বার্বিল্যান্ডে পুরুষতন্ত্র নেই। ছবি: সংগৃহীত।
আধুনিক ইংরেজির ‘উওক’ শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ কী হতে পারে ভাবতে ভাবতে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শরণ নেওয়া। দেখি দিব্যি লাগসই একখানা শব্দ রয়েছে শব্দকোষে, ‘সজাগর’। বর্ণবাদ, নারীবিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষ বা সমকামী-বিদ্বেষের মতো সমাজের গভীরে গেড়ে বসে থাকা অন্যায়ের প্রশ্নে যাঁরা সাতিশয় সজাগ, তাঁরাই হলেন উওক। সাধের হোয়্যাটসঅ্যাপ গ্রুপে তেমন কেউ থাকলে সেখানে ওয়াইফ-জোক ফরোয়ার্ড করে আপাদমস্তক উত্তমমধ্যম জুটতে পারে সমাজ-অসচেতন কারও। লকডাউনের সময় আমাদের মেয়ে-ইস্কুলের প্রাক্তনীদের গ্রুপের এক গৃহকর্মনিপুণা কর্মরতা সদস্য ‘বেচারি’ পুরুষদের গৃহকাজে বাধ্যতামূলক যোগদান নিয়ে একখানা মিম ফরোয়ার্ড করেছিল, তলায় লিখেছিল ‘কহানি ঘর ঘর কি’। অর্থাৎ প্রতি বাড়িতেই এক চিত্র। আহ্লাদ করে এ-ও জুড়ে দিয়েছিল, তার স্বামী ঘরের কাজ কিছুই পারে না। এমনকি দু’বেলা এক রান্না খাবে না, এমনই তার বায়নাক্কা। সমমনস্ক দু’-এক জন তাকে সহজ রান্নার ফর্মুলা বাতলে পরামর্শ দিয়েছিল, চেঞ্জ দ্য রেসিপি। পুরো বিষয়টায় নিতান্ত খেপচুরিয়াস হয়ে একখানা লাগসই জবাব দিতে হাত নিশপিশ করছিল। মনে মনে মকশো করছিলাম, থিয়োরি-টিয়োরি ঢুকিয়ে অনাবশ্যক জটিল করে তুলছিলাম, এমন সময় এক অতীব-স্মার্ট এবং উওক, থুড়ি সজাগর বন্ধু লিখল, “ইউ নো হোয়াট! চেঞ্জ দ্য হাজ়ব্যান্ড ইনস্টেড।”
আমরা যারা সজাগর, তাদের ভারী মুশকিল। আত্মীয়স্বজনদের জমায়েতে, বন্ধুদের গ্রুপে, হাউজ়িং সোসাইটির মিটিংয়ে, ছেলেমেয়েদের ইস্কুলের গেটের বাইরে, সহকর্মীর মেয়ের জন্মদিনের পার্টিতে বা স্কুল-কলেজের স্টাফরুমে, সর্বদাই আমাদের জিভের ডগায় ঝুলে থাকে উচিত জবাব, আঙুলের ডগায় জ্ঞানের বাণী। নীতিবাগীশ ইমেজের কারণে এ সব জমায়েতে আমাদের এড়িয়েও চলে অনেকে। কখনও কখনও অবশ্য ভদ্রতার খাতিরে, ক্লান্ত হয়ে বা স্রেফ জুতসই বাক্য গঠন করতে না পেরে রণে ভঙ্গ দিই, চুপ করে থাকি। আর মনে মনে বিদ্ধ হই। বাসে ট্রামে চলাফেরার পথে, ঘুম আসার আগে, কাজের ফাঁকে নিজস্ব অবসরে মনে মনে রিহার্সাল করি: বলব, পরের দিন ঠিক বলব। সেক্সিজ়ম, জাতিবিদ্বেষ আর সাম্প্রদায়িক ঘৃণার এই বাড়বাড়ন্তের যুগেও আমাদের ‘মনে আছে বিশ্বাস’, বিশ্বকে নবজাতকের বাসযোগ্য করে যাব। আমাদের মধ্যে যারা মা-বাবা, তারা বেছে নিই উওকনেস অনুশীলনের সহজতম পরিসর— শুরু করি সজাগর পেরেন্টিং।
আমাদের বাচ্চাদের বইতে রেড রাইডিং হুডের দিদিমাকে খেয়ে ফেলে না নেকড়ে বাঘ, পুরুষ-আরশোলাদের কামোদ্দীপনা সঞ্চার করা ন্যাকা মেয়ে-আরশোলা দেখানো শৃঙ্গাররসসিক্ত কার্টুন আমাদের বাড়িতে নিষিদ্ধ। “সতীনের ছেলের কচি কচি হাড়-মাংসে ঝোল-অম্বল রাঁধিয়া খাইবে”— ঠাকুরমার ঝুলি-র এমন লাইন পড়ে আমরা শিউরে উঠি। এমনকি সহজ পাঠ-এর আপাত-নিরীহ পঙ্ক্তি “বধূরা কাপড় কেচে যায় গৃহকাজে,” বা শৈলের পৈতের ধুমধামের বিবরণ পড়ানোর সময় সে সবের ইতিহাস-ভূগোল ব্যাখ্যা করতে বসি। আমরা বরং স্বস্তিবোধ করি পেপা পিগের গল্প পড়িয়ে আর দেখিয়ে। দুই সন্তান পেপা আর জর্জ পিগকে নিয়ে সুখের সংসার মামি পিগ আর ড্যাডি পিগের। পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানের অন্দরে বণ্টনের অসাম্যের কথা বলা অর্থনীতির ইন্ট্রা-হাউসহোল্ড বারগেনিং মডেল সেই শূকরশান্তিনীড়ে অপ্রযোজ্য। ড্যাডি পিগ সেখানে খুশি মনে প্যানকেক রান্না করে, মামি পিগ কম্পিউটারে কাজ করে। ড্যাডি আর মামি পিগ দু’জনেই গাড়ি চালিয়ে বাচ্চাদের বেড়াতে নিয়ে যায়। ইস্কুলে ম্যাডাম গিজ়েল দেশে দেশে সম্প্রীতির গান শেখান। আমরা বেছে বার করি জুলিয়া ডোনাল্ডসনের ছড়া, যেখানে এক দয়ালু ডাইনি জন্তুজানোয়ারদের তার ঝাঁটায় চড়িয়ে বেড়াতে নিয়ে যায়। আশা রাখি আর একটু বড় হলেই তারা পড়বে আতুরী ডাইনির গল্প। অপু আর নীলুকে আমচুর দিতে চাওয়ায় তারা আর্তরব করে প্রাণভয়ে ছুটে পালানোয় নিঃসঙ্গ বৃদ্ধা যখন ভাববেন, “মুই মাত্তিও যাইনি, ধত্তিও যাইনি— কাঁচা ছেলে, কী জানি মোরে দেখে কেন ভয় পালে সন্দেবেলা?” তখন তাদেরও গলার কাছে জমাট বাঁধবে কান্না, দরকার হলে দু’-এক ফোঁটা জলও গড়িয়ে পড়বে চোখ থেকে— ছেলেদেরও।
বিশ্ব জুড়ে আমাদেরই একাংশের অতিসক্রিয়তায় এনিড ব্লাইটন, রোয়াল্ড ডাল-এর লেখার অংশ ফেলে দিয়ে নতুন করে লেখা হচ্ছে সংবেদনশীল শিশুপাঠ্য। ব্যাপারটা যে অনেক সময়েই জগাখিচুড়িতে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, জনান্তিকে আমরা তা অস্বীকারও করি না। মিসেস টুইট ছিলেন ‘আগলি অ্যান্ড বিস্টলি’, পরিমার্জিত সংস্করণে তিনি শুধুই ‘বিস্টলি’। সলমন রুশদি-সহ বহু মানুষ অবশ্য বলেন উওকনেস-এর নামে ক্ল্যাসিকের উপরে কলম চালানো আসলে সেন্সরশিপেরই নামান্তর।
এ ছাড়াও যে প্রশ্নটা মাঝে মাঝেই মাথাচাড়া দেয়: পৃথিবীর সমস্ত খারাপ জিনিস শিশুদের কাছে আড়াল করে রেখে সত্যিই কোনও লাভ হয় কি না। হিংসা, রক্তপাত, মিথ্যাচার, অসাম্য, বঞ্চনা— সাহিত্য বা সিনেমাকে নাহয় এ সব থেকে স্যানিটাইজ় করা গেল। কিন্তু আসল দুনিয়ায় তো এ সব জিনিসেরই ছড়াছড়ি! রাস্তাঘাট, ইস্কুল-বাজার, দোকানপাট, এ সব জায়গায় বড়দের সঙ্গে, এমনকি নানা পরিবেশের বাচ্চাদের সঙ্গে মেলামেশা করতে করতেই নানা অন্যায়ের সঙ্গে পরিচয় ঘটবে একটি বাচ্চার। অথচ রাজা শুদ্ধোদন যেমন জরা, ব্যাধি ও মৃত্যু আড়াল করে রেখেছিলেন সিদ্ধার্থের কাছে, তেমনি করেই যেন মানুষে মানুষে সাম্য-মৈত্রীর এক কল্পজগৎ তৈরি করে সেখানেই বাচ্চাদের বড় করতে চান সজাগর অভিভাবকেরা।
গ্রেটা গারউইগ-এর সাড়া-জাগানো ছবি বার্বি দেখতে গিয়ে মনে হচ্ছিল এমন অনেক কথা। বার্বিল্যান্ডে পুরুষতন্ত্র নেই, নানা আকার ও বর্ণের বার্বিরা সেখানে যা-খুশি হতে পারে— ডাক্তার, উকিল, বিজ্ঞানী, রাষ্ট্রপ্রধান। প্রতিটি দিনই তাদের আনন্দের দিন। তাদের নিজস্ব ড্রিমহাউস আছে, ইচ্ছে হলেই তারা বদলে ফেলতে পারে পোশাক। বার্বিরা জানে তারা কেন এই রকম— যাতে তাদের মালিকেরা, আসল দুনিয়ার ছোট ছোট মেয়েরাও হয়ে ওঠে খুশি আর ক্ষমতাশালী, বেছে নিতে পারে পছন্দের পেশা। বার্বিল্যান্ডের পুরুষদের (যাদের অধিকাংশের নামই ‘কেন’) কোনও ক্ষমতা নেই, বার্বির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলেই তারা ধন্য। এমত অবস্থায় কহানি মে টুইস্ট, ‘স্টিরিয়োটিপিক্যাল’ বা গতে-বাঁধা-বার্বির (যে ডাক্তার, উকিল, রাষ্ট্রপ্রধান বা বিজ্ঞানী বার্বি নয়) হঠাৎ মৃত্যুচিন্তা হয়। শরীরেও দেখা দেয় নানা গোলযোগ— ফ্ল্যাট ফিট, সেলুলাইট। রোগ উপশমের জন্য ‘উদ্ভট বার্বি’র কাছে যেতে হয় তাকে। উদ্ভট বার্বি গতে-বাঁধা-বার্বির রোগনির্ণয় করে দাওয়াই বাতলায়: আসল পৃথিবীতে গিয়ে খুঁজে বার করতে হবে গতে-বাঁধা-বার্বির মালিককে। কোনও কারণে সেই মেয়েটির ভয়ানক মন খারাপ বলেই যে গতে-বাঁধা-বার্বির কলকব্জা বিগড়োতে শুরু করেছে! অতঃপর গতে-বাঁধা-বার্বি পাড়ি দেয় মানুষের দেশে, তার সঙ্গ নেয় কেন। সেখানে গিয়ে দু’জনেই অবাক। পুরুষের চাহনি বিচলিত করে বার্বিকে, নিজেকে মনে হয় একটা লোভের বস্তু। সে হতাশ হয়, ক্রমে বুঝতে পারে, মনুষ্যজাতির দুনিয়াদারির চালিকাশক্তি হল পুরুষতন্ত্র। কেন কিন্তু ভারী উত্তেজিত, সে বোঝে আসল দুনিয়াটা চালায় পুরুষই। ফিরে গিয়ে এই নিয়মটাই সে চালু করতে চায় বার্বিল্যান্ডে। পরিচালকের হাতের নানা মোচড়ে গল্প চলে এক অদ্ভুত উত্তরণের রাস্তায়। শিহরিত হতে হতে দেখি, শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সে যাত্রায় স্টিয়ারিং থাকে বার্বিরই হাতে।
এর আগে পর্দায় নতুন করে লিটল উইমেন-এর গল্প বলেছিলেন গ্রেটা। তাতেও যেমন, বার্বি-তেও তেমনই অনেক কথা না বলে ছেড়ে দেন তিনি, ভাবা প্র্যাক্টিস করতে বাধ্য করেন দর্শককে। বার্বিল্যান্ডের মেকি ভালমানুষির কল্পজগৎ দেখতে দেখতে চোখের সামনে থেকে একটা পর্দা যেন সরে যায়। ‘উওক পেরেন্টিং’ আশীর্বাদ না অভিশাপ, মনে মনে লিখতে থাকি মাধ্যমিকের রচনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy