আমাদের সমাজে এই ‘পাড়ার ডাক্তারবাবু’রা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছেন। ফাইল চিত্র।
কয়েক বছর আগেও ‘ফ্যামিলি ফিজ়িশিয়ান’ বা পারিবারিক চিকিৎসক শব্দবন্ধটি মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে খুব প্রচলিত ছিল। পারিবারিক চিকিৎসক বলতে বোঝানো হত মূলত সেই সমস্ত ‘পাড়ার ডাক্তারবাবু’দের, বছরভর যাঁদের শরণাপন্ন হওয়া যেত পরিবারের যে কোনও সদস্যের কোনও রকম রোগবালাই হলেই। এঁদের বেশির ভাগেরই নামের শেষে বাহারি বিলেতি ডিগ্রি থাকত না; থাকত কেবল ‘এমবিবিএস’-টুকু। তবুও, বিপদে-আপদে সবসময় পাশে পাওয়া যেত বলে তাঁরা অচিরেই হয়ে উঠতেন গোটা পরিবারের আশ্রয়স্থল। অনেক সময়, অভিভাবকও। এঁরা রোগী দেখতেন পাড়ার ছোট কোনও ওষুধের দোকানের একাংশে, অথবা নিজেদেরই ভিটের একটি নির্দিষ্ট কামরায় (বসন্তবিলাপ-এ তরুণকুমারের চেম্বারের কথা ভাবুন)। অসুখ-বিসুখ করলে বিনা অ্যাপয়েন্টমেন্টে এই সাদামাটা কিঞ্চিৎ অগোছালো চেম্বারগুলিতে উপস্থিত হওয়া যেত। সেখানে ‘ডাক্তার দেখানো’ তো হতই, ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দু’দণ্ড গল্পও করা যেত দেশ-দুনিয়ার হাল হকিকত নিয়ে।
অবশ্য চেম্বারে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি বা উপায় রোগীর না থাকলেও অসুবিধা ছিল না কোনও। টেলিফোন করে কিংবা কাউকে পাঠিয়ে ‘কল’ দিলেই হাতে মস্ত রংচটা অ্যাটাচি কেস নিয়ে, গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে, রোগীর বাড়িতে হাজির হতেন ডাক্তারবাবু। তার পর রোগীকে পরীক্ষা করে, পরিজনদের ওষুধ-পথ্য বুঝিয়ে দিয়ে, কখনও বা এক কাপ চা খেয়ে প্রস্থানের আগে, রোগীর আঙুলগুলো আলতো করে ধরে পরম আত্মীয়ের মতো বরাভয় দিতেন, “চিন্তার কিছু নেই। ভাল হয়ে যাবেন।”
আমাদের সমাজে এই ‘পাড়ার ডাক্তারবাবু’রা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছেন। বদলে যাওয়া কলকাতা এবং মফস্সল শহরগুলিতে আজ এঁদের দেখা পাওয়া দুষ্কর। এর অন্যতম কারণ— পুঁজিবাদের বিস্ফোরণের ফলে সমাজের সর্বস্তরে বিপুল সর্বগ্রাসী কর্পোরেটাইজ়েশন। তার থেকে রেহাই পান না কোনও স্বাধীন ব্যবসায়ী কিংবা পরিষেবা প্রদানকারী— সে পাড়ার ছোট দোকানিই হোন কিংবা স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা। পাড়ার ডাক্তারবাবুরাই বা ছাড় পাবেন কেন? তাঁরাও তো স্বাধীন ভাবে, কোনও নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অঙ্গ না হয়ে, নিজেদের পরিষেবা প্রদান করে থাকেন।
পুঁজিবাদ এবং কর্পোরেটাইজ়েশন একাধিক ভাবে পারিবারিক চিকিৎসকদের অপ্রাসঙ্গিক করে তুলছে। পুঁজিবাদ ব্র্যান্ডের প্রতি এক অদ্ভুত মোহ তৈরি করে। আজ মাছের মুড়ো দিয়ে মুগের ডাল খেয়ে আমরা তখনই তৃপ্তির ঢেকুর তুলি, যখন সেটা কোনও পাঁচতারা ‘বেঙ্গলি রেস্তরাঁ’-র রসুইঘরে রাঁধা হয়। খদ্দরের পাঞ্জাবিটা ঠিক ততটা পছন্দ হয় না আমাদের, যদি না তার গায়ে বিখ্যাত কোনও ‘এথনিক’ ব্র্যান্ডের ট্যাগ লাগানো দেখতে পাই।
চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেও আমরা ব্র্যান্ড-সচেতন আজ— বিলেতের ডিগ্রিধারি ‘স্পেশালিস্ট’ বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া আমাদের রোগ কেউ নির্ণয় করতে পারে বলে মনেই করি না। চিকিৎসক নির্বাচনের সময় তিনি কোন কোন হাসপাতালে যুক্ত, সেই হাসপাতালগুলো পাঁচতারা কি না— সেটাও আমরা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করি চিকিৎসকের ব্র্যান্ড ভ্যালু বোঝার জন্য! সাধারণ পাড়ার ডাক্তারবাবুরা— যাঁদের না আছে বিলেতি ডিগ্রি, না আছে কর্পোরেট হাসপাতালের তকমা— তাঁরা তাই সচরাচর আমাদের পছন্দের চিকিৎসকদের তালিকার উপরের দিকে জায়গা করে নিতে পারেন না। ফলে, একদা যাঁরা দু’দিনের জন্য কোথাও বেড়াতে গেলেও চোখে অন্ধকার দেখতাম, এখন তাঁরাই ব্রাত্য।
অবশ্য শুধু ব্র্যান্ড-সচেতনতার ফলেই আমরা পাড়ার ডাক্তারবাবুদের চেম্বারের পরিবর্তে কর্পোরেট হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চেম্বারে ছুটছি, সেটা বললে পুরোপুরি ঠিক বলা হয় না। গত দু’-তিন দশকে পৃথিবী জুড়ে চিকিৎসাক্ষেত্রে যে অভাবনীয় উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি হয়েছে, পুঁজিবাদ নিশ্চিত করেছে সেই উদ্ভাবন ও অগ্রগতির ফসল যেন কেবল কর্পোরেট হাসপাতাল এবং সেগুলির সঙ্গে যুক্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। অতএব কেউ যদি বলেন, “আমি পাড়ার ডাক্তারবাবুর কাছে না গিয়ে কর্পোরেট হাসপাতালে স্পেশালিস্টের কাছে যাই, কারণ সেখানে আমি অত্যাধুনিক চিকিৎসার সুযোগ পাব”, তা হলে কথাটিকে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না কোনও মতেই।
পাড়ার ডাক্তারবাবুদের পুঁজিবাদ অপ্রাসঙ্গিক করে তুলছে আরও এক ভাবে। পুঁজিবাদ, নানা পন্থায়, আমাদের অত্যন্ত ভিতু এবং সন্দেহপ্রবণ করে তোলে। যে কোনও কর্পোরেট হাসপাতালের বিজ্ঞাপন দেখুন। দেখবেন তাতে লেখা ‘বুক ধড়ফড়? হার্ট অ্যাটাক নয় তো?’ অথবা ‘মাথায় ব্যথা? ব্রেন টিউমার হতে পারে’। সারা ক্ষণ এই ধরনের বিজ্ঞাপন দেখার ফলে কোনও একটা শারীরিক সমস্যা হলে আমরা ধরেই নিই দুয়ারে যম! কিন্তু চিকিৎসাশাস্ত্রই বলে, দশ জনের মধ্যে আট জনের ক্ষেত্রেই বুক ধড়ফড় কিংবা মাথায় ব্যথার কারণ ভয়ঙ্কর কোনও ব্যারাম নয়। অতএব এ ধরনের সমস্যা হলে প্রথমেই পাড়ার ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নেওয়াটাই যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু বিজ্ঞাপন যে-হেতু আমাদের মনের মধ্যে প্রগাঢ় ভয় ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়, তাই সরাসরি কর্পোরেট হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের শরণাপন্ন না হওয়া পর্যন্ত আমরা শান্তি পাই না।
চাহিদা কমে গেলে উৎপাদনও কমে। ‘পাড়ার ডাক্তারবাবু’রা সমাজে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন এবং পেশা হিসাবে ‘পারিবারিক চিকিৎসা’ গুরুত্ব হারাচ্ছে— তাই এই প্রজন্মের ডাক্তারি পড়ুয়ারা স্বাধীন ‘পারিবারিক চিকিৎসক’ হয়ে ওঠার কথা ভাবেন না। তাঁদের ঝোঁক বিশেষজ্ঞ হওয়ার দিকে।
এর ফল কী হচ্ছে? প্রথমত, চিকিৎসাব্যবস্থা ভরে উঠছে কেবল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকে, যাঁরা অত্যন্ত উচ্চ-শিক্ষিত হলেও, অভিজ্ঞতার ব্যাপ্তির নিরিখে পাড়ার ডাক্তারবাবুদের থেকে অনেকটাই পিছিয়ে। পাড়ার ডাক্তারবাবুরা বিবিধ রোগ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতেন সর্ব ক্ষণ, তাই তাঁদের অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার হত বিপুল। গল্প-উপন্যাসে যে আমরা পড়ি ‘পেটে হাত দিয়ে ডাক্তারবাবু বলে দিলেন ম্যালেরিয়া হয়েছে’ সেটা কোনও জাদুবলে নয়, সম্ভব হত এই অভিজ্ঞতার কারণেই। এই বিপুল অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ বিশেষজ্ঞদের কোথায়? চিকিৎসায় যে-হেতু অভিজ্ঞতার মূল্য অপরিসীম, চিকিৎসাব্যবস্থা থেকে অভিজ্ঞ পাড়ার ডাক্তারবাবুদের নিষ্ক্রমণে সামগ্রিক স্বাস্থ্য পরিষেবার মান পড়ে যেতে বাধ্য।
দ্বিতীয়ত, রোগী এবং হাসপাতালগুলির মাঝখানে অবস্থান করতেন পাড়ার ডাক্তারবাবুরা। পাড়ার ডাক্তারবাবুরা প্রয়োজন মনে করলে তবেই রোগীকে পাঠাতেন হাসপাতালে। নচেৎ তাঁদের তত্ত্বাবধানে রোগীর চিকিৎসা চলত বাড়িতেই। এর ফলে এক দিকে যেমন রোগীদের অহেতুক খরচের ভয় থাকত না, অন্য দিকে হাসপাতালগুলির উপরে চাপ কম থাকত, চাপ কম থাকত হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের উপরও। পাড়ার ডাক্তারবাবুরা হারিয়ে যাচ্ছেন বলে, স্বাভাবিক ভাবেই হাসপাতাল এবং বিশেষজ্ঞদের উপরে আজ ভয়ঙ্কর চাপ।
উল্লেখ্য, পাড়ার ডাক্তারবাবুদের হারিয়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি মাসুল গুনতে হচ্ছে সম্ভবত প্রবীণদের। ছোটখাটো অসুখবিসুখ এঁদের লেগেই থাকে। আজ ঘুম হচ্ছে না, তো কাল পেট ফাঁপছে। পরশু হাঁটুতে ব্যথা, তো তার পরের দিন দাঁত কনকন করছে। এ সব অসুখবিসুখ নিয়ে নড়বড়ে শরীরে তো নিয়মিত হাসপাতালের ইমারজেন্সি কিংবা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দ্বারস্থ হওয়া যায় না! অ্যাপয়েন্টমেন্টের ঝক্কি বিপুল, ডাক্তারের ভিজ়িট বিপুলতর। তাই এঁদের বল-ভরসা ছিলেন পাড়ার ডাক্তারবাবুরাই। সেই ভরসার জায়গাটা সঙ্কুচিত হয়ে আসছে বলে, এঁদের দৈনন্দিন বেঁচে থাকাটা যে কত কঠিন হয়ে উঠছে সেটা বোঝা শক্ত নয়।
সব মিলিয়ে তাই পাড়ার ডাক্তারবাবুদের হারিয়ে যাওয়া বেশ ভয়ের কথা। কিন্তু, পুঁজিবাদের বিজয়রথের গতি প্রতিহত করতে পারেন, পাড়ার ডাক্তারবাবুদের সেই সাধ্য কোথায়? অগ্নীশ্বররা, অতএব, রয়ে যাবেন ইতিহাসের পাতায়, স্মৃতিতে।
অর্থনীতি বিভাগ, শিব নাদার ইউনিভার্সিটি, দিল্লি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy