রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। ছবি: সংগৃহীত।
আমাদের যথাসম্ভব অধঃপতন হওয়ার পর দাসত্বের বিরুদ্ধে কখনো মাথা তুলিতে পারি নাই; তাহার প্রধান কারণ এই যে, যখনই কোন ভগ্নি মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন অমনই ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন-রূপ অস্ত্রাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। ...এই ধর্মশাস্ত্রগুলি পুরুষ রচিত বিধি ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।” (আমাদের অবনতি: রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, ছবি)। বোনেদের প্রতি তাঁর আহ্বান ছিল, জেগে উঠুন, নিজের হাতে খুলুন উন্নতির দ্বার। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের (১৮৮০-১৯৩২) প্রয়াণ দিবস ৯ ডিসেম্বর, অনেকের মতে জন্মদিবসও একই।
বাল্য থেকে কঠোর অবরোধ প্রথায় মানুষ হয়েছিলেন রোকেয়া। অভিভাবকের আপত্তি ছিল বাংলা, ইংরেজি পড়ানোয়। সমাজ যে দরজা মেয়েদের জন্য বন্ধ রেখেছিল, তাকে খুলে মেয়েদের অধিকার-সচেতন করার চর্চায় আমৃত্যু নিযুক্ত ছিলেন রোকেয়া। বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, মুসলমান মহিলা সমিতি (আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম) গঠন বা সাহিত্যচর্চা, সবই করেছিলেন সমাজ-সংস্কারের প্রয়োজনে।
সমাজে নারীর স্বাধীন পদচারণার জন্য দরকার শিক্ষা ও আর্থিক স্বনির্ভরতা। তাই সুলতানার স্বপ্ন (১৯০৮)-এ নারীশিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটিয়ে, অবরোধহীন স্বাধীন নারীর কল্প-কাহিনি শুনিয়েছেন রোকেয়া। তাঁর কর্মপদ্ধতি ও সমাজ গঠনের ভাবনা ধরা পড়ে পদ্মরাগ (১৯২৪) উপন্যাসের তারিণী-ভবনের চিত্ররূপে। পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোয় শোষিত, নির্যাতিত নারীদের ঠিকানা তারিণী-ভবন। সেখানে তারা শেখে কর্মশক্তি ও আত্মমর্যাদায় বাঁচতে। দাম্পত্যে অপমানিত সিদ্দিকা সেই সম্পর্কে আর ফিরতে না চেয়ে বলেছে, “একমাত্র বিবাহিত জীবনই নারী জন্মের চরম লক্ষ্য নহে; সংসার ধর্ম্মই জীবনের সার ধর্ম্ম নহে।” মুসলিম মেয়েদের জাগ্রত করতে প্রাণপণ চেষ্টা করাই হবে তার জীবনের লক্ষ্য, জানাচ্ছে সে। প্রায় একশো বছর আগে সিদ্দিকার মুখে রোকেয়ার শোনানো এই সিদ্ধান্ত মুসলিম মেয়ের সক্ষমতা ঘোষণার এক বিরল নজির। মেয়েদের সংসার-স্বর্গের স্বপ্নকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছিলেন রোকেয়া, যিনি বাংলার নবজাগরণের যুক্তিবাদী লেখকদের মধ্যেও অগ্রগণ্য।
নকশাধর্মী, বিদ্রুপাত্মক রচনা ‘অবরোধ-বাসিনী’ (১৯৩১) চাক্ষুষ ঘটনা অবলম্বনে লেখা। অবরুদ্ধ নারীদের সামাজিক অবস্থানের করুণ চিত্র এখানে ফুটে উঠেছে। পর্দা ও বোরখার সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে কেউ চোরের হাতে পর্দার আড়াল থেকে নীরবে সব গয়না দিয়েছে, কারও রেল লাইনে প্রাণ গেছে, কেউ বা বাড়িতে আগুন লাগলেও পুরুষের সামনে বেরোনো যাবে না বলে আগুনেই পুড়ে মরেছে। অবরোধে আটকে পড়া এই নারীদের প্রতি পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে বেরিয়ে আসার বার্তা ছিল তাঁর লেখায়। এই সামাজিক আন্দোলনের প্রথম ধাপ হল নারীশিক্ষা। কিন্তু বিদ্যালয় পরিচালনা করতে গিয়েও রক্ষণশীল মুসলিমদের কাছ থেকে হুমকি চিঠি পান রোকেয়া। স্কুল বাসের জানলা দিয়ে বোরখা-পরা ছাত্রীদের হাত দেখা যাচ্ছে, এই ছিল অভিযোগ। অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ছাড়া নারীর মুক্তি সম্ভব নয়, এই উপলব্ধি প্রকাশ পেয়েছিল আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম-এর কর্মপদ্ধতিতে।
রোকেয়ার সময় থেকে একশো বছর এগিয়ে আজ হিজাব ও বোরখার বিরুদ্ধে নতুন করে বিশ্বে আন্দোলন শুরু হয়েছে। কর্নাটকের কোথাও কোথাও হিজাব-পরা ছাত্রীদের শিক্ষার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। বাধাটা শুধু কলেজ কর্তৃপক্ষের নয়। রাষ্ট্রশক্তির জোরে হিন্দুত্ববাদী দলের সমর্থকদের মুসলিম বিদ্বেষ থেকে বাধা প্রয়োগও এর কারণ। কিন্তু সব ছাত্রীও তো কলেজের নির্দেশ মানেননি। এমনকি অনেকে পরীক্ষাও দেননি হিজাব ছাড়া ঢুকতে দেবে না বলে। এটা কি শুধু মেয়েদের গড়ে-ওঠা পছন্দ? সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁদের অনেকটা ‘চয়েস’ তৈরি করেছে। একটা পোশাকের উপর বাড়তি পোশাক না চাপালে অনেকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। কলেজ হিজাব পরতে বাধা দেওয়ায়, দেশের নানা প্রান্তের মুসলিম মেয়েরা শুধু গেরুয়া বাহিনীর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবেন বলেই হিজাব পরলেন। হিন্দু মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে মুসলিম পিতৃতন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন তাঁরা। তা হলে কি রোকেয়ার সামাজিক আন্দোলনের ধারা মিলিয়ে গেল?
এর বিপরীত চিত্র ইরান, আফগানিস্তানে। স্কুল কলেজে পড়ার অধিকার কেড়ে নিয়ে পোশাকের আড়ালে থাকার ফতোয়া চাপিয়েছে রাষ্ট্র। মৌলবাদী সমাজের চোখে নারীর যেন আত্মা ও সত্তা কিছু নেই। আছে শুধু হাড়, মাংস, রক্ত। তাই তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। তবে মৌলবাদের সেই চেষ্টা তো সফল হচ্ছে না। মাহসা আমিনির মৃত্যু বিপ্লবের সূচনা করেছে। ইরানের বহু মহিলা আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছেন হিজাব। মাথার চুল কেটে উড়িয়েছেন। ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ স্লোগান গিয়ে পৌঁছেছে আফগানিস্তানে। আফগানি মহিলারাও ইরান দূতাবাসের সামনে ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ স্লোগান দিয়ে প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন।
ধর্মীয় রাজনীতির অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে যুক্তিবাদী নারী-পুরুষের সংগ্রাম দেখে মনে হয়, রোকেয়া চর্চার আরও বেশি প্রয়োজন। কারণ তিনি পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে, পুরুষের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বলেছেন, “তোমরা নারী জাতিকে যথেষ্ট সম্মান করিয়া থাক— যথা সীতা প্রমুখ দেবীদের পূজা কর, পয়গম্বর তনয়া হযরত ফাতেমাকে অসামান্যা নারী জ্ঞানে ভক্তি কর, এবং পয়গম্বর ঈসার মাতা মরিয়মকেও আদর কর, কিন্তু তাহাতে আমরা তৃপ্ত হইতে পারি না, কারণ তোমরা যে, ‘পুরুষ’ এ কথাটি তোমরা ভুলিয়া যাও না। ঐ ‘পুরুষ’ শব্দেই অহংকার ঝরে।”
বাংলা বিভাগ, সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ফর উইমেন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy