং আউট’।
কৈশোর থেকে যৌবনে উত্তীর্ণের অস্থির সময়টাতে, আত্মসচেতনতার প্রথম পর্বে চেহারা নিয়ে ভয় ছেলেমেয়ে নির্বিশেষেই থাকে। স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু ছেলেবেলায় প্রকৃতিদত্ত ত্রুটি আবিষ্কার করে ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। অন্যদের তুলনায় তিনি বেঁটে, রোগা ও দুর্বল। ফুটবল দূরের কথা, ব্যাডমিন্টনেই দম ফুরোয়, জ্বর-সর্দি, দাঁতব্যথা, চর্মরোগ আছে। তায় তোতলা, অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বললে যন্ত্রণা দুঃসহ হয়ে ওঠে।
লেখিকা কমলা দাসের আত্মজীবনীতেও দেখেছি চেহারা নিয়ে হীনম্মন্যতা, পুরুষচোখে আকর্ষণ হারানোর ভয়। কমলা ও তাঁর ভাই সাহেবি স্কুলে ট্রোল্ড হতেন গায়ের রং ময়লা বলে। ভাইয়ের নাকে পেনসিল ঢুকিয়ে রক্ত ছুটিয়ে দিত সাদা চামড়ার সহপাঠীরা। কমলা বাঙালি চাষিবৌদের মতো লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরতেন ছেলেসুলভ গঠন ঢাকতে।
কিন্তু ‘ফিয়ার অব ক্রাইম’? অপরাধের আশঙ্কা, মানে খারাপ কিছু ঘটার ভয়ও মেয়েদের বেশি— জানাচ্ছেন গবেষকরা। এই ‘খারাপ’টাও, মজার কথা, অনেক সময় নির্ধারণ করে দেয় পিতৃতন্ত্র।
আমি সন্ধেবেলা জামরুলতলা দিয়ে আসতে ভয় পেতাম। পাড়ার ছেলেরাও ভয় পেত। বড় হতে হতে দেখলাম মেয়েদের ভয়গুলো ছেলেদের চেয়ে অনেক বদলে গিয়েছে। জামরুলতলা, পরীক্ষা, রেজ়াল্ট— এই সব ‘কমন’ ভয়ের জায়গায় মেয়েদের জীবনে জুড়েছে অন্তর্বাসের ফিতে বেরোনোর, জামায় ঋতুস্রাবের দাগ লাগার, রাস্তাঘাটে অপ্রস্তুত অবস্থায় ঋতু শুরুর ভয়। পুরুষ গৃহশিক্ষকের সঙ্গে একা ঘরে পড়াশোনার ভয়, ট্রেনে-বাসে ব্যক্তিগত অঙ্গে কনুইয়ের গুঁতোর ভয়। সমাজমাধ্যমে ফেক ছবির, অফিসে যৌন লাঞ্ছনার, গার্হস্থ হিংসার ভয়। পর পর কন্যাসন্তান প্রসবের ভয়, কন্যাসন্তান বেড়ে ওঠার সময় ভয়! নার্সারি-পড়ুয়া শিশুর তরুণী মা আমাকে ফিসফিসিয়ে বলেছিলেন, “মেয়ে স্কুল থেকে না ফেরা পর্যন্ত অস্থির থাকি। বার বার জিজ্ঞেস করি বাসকাকু গায়ে হাত দেয়নি তো? বাচ্চাকে বোঝাই ‘গুড টাচ’, ‘ব্যাড টাচ’, ‘প্রাইভেট পার্টস’। স্কুলের ভরসা নেই। বাচ্চা যেন পুলকার থেকে শেষে না নামে...”
দেখেছি, দেশভাগের শিকার হয়ে যাঁরা অনেক কিছু হারিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে এক অজানা ভয় কাজ করত। ও-পারে মা ভাই বোন ছেড়ে আসা এক নারী বলতেন, “বুকের মধ্যে ফাঁত ফাঁত করে।”
দাঙ্গাবাজদের হাতে খুন হয় নসিব কউরের স্বামী, ছেলে। প্রাণ বাঁচাতে ডিফেন্স কলোনিতে ঢুকে পড়ে ভয়ে আধমরা সেই নারী। তাকে আশ্রয় দেন মেজর চড্ডা। মেয়েটির চোখে ছোটবেলায় শিকার করা এক কুমারী হরিণীর চোখ দেখতে পান তিনি। ভাবেন, অসহায় নারীটিকে ইচ্ছে করলেই পেতে পারেন। কিন্তু সাহস পান না। ছটফট করে রাত কাটে। ঘুম ভাঙতে দেখেন, অস্ত্রের আঘাতে নয়, স্রেফ আতঙ্কে মারা গিয়েছেন নসিব। মেজর নিজেকে ক্ষমা করতে পারেন না।— “রাতে কেন যে ওর পাশে শুইনি। তা হলে হয়তো বেঁচে যেত।” (কুমারী হরিণীর চোখ, মোহন ভাণ্ডারী)
সাদাত হোসেন মান্টোর খোল দো-য় দেশভাগের দাঙ্গায় গণধর্ষিতা মেয়েটি ‘খোল দো’ শুনলেই যন্ত্রচালিতের মতো সালোয়ারের দড়ি খুলতে থাকে। পঞ্জাবি লেখিকা অজিত কউর দুই কন্যা-সহ আট-আট বার বিতাড়িত হয়েছিলেন ডাক্তার স্বামীর ঘর থেকে। দুই মেয়েকে বুকে করে পায়ের নীচে জমি খুঁজতে খুঁজতে সাফল্য এলেও জীবন থেকে ভয় যায়নি। ‘বহু বছর জমে থাকা ছাইয়ের স্তূপের মধ্যে লুকোনো অঙ্গারের মতো’ উঠে দাঁড়িয়েছিলেন অজিত, কিন্তু ‘লিবারেশন’-এর স্বাদ পাননি। কারণ বাইরের শিকল ভাঙা, আর্থিক স্বাধীনতা নয়, সত্যিকারের লিবারেশন আসে মন থেকে। ছোট মেয়ের অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু তাঁকে সেই লিবারেশন দিল। আজীবন দুই সন্তান বুকে আঁকড়ে আতঙ্কে দিন কাটানো অজিতকে শিখিয়ে দিয়ে গেল ভয়হীন বাঁচা।
মালয়ালম লেখিকা ই কে শাহিনার ‘ফ্যান্টম বাথ’-গল্পে আছে, এ যুগের আধুনিক তরুণীকেও ঘর থেকে বাইরে পা রাখার সময় কত রকম ভয় পেরোতে হয়। দূর শহরে একা ইন্টারভিউ দিতে যাবে মেয়ে— মানতে পারেন না বাবা-মা। কারণ, কাগজে বেরিয়েছে, এক জন ইলেক্ট্রিশিয়ান কিছু মেরামতির জন্যে এসে স্নানাগারে ক্যামেরা লুকিয়ে গিয়েছে। বাবা-মায়ের সেই উদ্বেগ এত দূর ছেয়ে থাকে তরুণীর মনে যে, সে হোটেলের ওয়াশরুমে স্নান করতে পারে না কিছুতেই, মনে হয় যেন অদৃশ্য চোখ নজর রাখছে তার নগ্ন শরীরে, রেকর্ড করছে তার একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্ত।
কিন্তু বিশ্বজগতের ডাক এলে বাইরে পা রাখতে ব্যগ্র নারী নিজেকে তৈরি করে নিতে জানে। মেয়েটি ফ্যান্টমের মুখোশ এনে পরে, নিশ্চিন্তে স্নান করে। কারণ সে পৌঁছেছে একটি অসাধারণ উপলব্ধিতে— মুখহীন শরীরের ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy