ঐতিহ্য সংরক্ষণ বিশ্ব সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইউনেস্কো সে জন্যই পৃথিবীর সভ্যতা-সংস্কৃতির সম্ভার থেকে অতি মূল্যবান স্মারকগুলিকে বিশ্ব সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে ঘোষণা করে। তা হয়ে ওঠে বিশ্বসম্পদ, সেগুলি রক্ষা করার দায়িত্ব তখন সবার উপরেই বর্তায়। এই তালিকায় ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর, ইউনেস্কোর ‘মেমরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর পরামর্শদাতা সভা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বক্তৃতা তালিকাভুক্ত করার কথা ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ, বিশ্বমানব এ বক্তৃতাটি সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্যতম নথি হিসেবে সংরক্ষণ করবে।
বক্তৃতা কি দেখা যায়? অনেক বক্তৃতা শুধু শোনার নয়, দেখারও। আমরা ভাগ্যবান, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের অপরাহ্ণে ঢাকার তৎকালীন রমনা রেসকোর্স ময়দানে সেই বক্তৃতাটি শুনেছিলাম, দেখেছিলাম। ৭ মার্চের বক্তৃতায় স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল ঠিকই, কিন্তু তাতেই তা শেষ নয়। পাকিস্তান নামক এক উপনিবেশে বঙ্গবন্ধুর তেইশ বছর বসবাসের অভিজ্ঞতার সংহত রূপ ছিল ৭ মার্চের বক্তৃতা। ওই তেইশ বছরের অভিজ্ঞতা ছিল তিক্ত, যন্ত্রণাময়, নিপীড়নমূলক। ৭ মার্চের ভাষণ এক অর্থে ছিল ‘কলোনি’তে বসবাসকারী এক রাজনীতিবিদের বক্তৃতা, যিনি তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে মানুষকে স্বাধীনতার পথ দেখাচ্ছিলেন। সে বক্তৃতা ছিল উপনিবেশে বসবাসকারী এক জনের অভিজ্ঞতা এবং একই সঙ্গে সেই উপনিবেশের ইতিহাসও।
সে দিন মঞ্চে এসে কালো ভারী ফ্রেমের চশমাটি তিনি খুলে রাখলেন ঢালু টেবিলের উপর। শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন, সবই বোঝেন।” উনিশ মিনিটের ভাষণ, লিখিত নয়। কিন্তু এক বারও থমকাতে হয়নি। পরে বিবিসি-র ভিডিয়োতে ক্লোজ় আপে দেখেছি আবেগে কাঁপছে তাঁর মুখ, কিন্তু সমস্ত অবয়বে দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ছাপ। বোঝা যায় তিনি পিছোবেন না। সে দিন যিনি রেসকোর্সে ছিলেন না, তাঁকে বোঝানো যাবে না ৭ মার্চ বাংলাদেশের জন্য কী ছিল। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ বাঙালি মাত্রেই জানেন। সেই ভাষণের প্রতিটি উক্তিই উদ্ধৃতিযোগ্য। কিন্তু, মূল বক্তব্যটি ছিল: “আর তোমরা গুলি করবার চেষ্টা কোরো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।” আর সব শেষে বললেন সেই কথাগুলি, যা শোনার জন্য উন্মুখ ছিল বাংলাদেশ: “এ বারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এ বারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
তিনি প্রথমে মুক্তির কথা বলেছেন। এই মুক্তি উপনিবেশের যাবতীয় শৃঙ্খল থেকে মুক্তি, ব্যাপক অর্থে। ‘স্বাধীনতা’ সীমিত। সে কারণেই আমাদের যুদ্ধ ছিল ‘মুক্তিযুদ্ধ’। স্বাধীনতার যুদ্ধও। সে জন্যই ১৯৭২ সালের সংবিধানে চারটি মূল উপাদানের তিনটি— গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতায় শেষ লাইন ছিল— ‘এ বারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তাঁর সারা জীবনের লক্ষ্য যা ছিল, তা শেষ বাক্যে সমাপ্ত করেন।
কঠিন সঙ্কটে এত ভারসাম্যপূর্ণ অথচ আবেগময় বক্তৃতা বিরল। একটি রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে থেকে স্বাধীনতার জন্য একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করা ও স্বাধীনতার আহ্বান জানানো, আবার সেই আহ্বান যেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আহ্বান না হয়, সে দিকেও খেয়াল রাখতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। এই ভাষণ ছিল বাঙালির মুক্তির সনদপত্র। বাঙালিরা পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করল, আর শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের গণমানুষের চেতনায় হয়ে উঠলেন জাতির পিতা। এই ভাষণে তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে একই সঙ্গে বিবৃত করেছেন। পাকিস্তানের উপনিবেশ হিসেবে থাকার যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতা বলেছেন, তার পর বর্তমান পরিস্থিতির কথা। ভবিষ্যতের শত্রুকে কী ভাবে পরাভূত করতে হবে, তার রূপরেখাও। স্বৈরশাসন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এ ভাষণ অনুপ্রেরণা জোগায়। আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কেন ও কী ভাবে অন্যায়ের প্রতিরোধ করতে হবে। সব শেষে বললেন, ‘জয় বাংলা’। এই দু’টি শব্দ নিছক স্লোগান নয়, এক প্রত্যয় হিসেবে দেখতে হবে।
বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করেছিল এই ভাষণ। বাঙালির মুক্তির জন্য তিনি একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক ও সশস্ত্র পন্থার কথা ভেবেছিলেন। পাকিস্তানের কাঠামোয় বাস করে গণতান্ত্রিক পন্থায় সমস্যার সমাধান চেয়েছেন। কিন্তু, একই সঙ্গে বোধ হয় এই বিশ্বাসও করতেন যে, পাকিস্তানি শাসক গণতান্ত্রিক পন্থায় সমঝোতায় আসবে না। অন্তিমে সশস্ত্র পন্থাই হবে উত্তম। ’৭১-এর ৭ মার্চ বাঙালিকে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন সশস্ত্র পন্থার জন্য তৈরি হতে।
বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের পর পুরো দেশ বদলে যায়। জোরদার হয়ে ওঠে অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশই হয়ে ওঠে সরকারি নির্দেশ। মানুষ, প্রশাসনও তা মানতে থাকে। ড. বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর লিখেছেন, “১৯৭১-এর মার্চ মাসের অসহযোগ প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরি হয়েছে। অসহযোগ আন্দোলনের লক্ষ্য পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামো প্রত্যাখ্যান। শেখ মুজিবুর রহমান একটি সামগ্রিক রাজনৈতিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে এই প্রতিরোধকে একটি রাষ্ট্র গঠনে বদলে দেন।”
ইউনেস্কো যে এই ভাষণ তাদের তালিকাভুক্ত করল, তার পরিপ্রেক্ষিত এই। পাকিস্তানের একটি প্রদেশ বিক্ষুব্ধ, বাঙালিরা যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের উপর সংখ্যালঘিষ্ঠরা সব চাপিয়ে দিয়েছিল। বাঙালিদের নেতা তাদের এ থেকে মুক্ত করতে চান, সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাধান চান, আবার সংখ্যাগরিষ্ঠকে ঐক্যবদ্ধ, শৃঙ্খলাপূর্ণ ও আন্দোলনরত অবস্থায় রাখতে চান। এ বক্তৃতা তারই প্রতিফলন। শৃঙ্খলিত মানুষের একটি দলিল, যা বন্দি মানুষকে মুক্তির স্বপ্ন দেখায়। এর সর্বজনীনতা সে কারণেই, এ জন্যই তা মানবমুক্তির দলিল।
বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ রাষ্ট্রের মধ্যেই সৃষ্টি করে এক সমান্তরাল রাষ্ট্রের। সে দিক থেকে বাংলাদেশের পত্তন ৭ মার্চে। সে দিন বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিয়েছিলেন, বাঙালি তা মেনেছিল, পরাধীন পাকিস্তানে আর তারা ফিরে আসেনি। এ ভাবেই বাংলাদেশ এগোতে থাকে ২৫ মার্চের দিকে। ৭ মার্চ অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে মিশে ছিল বিশ্বমানবের মুক্তির মন্ত্রও।
ট্রাস্টি সভাপতি, ১৯৭১ গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর, বাংলাদেশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy