Advertisement
E-Paper

হাতে এক দশকও নেই

ভোট রাজনীতি বাঁচলেও রাজ্য বাঁচবে তো? তথ্য বলছে, লড়াইটা ইতিমধ্যেই কঠিন। মাঠে নামতে যত দেরি হবে, তত তা কঠিনতর হবে।

A Photograph representing Global Warming

পরিবেশকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে, যথেচ্ছ গাছ কেটে, জলাভূমি বুজিয়ে ‘উন্নয়নের যজ্ঞে’ শামিল হওয়ার কারণেই এই দশা। প্রতীকী ছবি।

জয়ন্ত বসু

শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২৩ ০৫:৫৪
Share
Save

পরিবেশবিদরা বার বার সাবধান করা সত্ত্বেও কেন রাজনীতিকরা গুরুত্ব দেন না— প্রশ্ন শুনে হেসেছিলেন চিপকো আন্দোলনের প্রাণপুরুষ সুন্দরলাল বহুগুণা, যাঁর লড়াই ইন্দিরা গান্ধীকে বাধ্য করেছিল হিমালয়ে গাছ কাটার নিয়ম পাল্টাতে। বহুগুণা বলেছিলেন, ওঁরা পাঁচ বছরের কথা ভাবেন। আর আমরা ভাবি পাঁচ দশকের কথা; তাই!

২০০৯ সালে শোনা কথাটা মনে পড়ল যখন প্রবল তাপপ্রবাহে গোটা রাজ্য, তথা দেশ পুড়ছে, এবং বিজ্ঞানীরা স্পষ্ট জানাচ্ছেন, পরিবেশকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে, যথেচ্ছ গাছ কেটে, জলাভূমি বুজিয়ে ‘উন্নয়নের যজ্ঞে’ শামিল হওয়ার কারণেই এই দশা। বস্তুত, রাষ্ট্রপুঞ্জের অধীনস্থ বিজ্ঞান সংস্থা ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ-এর সম্প্রতি প্রকাশিত জলবায়ু রিপোর্টে পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানীরা অভিযোগ করেছেন, বিশ্ব জুড়ে রাজনীতিবিদরা জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্রতা কমাতে মোটেই সক্রিয় নন; এবং সাবধান করা সত্ত্বেও গত পাঁচ বছরে এ প্রবণতা আটকাতে প্রায় কিছুই করেননি। আশ্চর্য সমাপতন; এই রিপোর্ট প্রকাশিত হল চিপকো আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর পূর্তির ঠিক আগেই।

রিপোর্ট জানাচ্ছে যে, শেষের শুরু আটকাতে আর এক দশকও হাতে নেই। অবিলম্বে বিশ্ব জুড়ে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ না কমালে, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারকে শূন্যের দিকে ঠেলে দিতে না পারলে, ২০৩০ সালের মধ্যে যে কোনও সময়ে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি ছাড়াবে। বহুলাংশে বাড়বে বিপদ। বলা হয়েছে, ভয়ঙ্কর ক্ষতির সম্মুখীন হতে চলেছে ভারত-সহ দক্ষিণ এশিয়ার গরিব মানুষরা, যাঁদের পৃথিবীর উষ্ণায়ন বৃদ্ধিতে বিন্দুমাত্র ভূমিকাও নেই।

এক দিকে হিমালয়, অন্য দিকে বঙ্গোপসাগর এবং মাঝখানে জঙ্গলমহলের খটখটে মালভূমি অঞ্চল নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ দেশের অন্যতম জলবায়ু বিপন্ন রাজ্য, যার মধ্যে সুন্দরবন অঞ্চল পৃথিবীর অন্যতম ক্লাইমেট হটস্পট-এর তকমা পাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এ রাজ্যের রাজনীতিক এবং সরকার কী করছে? রবীন্দ্রনাথ এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, মতবিরোধ ভাল, কিন্তু তার প্রকাশের উপর একটা নিয়মের শাসন থাকা প্রয়োজন। মজা করেছিলেন এই বলে যে, নতুবা বরযাত্রী ও কন্যাপক্ষে ঝগড়া করে বিবাহটাকেই পণ্ড করে দেবে! পশ্চিমবঙ্গে এখন অনেকটা সেই হাল, যেখানে সর্বগ্রাসী ঝগড়ায় মত্ত যাবতীয় রাজনৈতিক দল। কখনও নিয়োগ দুর্নীতি, কখনও ধর্মীয় মেরুকরণ, আবার কখনও স্রেফ বাইশ লাখি গাড়ি নিয়ে বিবাদ। কে কাকে কত ক্ষণে কথার প্যাঁচে ধরাশায়ী করে ‘কেমন দিলাম’ বলতে পারে, তার কুস্তি, থুড়ি রাজনীতি চলছে। এই সমীকরণের একশো মাইলের মধ্যে কোথাও টেকসই উন্নয়নের কথা নেই, রাজ্যের জলবায়ু বিপর্যয় থেকে বাঁচার উপায় খোঁজাকে অগ্রাধিকার দেওয়া নেই। আপনি (ভোট রাজনীতি) বাঁচলে তবে তো জলবায়ুর নাম!

কিন্তু ভোট রাজনীতি বাঁচলেও রাজ্য বাঁচবে তো? তথ্য বলছে, লড়াইটা ইতিমধ্যেই কঠিন। মাঠে নামতে যত দেরি হবে, তত তা কঠিনতর হবে। জানা যাচ্ছে যে, ‘এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না’ বলে রাজ্যের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলি যদি বসে থাকে, তবে আর পাঁচ দশকের মধ্যে কলকাতা-সমেত দক্ষিণবঙ্গের অধিকাংশ শহরের সর্বোচ্চ তাপমান পঞ্চাশ ডিগ্রি ছুঁই-ছুঁই হতে পারে। অর্থাৎ, আজকের রাজস্থান হয়তো বা আগামী কালের কলকাতা; দিল্লিকে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির দৌড়ে হারাতে পারে দার্জিলিং! ইতিমধ্যেই ‘সাইক্লোন রাজধানী’ বলে ঘোষিত সুন্দরবনে আরও নিয়মিত মারাত্মক ঝড় আছড়ে পড়তে পারে, যার ধাক্কা পড়বে কলকাতা-সহ গোটা দক্ষিণবঙ্গে। পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরের জলস্তর এখনকার তুলনায় প্রায় চার গুণ বেড়ে ভাসাবে আরও বহু নিচু অঞ্চলকে। বাড়বে দীর্ঘমেয়াদি বিপন্নতাও; প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জীবিকার সঙ্কটে পড়বেন রাজ্যের এক বড় অংশের মানুষ। অস্তিত্বের সঙ্কট তো ছেড়েই দিলাম।

এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন যে, এখন থেকে জলবায়ু বিপর্যয়কে কোন প্রশাসনিক পরিকল্পনা ও প্রয়োগের একেবারে কেন্দ্রে রাখা হবে, বাড়ানো হবে পুরসভা ও পঞ্চায়েতগুলির সচেতনতা, ক্ষমতা ও সক্রিয়তা। বিশেষ করে, জলবায়ু বিপন্ন অঞ্চলগুলিতে। যে ভাবে কোভিড কালে মুখ্যমন্ত্রী সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন; সারা বছর ধরে চাই তার অ্যাকশন রিপ্লে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকেও জলবায়ু বিপন্নতাকে আলোচনার সামনের সারিতে তুলে আনতে হবে। এখন রাজ্যে যাঁরা বিরোধী, তাঁরাও ক্ষমতায় থাকাকালীন পরিবেশ কল্কে পায়নি। বিরোধীদের প্রশ্ন তুলতে হবে যে, অন্যতম বিপন্ন অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও কেন পশ্চিমবঙ্গ জলবায়ু সংক্রান্ত কাজ করার মাপকাঠিতে মাত্র ৩৯ শতাংশ নম্বর নিয়ে দেশের মধ্যে শেষের সারিতে?

সম্প্রতি রাজ্য পরিবেশ দফতর ‘স্টেট ক্লাইমেট অ্যাকশন প্ল্যান’ বানানোর উদ্যোগ করেছে। কিন্তু তার পর? বাম আমলের শেষ দিকে এমনই একটি জলবায়ু পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল রাজ্যের জন্য, যা কোন ফাইলে বন্দি আছে, তা খুঁজেপেতে হয়তো সিবিআই-কে লাগবে! গোটা পৃথিবীর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে আজ বলার সময় হয়েছে— ‘নাউ অর নেভার’। এসি গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসি ঘরে ঢোকার ফাঁকে রাজনীতিকরা নিশ্চয়ই টের পাচ্ছেন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Global Warming deforestation Tree Cutting hot temperature Green House Gas

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}