নারীবিষয়ক সেমিনারে তুমুল উপচে-পড়া ভিড়, কারণ ক্রেডিট পাওয়া যাবে অ্যাটেন্ডেন্স দিলে। প্রতীকী ছবি।
শহর যেখানে শেষ সেই প্রান্ত থেকে মাত্র এক ঘণ্টা একটা সরু কালো এবড়োখেবড়ো রাস্তায় চলে, পথের বাঁকে একটি মাছের পাইকেরি হাটের প্রচণ্ড জ্যাম ঠেলে, হঠাৎ গজানো বিউটি পার্লার, ভুইঁফোঁড় মন্দির পেরিয়ে একটা আচমকা ফাঁকা মাঠ, পুকুরের মাঝখানে এসে পড়া। কন্যাশ্রীর সাইকেলে দু’বিনুনি মেয়েদের দেখতে দেখতে চলা। ছোট ছোট বাড়ির ফাঁকে হঠাৎ রাস্তাটা শেষ। তার পর এক দিকে অবিন্যস্ত প্লটে ফিল্ম সিটি লেখা থাকে। জিপিএস ম্যাপ বেমালুম বেপাত্তা হয়। অন্য দিকে, ঝাঁ-চকচকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়ি আলাদিনের প্রাসাদের মতো উঠে যায়।
কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘রুরাল ক্যাম্পাস’-এ কখনও নারী ও তার সামাজিক অবস্থান বিষয়ে বক্তৃতা করতে গিয়েছেন? এই অধম গিয়েছে। এইখানে বাংলার অধ্যাপিকারা তাঁতের শাড়ি পরে আসেন না। গাড়িতেও আসেন না। তাঁরা কলকাতার বা দিল্লির বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে ভাবনার সলতেতে আগুন জ্বেলেই নিজেদের স্কুটি চালিয়ে আসেন। ম্যাডামরা কী পোশাক পরেছেন তা-ও আলোচ্য বিষয় হয় না। জিনস বা সালোয়ার কামিজ় যেটা খুশিই চলতে পারে।
অধ্যাপিকা বলেন, তাঁর জীবনের স্লোগান, “আধুনিক বাংলা কবিতা তোমাকে বোঝাবই বোঝাব।” এক ক্লাস ছেলেমেয়েদের সদ্য প্রকাশিত গল্প উপন্যাসের সামাজিক বার্তার অর্থভেদ করতে উৎসাহ দেন। সাবঅলটার্নের মানে বোঝান।
নারীবিষয়ক সেমিনারে তুমুল উপচে-পড়া ভিড়, কারণ ক্রেডিট পাওয়া যাবে অ্যাটেন্ডেন্স দিলে। পুষ্পগুচ্ছ প্রদান ও পরিচয় করানোর আনুষ্ঠানিকতার পর একটু একটু করে কথা শুরু হয়। কেতাবি কথা। কিন্তু অনেক জোড়া চোখ উৎসুক ভাবে বক্তার দিকে চেয়ে। কারও হাই ওঠে না। পোডিয়াম থেকে বক্তা লক্ষ করেন, গ্রামীণ এই মেয়েরা কিন্তু কেউ জড়সড় তো নয়ই, বি এ এম এ ক্লাসের সবাই সালোয়ার কামিজ়ে, লেগিংস ও কুর্তিতে স্বচ্ছন্দ। শহর গ্রামের বিভেদ উত্তর-উদারীকরণ ভারতে ঘুচে তো গিয়েছে বহু দিনই। তথাপি পোশাক পরার অধিকার নিয়েও যে এত খোলাখুলি আলোচনা চলতে পারে, এ ছিল বক্তার প্রত্যাশার বাইরে। ‘আমার শরীর আমার অধিকার’ স্লোগান নিয়ে সুস্থ বিতর্ক জমে ওঠে। দূর থেকে দেখেন, একটি সিটে ঘেঁষাঘেঁষি করে তিনটি বোরখা-পরিহিতা মেয়ে। এখানে ছেলেরা জিনস বা প্যান্ট আর শার্টে।
পিঙ্কি ধর বা বেবি বিশ্বাস, পুতুল পাল বা জলি মণ্ডলের মতো অনেকেই বাংলা সাহিত্য পড়ে। আশেপাশেই বসে থাকে গোপাল রফিক সুকান্তরাও। সকালে গোপাল সুকান্ত কয়েক কিলোমিটার দূরের বড় মাছের হাটে মাছ কেটে, দোকানের হিসাব সামলে ক্লাস করতে আসে। মাছের ব্যবসায় নিজের কাজের উপার্জনে নিজের সেলফ-ফিনান্সিং কোর্সের খরচ উঠে আসে। স্কলারশিপ বা অন্যান্য সরকারি স্কিমের প্রসেসিং-ও বিশ্ববিদ্যালয় করে দেয়।
অর্থনীতির বা সমাজতত্ত্বের ছাত্রেরাও কলকাতা আগত বক্তার কথা শোনে। আলোচনা হয় আশাপূর্ণা দেবী থেকে কবিতা সিংহ অবধি লেখকদের লড়াই। বক্তা কথা তোলেন বঙ্কিমের লেখায় নারীর চিত্রায়ণ নিয়ে। বক্তা ভুলে যান, আজকের জীবিত লেখকদের লেখাও এরা পড়ছে। অধ্যাপকদের স্বাধীনতার যথাসম্ভব ব্যবহার করে ওঁরা ওদের নতুন তৈরি-হওয়া সিলেবাসে ঢুকিয়ে দিয়েছেন সাম্প্রতিক সময়ের জীবিত সাহিত্যিকদের বইও। আজকের দিনের লেখা কথা, পরিবেশ থেকে জনজাতি, নারীবাদের কথা ওদের পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত।
এর পর প্রশ্নোত্তরের পালা। সর্বাগ্রে হাত তোলে একটি ছেলেই। তার প্রশ্ন, লিঙ্গ বা জেন্ডারের বিষয় আলাদা করে দেখা হবে, না কি এটা সাম্য-সংক্রান্ত আর সব বিষয়েরই একটি। বর্ণবিদ্বেষ থেকে মৌলবাদ, জাতপাত দলিত বা জনজাতির লড়াই আর মেয়েদের লড়াই কোথায় আলাদা আর কোথায় এক? নানান ‘অপর’-এর মতোই পুরুষ-নারীর বৈষম্য কি নারীকে একটি ‘অপর’-এর দিকে ঠেলে? যে কোনও হেজিমনির মতোই পিতৃতান্ত্রিকতাও একটা কাঠামো, তন্ত্র-মাত্রেই তো আপত্তির। তাই না?
বক্তা চমকে যান। থমকেও। বাহ্ বাহ্, খুব ভাল প্রশ্ন করেছ! অবশ্যই। সমাজের কাঠামোর অন্যান্য নানা অন্যায়-অবিচারের ভিতরেই একটি করে দেখতে হবে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যকেও। বলে মৌখিক পিঠ-চাপড়ের পর অপেক্ষা করেন। এ বার একটি মেয়ে প্রশ্ন করে। “ম্যাডাম, আমাদের এই আলোচনাগুলো কি শুধু সেমিনারের চার দেওয়ালের মধ্যেই আবদ্ধ থাকবে? আমাদের মা বা দিদিমার কোনও কাজে লাগানো যাবে না?”
আলাদা আলাদা কণ্ঠ এ বার কথা বলছে। “আমাদের যে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিতে চায় পরিবার, তাদের কী বোঝাব?” “আমার ঠাকুমাকে কী ভাবে বলব, ঋতুকালে পুজোর আসন বা আচারের বয়াম ছোঁয়াছুঁয়ির নিষেধ আসলে অবৈজ্ঞানিক? সিঁদুর পরা বা নোয়া পরার সঙ্গে পরিবারের স্বাস্থ্য বা ভাল থাকার সম্পর্ক নেই?”
প্রশ্নের বাঁধ ভেঙে যায়। বক্তা অবাক হয়ে যান। এ-ও দেখেন যে, মেয়েটি যখন ঋতু-বিষয়ক প্রশ্ন করল, দেড়শো তরুণ-তরুণীর কারও চোখে নিষিদ্ধতার ঝিলিক দিল না। একটি ছেলের মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। আলোচনার গতিবেগ দেখে সে হাসি সংবরণ করল। প্রত্যেকেই নিজের সিটে নড়েচড়ে বসে। একতরফা বক্তৃতার থেকে এই আলোচনাই তাদের বেশি উৎসাহিত করে।
এক ছাত্রী প্রশ্ন করে, বাড়িতে যখন বলে রাতে বেরোবি না, কী ভাবে যুক্তি দিয়ে বোঝাব?
অন্য জন সাম্প্রতিক কবিদের লেখা থেকে লক্ষ্মী-অলক্ষ্মী বিতর্ক নিয়ে কথা তোলে। আলোচনা শুরু হয়ে যায় সাম্প্রতিক কোনও ঘটনা নিয়ে। সংবাদপত্রে আলোচিত বিষয় নিয়ে। কলকাকলিমুখর ঘরে বার বার উঠে যায় এই কথার রেশ... যা পড়ছি তা কি বইয়ের পাতাতেই থাকবে? না জীবনেও আসবে?
অজস্র কথার ফাঁকে ফাঁকে বক্তার মনে পড়ে যায়, ভারতের ৬৭% নাগরিক গ্রামে থাকেন। মনে পড়ে যায় নানা পরিসংখ্যান, দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেওয়ার ‘বাজার’-এ পশ্চিমবঙ্গের কোনও কোনও জেলা থেকে উঠে আসা এক-একটি প্রতিবাদী মেয়ের রুখে দাঁড়ানোর তথ্য। আবার, সার্বিক হতাশার গল্পও অনেক শোনা আছে তাঁর। তরুণ প্রজন্মকে বইমুখী করতে শিক্ষক বা বাবা-মায়েরা নাকি নাজেহাল।
এই গ্রামীণ ক্যাম্পাসের ছেলেমেয়েরা অন্য কোনও জগৎ থেকে এসে পড়েছে কি? না তো। মনে পড়ে যায়, স্টাফ রুমে চা খেতে খেতে অধ্যাপিকাটি বলেছিলেন দু’টি তথ্য। এক, এক ছাত্রী পরীক্ষার আগের রাতে ম্যাডামকে ফোন করেছিল। কেঁদে বলেছিল, “কাল আমি পরীক্ষা দিতে আসব না ম্যাম। আমার বাবা আজ মাকে উঠোনে টেনে এনে মেরেছে। শুধু মারেনি, মায়ের গায়ের জামা ছিঁড়ে দিয়েছে। সবার সামনে। কেউ প্রতিবাদ করেনি।”
অধ্যাপিকা বলেছিলেন, “ঠিক এই কারণেই তোমাকে কাল পরীক্ষা দিতে আসতে হবে! ডিগ্রিটা তোমার জীবনে একটা জরুরি হাতিয়ার হবে।”
মনে পড়ে যায়, পাশেই বড় খেলার মাঠ। ঘাস উঠে গিয়েছে ছেলেমেয়েদের পদদাপে। অধ্যাপিকার দেওয়া আর একটি তথ্য— এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছেলেমেয়েই অসম্ভব ভাল ফুটবল খেলে। হ্যাঁ, মেয়েরাও। মেয়েদের আছে আলাদা ফুটবল টিম। শহরের মূল ক্যাম্পাসে খেলতে গেলে রুরাল ক্যাম্পাসের টিমই জিতে ফেরে সর্বদা।
নিজে উপার্জন করে পড়ার আর একটি নমুনা। স্থানীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মেয়েটি অসাধারণ নাচে। সে বাড়ি থেকে পড়ার টাকা নেয় না। নিজের উপার্জনে পড়ছে। ভাঙা পরিবার থেকে এসেছে সে। মা মুড়ি বেচেন। বাবা চলে গেছেন বাড়ি ছেড়ে।
উপার্জন কোথা থেকে? গ্রামাঞ্চলে প্রচুর অনুষ্ঠান হয়। রবীন্দ্রনৃত্য থেকে হিন্দি গান। ডিজে বক্স চালিয়ে খোলা মঞ্চের নাচ অথবা হলঘরে প্যান্ডেলে নৃত্যনাট্য। সেই সব নাচে পেশাদারি ভাবে নাচে ছোটবেলা থেকে নাচের স্কুলে নাচ শেখা এই মেয়ে। এই সব পারফরম্যান্সের জন্য দু’হাজার তিন হাজার টাকা পার নাইট পাওয়া যায়। সেই রোজগার থেকেই সে পড়া চালায়। সে বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী।
বক্তা বুঝতে পারেন, ওদের কথাগুলো শোনার জন্য আর এক দিন পঞ্চাশ কিলোমিটার তাঁকে সফর করতেই হবে। আসতেই হবে আবার। বক্তার নিজের পুঁথিগত কথা বলার জন্য এ বারের আসা। কিন্তু সে বৃত্ত সম্পূর্ণ নয়। কারণ, কথা তৈরি হয়ে উঠছে আসলে ওইখান থেকে। আর সেই কথাকে উঠে আসতে হবে বক্তার দিকে। উপর থেকে নীচের দিকে কথা চারিয়ে দেওয়ার কাল বিগতপ্রায়। বড়রা ছোটদের বলবে শুধু, সেই দিন আর নেই। তরুণ-তরুণীরাই এখন থেকে জানাবে। কয়েক দশকের পড়াকে ‘আনলার্ন’ করে আবার নতুন করে ওদের নাড়ি ধরা শিখতেই হবে, যদি সময়কে, সমাজকে, আর নানা ধরনের বৈষম্য, যার ভিতরে লিঙ্গসাম্যও আছে, বিষয়গুলোকে বুঝতে হয়।
ওই যে সোনালি নাচছে। ধাধিনা নাতিনা, ধাধিনা নাতিনা ভোরের দরজা হাট/ নাতিনা ধাধিনা শুনছি নতুন শতাব্দীটার ডাক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy