দারিদ্র বাড়ছে, অসাম্য বাড়ছে। প্রতীকী ছবি।
এক দিকে ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি রিপোর্ট আর অক্সফ্যাম রিপোর্ট-এ বিশ্বজোড়া অসাম্য ও দারিদ্রের আশঙ্কাজনক ছবি। আর অন্য দিকে, ফোর্বস ও হিউরুন-এর বিশ্বের সবচেয়ে ধনীদের তালিকা প্রকাশ পাওয়ার পরে প্রতি বছরই ভারতে একটা পরিচিত কোলাহল শোনা যায়— এক দল বলেন যে, দারিদ্র বাড়ছে, অসাম্য বাড়ছে, অতিধনীরা অতিধনীতর হচ্ছেন; আর অন্য দল বলেন, ভারত জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নেওয়ার যাত্রায় এগিয়ে চলেছে, তবে তার ফল সমাজের সব স্তরে প্রতিফলিত হতে সময় লাগবে।
অসাম্য নিয়ে আলোচনার সমস্যা হল, অসাম্য এমন এক আপেক্ষিক মাপকাঠি, যার থেকে প্রত্যক্ষ ভাবে জীবনযাত্রার মান— সে গড়পড়তা আয়ই হোক, বা দারিদ্র— অনুমান করা মুশকিল। অসাম্য বাড়লে তার সঙ্গে গড় আয় বাড়তেও পারে, কমতেও পারে। অসাম্য কমলেও তাই। তেমনই, অসাম্য বাড়লে তার সঙ্গে দারিদ্র (দারিদ্ররেখার নীচে থাকা জনসংখ্যার অনুপাত, অথবা দরিদ্র মানুষের গড় আয়ের মতো যে কোনও সূচক) বাড়তেও পারে, কমতেও পারে— অসাম্য কমলেও তাই। তাই শুধু অসাম্য বেড়েছে বা কমেছে দেখে তার থেকে ভাল-মন্দ কোনও সিদ্ধান্তে আসা সোজা নয়— ঠিক যেমন অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার বেড়েছে বা কমেছে, তার থেকেও দারিদ্র বা অসাম্যের পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনও নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা যায় না।
রাস্তায় তো হরেক রকম গাড়ি চলে— কম দামি পুরনো ভাঙাচোরা গাড়ির পাশেই অত্যাধুনিক দ্রুতগতির গাড়ি। গাড়িগুলোর অগ্রগতির সঙ্গে আমরা যদি জীবনযাত্রার মানের উন্নতির তুলনা করি, তা হলে সমস্ত গাড়ির গড় গতি হল মাথাপিছু আয়ের গড় বৃদ্ধির হারের মতো। কম দামি গাড়িগুলো কতটা এগোবে— অর্থাৎ, দারিদ্র কী হারে কমবে— তা রাস্তার অবস্থা এবং সমস্ত গাড়ির গড় গতির উপরে যেমন নির্ভর করবে, তেমনই নির্ভর করবে তাদের নিজস্ব ইঞ্জিনের জোর এবং জ্বালানির লভ্যতার উপরে। কম দামি আর বেশি দামি গাড়ির গতির ফারাকের উপরে তাদের আপেক্ষিক দূরত্ব ও তার পরিবর্তনের হার নির্ভর করবে— অর্থাৎ, অসাম্য কী হারে বাড়বে বা কমবে। রাস্তা ভাল হলে সব রকম গাড়িই আগের চেয়ে জোরে যাবে, কিন্তু অসাম্যও বাড়বে— কারণ, দামি গাড়িগুলো আরও বেশি জোরে যাবে। রাস্তা খারাপ হলে সব গাড়িই তুলনায় ধীরে যাবে, অর্থাৎ, গড় আয়ের বৃদ্ধির হার কম হবে। কম দামি গাড়ির গতি কমবে, অর্থাৎ দারিদ্র হ্রাসের হার কমবে। বেশি দামি গাড়িগুলোও আগের তুলনায় ধীরে যাবে, এবং তাদের আর কম দামি গাড়িগুলোর মধ্যে দূরত্ব— এই উদাহরণে যা অসাম্যের সূচক— কমতে পারে, বাড়তেও পারে; কিন্তু বাড়লেও আগের তুলনায় কম হারে বাড়বে।
নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় আর্থিক উদারীকরণের পরের দুই দশকের গল্পটা খানিক প্রথম পরিস্থিতির মতো— আগের দশকগুলোর তুলনায় অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার বেশি ছিল, দারিদ্র কমেছে, কিন্তু আয় ও সম্পদের অসাম্য বেড়েছে। উদারীকরণের আগের দুই দশকে মাথাপিছু আয়ের গড় বৃদ্ধির হার ছিল ১.৮%, যা তার পরের দুই দশকে বেড়ে ৪.৫% হয়। দারিদ্ররেখার নীচে থাকা জনসংখ্যার অনুপাত নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় ছিল ৪৫%-এর উপরে, তা ২০১১ সালে, যে বছরে সর্বশেষ সরকারি পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, কমে হয় ২২%। কিন্তু এই পর্যায়ে অসাম্যও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য ভাবে। অসাম্যের একটা সোজা এবং জনপ্রিয় মাপকাঠি হল, দেশের মোট আয় বা সম্পদে দরিদ্র ও ধনী শ্রেণির ভাগ কতটা। গত শতকের সত্তরের দশকের গোড়ায় জাতীয় আয়ে জনসংখ্যার তলার অর্ধাংশের ভাগ ছিল ২০%, তা ২০১১ সালে কমে হয় ১৩%; আয়ের নিক্তিতে সর্বোচ্চ দশ শতাংশের ভাগ বেড়ে ৩৫% থেকে হয় ৫৫%। সম্পদের ক্ষেত্রেও অসাম্যের এই ঊর্ধ্বগতি স্পষ্ট— দরিদ্রতর অর্ধাংশের ভাগ ১২% থেকে কমে হয় ৬%, আর সর্বোচ্চ দশ শতাংশের ভাগ বেড়ে ৪২% থেকে হয় ৬৩%। জনসংখ্যার ধনীতম এক শতাংশের ক্ষেত্রে অসাম্যের এই পরিবর্তন আরও প্রকট— এই পর্যায়ে মোট আয়ে তাদের ভাগ ১১% থেকে বেড়ে হয় ২১% আর মোট সম্পদের ক্ষেত্রে তা ১১% থেকে প্রায় তিনগুণ বেড়ে হয় ৩২%।
তার পরের দশকের ছবিটা এত স্পষ্ট নয়— জাতীয় আয়ের মান, তার বৃদ্ধির হার, দারিদ্র, এবং অসাম্য, প্রয়োজনীয় তথ্য-পরিসংখ্যান নিয়ে নানা বিতর্কের কারণে। সরকারি নানা পরিসংখ্যান সময়মতো প্রকাশিত হয়নি। পরোক্ষ নানা পদ্ধতি ব্যবহার করে যে ছবিটা উঠে আসছে, তা থেকে বলা মুশকিল যে, মাথাপিছু পারিবারিক ব্যয়ের ভিত্তিতে যে ভাবে দারিদ্র মাপা হয়, সেই অনুযায়ী দারিদ্র বেড়েছে, কমেছে না একই আছে।
জাতীয় আয় যদি দেখি, তা হলে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত (যাতে কোভিডের প্রভাব সরিয়ে রাখা যায়) মাথাপিছু আয়ের গড় বৃদ্ধির হার হল ৫.১%, যা আগের দশকগুলোর থেকে খানিকটা বেশি। সমস্যা হল, ২০১৪ সাল থেকে জাতীয় আয় মাপার পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন করা হয়, যার ফলে ২০১১ সালের পরের বৃদ্ধির হার খানিকটা অতিরঞ্জিত। ভারতের প্রাক্তন মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যন ২০১৯ সালের একটি প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে, এর ফলে বার্ষিক বৃদ্ধির হার ২.৫% মতো বেশি আসছে। বর্তমান মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ভি অনন্ত নাগেশ্বরনও ২০১৯ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে লেখেন যে, তাঁর হিসাব অনুযায়ী এই পর্যায়ে বার্ষিক বৃদ্ধির হার ১% মতো বেশি আসছে।
নানা দেশে জাতীয় আয় সংক্রান্ত সরকারি পরিসংখ্যান নিয়ে বিতর্কের সমাধান হিসাবে সম্প্রতি গবেষকরা জাতীয় আয় নির্ণয় করার একটা বিকল্প পদ্ধতি বার করেছেন কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা রাতের আলোর ছবি ব্যবহার করে। যুক্তিটা এই রকম— অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যত বাড়বে, এবং যত নগরায়ণ হবে, রাতে আলোর ব্যবহার ততই বাড়বে এবং তার বৃদ্ধির হার থেকে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হারের একটা বিকল্প পরিমাপ পাওয়া যাবে। ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো-র গবেষক লুইস মার্টিনেজ় দেখাচ্ছেন, তুলনামূলক ভাবে অগণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এই মাপের সঙ্গে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হারের ফারাক বেশি। ভারতের ক্ষেত্রে এই ফারাকের মাত্রা তুলনায় কম হলেও একেবারে নগণ্য নয়। অর্থাৎ, ভারতের ক্ষেত্রে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হারকে আক্ষরিক ভাবে মেনে নেওয়ার সমস্যা আছে। আর কোভিডের আগের কয়েক বছর ধরেই জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার বাদ দিয়ে অন্যান্য অর্থনৈতিক সূচক (যেমন, বেসরকারি বিনিয়োগ, বেকারি, গ্রামীণ মজুরি ইত্যাদির হার) থেকেও অর্থনীতিতে শ্লথগতির চিহ্ন স্পষ্ট।
অসাম্য নিয়ে গত এক দশকে যে পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে, তাতে ছবিটা অস্বচ্ছ। ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি রিপোর্ট অনুযায়ী, আয় ও সম্পদের অসাম্যের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা এর আগের দুই দশকের মতো একই হারে অব্যাহত আছে। এই সিদ্ধান্তটি অবশ্য তর্কাতীত নয়। যে ভাবে এই পরিসংখ্যান সংগৃহীত হয়, তাতে অতিধনী শ্রেণির সম্পদের গতিবিধি ঠিকমতো ধরা পড়ে না। আর অতিধনীদের বাদ দিলে বাকিদের ক্ষেত্রে সার্বিক অর্থনীতির গতি শ্লথ হলে, অসাম্য খুব বেশি হারে বাড়ার কথা নয়— রাস্তা খারাপ হলে যেমন দামি ও কম দামি গাড়ি দুয়েরই গতি কমবে, আর তাদের আপেক্ষিক দূরত্ব আগের হারে বাড়বে না। বিকল্প নানা পরিসংখ্যান ব্যবহার করে ঈশান আনন্দ ও ঋষভ কুমার সম্প্রতি দেখিয়েছেন যে, মোট সম্পদে অতিধনীদের ভাগ গত এক দশকে আগের থেকে অনেক বেশি হারে বেড়েছে। গাড়ি ও রাস্তার উদাহরণটি টানলে বলতে হয়, অতিধনীরা যে গাড়ি ব্যবহার করেন, সেগুলির যাত্রাপথ রাস্তার অবস্থার উপরে খুব একটা নির্ভর করে না। সার্বিক অর্থনৈতিক শ্লথগতির পাশাপাশি শেয়ার বাজারের রমরমাও একই কথা বলে।
অর্থনীতি বিভাগ, লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy