উত্তরায়ণ: লোকসভা নির্বাচনের আগে উত্তরপ্রদেশে প্রধানমন্ত্রী মোদীর নামে প্রচার ও সমাবেশ জোরদার, মিরাট, ৩১ মার্চ। পিটিআই।
ছোটবেলায় পড়েছি, রূপকথার গল্পে দৈত্যকে কাবু করতে হলে তার প্রাণভোমরা খুঁজে বার করাই ছিল আসল কাজ। রাজপুত্রকে দিঘির জলের গভীরে ডুব দিতে হত। তুলে আনতে হত রুপোর কৌটো। তার মধ্যে বন্দি প্রাণভোমরা হাতে এলেই দৈত্যের খেল খতম!
রাজনীতিতে কাউকে কাবু করতে হলে তার প্রাণভোমরা খুঁজে বার করা কঠিন নয়। কঠিন হল, প্রাণভোমরাকে হাতে পেয়েও কব্জা করা।
যদি কেউ প্রশ্ন করেন, বিজেপির প্রাণভোমরা কোথায় রয়েছে? চোখ বন্ধ করে উত্তর দেওয়া যায়, হিন্দি বলয়ে। আরও স্পষ্ট করে বললে, হিন্দি বলয়ের দশটি রাজ্যে। বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লি, হরিয়ানা, রাজস্থান, হিমাচলপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ড। এই দশ রাজ্য নিয়েই দেশের হিন্দি বলয়। আর এই হিন্দি বলয়ে রয়েছে লোকসভার ২২৫টি আসন।
আর সপ্তাহখানেক পরেই লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোটগ্রহণ। এমন একটা সময়ে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের দিকে ফিরে তাকানো যাক। বিজেপি তথা এনডিএ এই হিন্দি বলয়ে কেমন ফল করেছিল? এক কথায় রোমহর্ষক। ২২৫টি আসনের মধ্যে এনডিএ ২০৩টি আসনে জিতে ক্ষমতায় ফিরেছিল। লোকসভায় মোট আসন সংখ্যা ৫৪৩টি। সরকার গড়তে লাগে ২৭২টি আসন। এর মধ্যে শুধু হিন্দি বলয় থেকেই এনডিএ-র ২০৩টি আসন জেতার অর্থ, খেলা ওখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। বাকি পূর্ব বা দক্ষিণ ভারতে শত চেষ্টা করেও বিরোধীদের পক্ষে নরেন্দ্র মোদীর সরকার গঠন আটকানো সম্ভব ছিল না।
আর এইখানেই বিজেপির প্রাণভোমরা লুকিয়ে রয়েছে। এই হিন্দি বলয়ের দশ রাজ্যের ২২৫টি আসন। নরেন্দ্র মোদীর লক্ষ্য মেনে এনডিএ-কে যদি এ বার চারশো পার করতে হয়, তা হলে এই হিন্দি বলয় থেকে আরও এক বার ২০০টির বেশি আসন জিততে হবে। তার পরে বাকি শ’তিনেক আসন থেকে আরও দু’শো আসন জেতার লড়াই থাকবে। উল্টো দিক থেকে দেখলে, বিরোধী জোট ইন্ডিয়া-কে যদি নরেন্দ্র মোদীর অশ্বমেধের ঘোড়া থামাতে হয়, তা হলে সেটা এই হিন্দি বলয়েই করে দেখাতে হবে। দক্ষিণ ভারত বা পূর্ব ভারতের আশায় বসে থাকলে হবে না— আরও নির্দিষ্ট করে বললে, খাস উত্তরপ্রদেশে বিজেপিকে ধাক্কা দিতে হবে।
ভারতীয় রাজনীতির প্রাচীন প্রবাদ, দিল্লির ক্ষমতায় পৌঁছনোর রাস্তাটা উত্তরপ্রদেশের মধ্যে দিয়ে যায়। ক্লিশে শোনাতে পারে। তবু বাস্তব। নরেন্দ্র মোদী নিজে তা প্রমাণ করেছেন। দশ বছর আগে তিনি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে প্রধানমন্ত্রীর গদিতে পৌঁছেছিলেন ঠিকই, তবে গান্ধীনগর থেকে ভায়া বারাণসী হয়ে দিল্লির রাস্তা নিয়েছিলেন। ওই যে প্রাচীন প্রবাদ: দিল্লিতে ক্ষমতায় পৌঁছনোর রাস্তাটা উত্তরপ্রদেশ হয়েই যায়।
রাজনীতির এই প্রাচীন প্রবাদের সহজ ব্যাখ্যা হল, উত্তরপ্রদেশ নামক রাজ্যেই লোকসভার আসন সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আশিটি। এই আশিটি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে বিজেপি গত লোকসভা ভোটে বাষট্টিটি আসন জিতেছিল। বিজেপির শরিক আপনা দল জিতেছিল দু’টি। সব মিলিয়ে উত্তরপ্রদেশ থেকে চৌষট্টিটি আসন এনডিএ-র ঝুলিতে গিয়েছিল। আর বিহারের চল্লিশটির মধ্যে এনডিএ গত বার ঊনচল্লিশটি জিতেছিল।
হিন্দি বলয়ের বাকি রাজ্যের মধ্যে একাধিক রাজ্যে বিজেপি বা এনডিএ সেখানকার সব আসন জিতেছিল। যেমন, হরিয়ানা। দশটির মধ্যে দশটিই আসন বিজেপি জিতেছিল। রাজস্থানেও তাই। পঁচিশে পঁচিশ। দিল্লিতেও সাতে সাত। উত্তরাখণ্ডে পাঁচে পাঁচ, হিমাচলে চারে চার। মধ্যপ্রদেশের ঊনত্রিশটির মধ্যে একটি বাদে সব আসন এনডিএ জিতেছিল। ছত্তীসগঢ়ের এগারোটি, ঝাড়খণ্ডের চোদ্দোটির মধ্যে মাত্র দু’টি করে আসন বিজেপির অধরা ছিল।
এখান থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট। বিজেপি হিন্দি বলয়ে গত লোকসভা ভোটে যে রকম ফল করেছে, তার থেকে আরও ভাল কিছু করা কঠিন। কোনও ব্যাটসম্যানের পক্ষে ছয় বলে ছ’টি ছক্কা হাঁকানোর থেকে বেশি কিছু করা সম্ভব নয়, এ-ও তেমন। বিজেপি গত লোকসভা ভোটেই তা করে বসে রয়েছে। এ বারের ভোটে বিজেপির চ্যালেঞ্জ হল, গত বারের ফলটাই ধরে রাখা। সে জন্য হিন্দি বলয়ের দুই বড় রাজ্য উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে বিজেপির আগের ভোটের ফলের পুনরাবৃত্তি করতে হবে।
প্রথমে বিহার। নীতীশ কুমার গত লোকসভা ভোটে বিজেপির সঙ্গে ছিলেন। পরে আরজেডি-কংগ্রেস-বামেদের সঙ্গে মহাগঠবন্ধনে যোগ দেন। ইন্ডিয়া জোটের অন্যতম শরিক হয়ে ওঠেন। তার পরে ফের ডিগবাজি খান। বিজেপিও নীতীশ কুমারের জন্য দরজা বন্ধ বলে ফের দরজা খুলে তাঁকে স্বাগত জানায়। ওই যে, বিহারে আগের বারের মতোই ভাল ফল করার চ্যালেঞ্জ।
বাকি থাকে উত্তরপ্রদেশ। রাজ্যের আশিটি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে ২০১৪-য় বিজেপি একাত্তরটি আসন জিতেছিল। ২০১৯-এ তা বাষট্টিতে নেমে আসে। এ বার ভোটের আগে বিজেপির সবচেয়ে বড় লাভ নীতীশ কুমারের মতোই ইন্ডিয়া জোট ছেড়ে জয়ন্ত চৌধরির রাষ্ট্রীয় লোক দলের এনডিএ-তে যোগ দেওয়া। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের জাঠ কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে রাষ্ট্রীয় লোক দলের সমর্থন এখনও অটুট। তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসা, এখনও ফসলের দাম নিয়ে ক্ষুব্ধ জাঠ কৃষকদের সমর্থন পেতে মোদী সরকার চৌধরি চরণ সিংহকে ভারতরত্ন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার সঙ্গে বিভিন্ন অনগ্রসর সম্প্রদায়কে পাশে পেতে বিজেপি অনুপ্রিয়া পটেলের আপনা দল, ওমপ্রকাশ রাজভড়ের সুহেলদেব ভারতীয় সমাজ পার্টি, সঞ্জয় নিষাদের নির্বল ইন্ডিয়ান শোষিত হামারা আম দল (নিষাদ)-এর সঙ্গেও হাত মিলিয়েছে।
উল্টো দিকে, উত্তরপ্রদেশে ক্ষয়িষ্ণু কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়ে একাই লড়ছেন অখিলেশ যাদব। সঙ্গে কেশব দেব মৌর্যের মহান দলের মতো ওবিসি-দের সংগঠন রয়েছে। কিন্তু ২০২২-এর উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা ভোটে অখিলেশ যে রামধনু জোট তৈরি করেছিলেন, সেখান থেকে জয়ন্ত চৌধরি ও রাজভড়ের দল এ বার এনডিএ-তে চলে গিয়েছে। অখিলেশের এ বার প্রধান অস্ত্র— পিডিএ। ‘পিছড়ে, দলিত, অল্পসংখ্যক’। অনগ্রসর, দলিত ও সংখ্যালঘু। এত দিন যাদব ছাড়া অন্যান্য ওবিসি ও মায়াবতীর জাটভ ছাড়া অন্য দলিতদের ভোট বিজেপি পেয়ে এসেছে। অখিলেশ মনে করছেন, এই দুই সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ কৃষির সমস্যা, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্বের মতো বিষয়ে বিজেপির প্রতি ক্ষুব্ধ। রাহুল গান্ধীও এই অংশের ভোটকেই তাঁর জাতগণনার দাবি, আর্থিক-সামাজিক ন্যায়, রুটিরুজির সমস্যার কথা বলে বিজেপির দিক থেকে সরিয়ে আনতে চাইছেন।
উত্তরপ্রদেশে বিরোধী জোটের আসল সমস্যা হল, বিজেপির ‘রাম, রোটি ও রাষ্ট্র’-এর কৌশল। রামমন্দির, সরকারি প্রকল্পের সুবিধা ও উগ্র জাতীয়তাবাদের ত্রিমুখী রণনীতি। এক দিকে, রামমন্দিরের উদ্বোধনকে সামনে রেখে বিজেপি একই সঙ্গে হিন্দুত্বের ভাবাবেগ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে গর্বের ভাবনাকে উস্কে দিতে চাইছে। অন্য দিকে, মন্দিরকে কেন্দ্র করে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। কেন্দ্রের মোদী সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প, আর উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের বিভিন্ন সুবিধা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়ে বিজেপি তার সুবিধা তুলতে চাইছে। তার সঙ্গে উগ্র জাতীয়তাবাদ রয়েছেই। হিন্দি বলয়ের প্রাণকেন্দ্র উত্তরপ্রদেশে এই তিন কৌশলের ধার ও ভারে এখনও ভোট জেতা সম্ভব বলে বিজেপি নেতৃত্ব নিশ্চিত।
এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে অখিলেশ যাদব ও রাহুল গান্ধীর জোট সমাজবাদী পার্টির চিরাচরিত ভোটব্যাঙ্ক মুসলিম-যাদব সম্প্রদায়ের বাইরে দলিত, ওবিসি-দের ভোট যথেষ্ট মাত্রায় টানতে পারবে কি না, সেটাই আসল প্রশ্ন। তাতে সফল হলে বিরোধী শিবির উত্তরপ্রদেশে বিজেপির আসন কমানোর স্বপ্ন দেখতে পারে। আর তা হলেই হিন্দি বলয়ে বিজেপিকে ধাক্কা দেওয়া যাবে, যেখানে বিজেপির প্রাণভোমরা রয়েছে।
ওই যে বলেছিলাম, রাজনীতিতে অপর পক্ষের প্রাণভোমরা খুঁজে পাওয়া সহজ। তবে তাকে কব্জা করা কঠিন। রাজনীতি এই কারণেই রূপকথা নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy