বিপ্লবী: রামায়ণের পাল্টা বয়ান তৈরি করেছিলেন মাইকেল। শিল্পী: অতুল বসু।
রামচন্দ্রকে আমার মা ভগবান বলে ডাকতেন। কোটি কোটি মায়ের সঙ্গে আরও কোটি কোটি বাবা-কাকা রামকে ভগবান বলে ডাকেন। তাঁর নামে মন্দির হল, এমন ভাবে মন্দির হতে কখনও কেউ দেখেননি। সারা উপমহাদেশের চোখ সেই মন্দিরের দিকে। এবং সামনেই ভোট।
যশোর জেলার কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামটিকে আমি দু’শো বার প্রণাম জানাই মাইকেল মধুসূদন দত্তের দু’শো বছরে। মাইকেল বিপ্লবী। ‘রেবেল’। বিপ্লবী দু’রকম, এক জন ভাঙে, খুন করে। এক জন জীবন দেয়, বাঁচায়। মাইকেল কি খুন করেননি? করেছেন। মঙ্গলকাব্যকে খুন করেছেন। কাব্য দিয়ে কাব্যকে শেষ করেছেন। আধুনিকতার আদি কবি হিসাবে তিনি প্রতিকবিতার জনক। এবং জননীও। শুনেছি আলেকজ়ান্ডার পঞ্জাব তছনছ করে দিয়েছিলেন আর সেই ধ্বংসই ছিল চন্দ্রগুপ্তের সাফল্যের সিঁড়ি। সে রকমই তখনকার কবিতা ছিল গান, ছিল পাঁচালি, ছিল খেউড়, ছিল এমন এক গ্রামীণ মহার্ঘভাতা যা অগ্রাহ্য করে বাংলায় প্রবেশ করলেন ভার্জিল, খিদিরপুরে ঢুকে পড়লেন দান্তে, কলেজ স্ট্রিট জয় করলেন মিল্টন। ৬ নম্বর লোয়ার চিৎপুর রোডে চালু হল অমিত্রাক্ষরের রানওয়ে, টেক অফ, এবং উড়ান। লেখা হল মেঘনাদবধ কাব্য।
মণিরত্নম রাবণ বানিয়েছিলেন। ব্লকবাস্টার বানান যিনি, তাঁর একটি ফ্লপ ছবি। কিন্তু ফ্লপ ছবিতেও থাকতে পারে গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কেত। মণিরত্নম, ভৌগোলিক ভাবে, রাবণের পাশের বাড়ির ছেলে। তিনি বললেন এটা হল ‘এথনিক ক্লেনজ়িং’। বানরসেনা দিয়ে রাম যে জেনোসাইড ঘটিয়েছিলেন লঙ্কায়, সেটা কালো দ্রাবিড় ‘আদিবাসী’দের মুছে ফেলার ইতিহাস। তাঁদের জল জঙ্গল কেড়ে নেওয়ার ইতিহাস। তাঁদের অরণ্যের অধিকার মুছে দেওয়ার ইতিহাস। কর্পোরেট ভারত একটি বারুদ-বস্তা আর রাষ্ট্র একটি দেশলাই— এই দুই থেকে উৎসারিত দম্ভ, সেই দম্ভের আসল নাম হিন্দু জাতীয়তাবাদ। রামমন্দির সেই হিন্দুত্বের ‘পেন্টাগন’। আমরা যখন কলেজে পড়তাম, দেশে এত হিন্দু ছিল না। বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই ছিল, কিন্তু হিন্দুত্ব দেখানোর এত উল্লাস-সরণি ছিল না। মাইকেল তাঁর বন্ধুকে লিখেছিলেন— “আই হেট রাম অ্যান্ড হিজ় রাবল্।” কেন লিখলেন?
শুরু বোন শূর্পণখার নাক কাটা দিয়ে। রামকে দেখে তার চিত্ত উদ্বেলিত হল। হতেই পারে। শূর্পণখা অসুন্দরী। তাই বলে কি সে রামকে দেখে বলতে পারে না, আমি তোমাকে দেখে অভিভূত! শাহরুখ খানকে দেখে কি সাঁইথিয়ার মেয়ে পাগল হয়ে যায় না, তাই বলে কি শাহরুখ লক্ষ্মণকে পাঠাবে মেয়েটির নাক কেটে নিতে? লক্ষ্মণ তখন দাদাকে দ্বিগুণ খুশি করার জন্য নাক কাটার পর কানও কেটে নিয়েছিল। এই নিষ্ঠুরতা দেখে রাম আস্তে করেও কোনও ধমক দেননি। এ বার শূর্পণখা তার দাদা রাবণের কাছে এল। বোন কাঁদতে কাঁদতে বলল, দাদা, সীতা অপরূপা, তুমি সীতাকে অপহরণ করো। দুটো মেয়েকে অপহরণ করে ইউরোপে আর ভারতে মহাযুদ্ধ হয়েছে, ধূলিসাৎ হয়েছে সভ্যতা, হোমার আর বাল্মীকি বলেছেন সে কথা। কে শোনে বাল্মীকি হোমারের কথা! আজও অপহরণ বন্ধ হল না।
মাইকেল ল্যাটিন, হিব্রু, ফারসি, সংস্কৃত জানতেন আর মিল্টনের মতো পবিত্র ইংরেজি বলতেন ও লিখতেন। তাতেও তিনি গোল্ডেন ট্রেজ়ারি-তে স্থান পাননি। বাঙালি যদি আর কোনও সাহেবকে প্রণাম না-ও করে ক্ষতি নেই, কিন্তু ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুনকে প্রণাম করতেই হবে, যিনি মাইকেলকে বাংলায় লিখতে বলেছিলেন। বাংলায় এর আগে কোনও বাঘের বাচ্চা কলম ধরেনি, সেটা বিদ্যাসাগরও জানতেন।
“একাকিনী শোকাকুলা, অশোককাননে/ কাঁদেন রাঘববাঞ্ছা আঁধারকুটিরে/ নীরবে।” শোকাকুলা সীতার কষ্টে রাম প্রকৃত স্বামীর মতো সেনাবাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন যুদ্ধে। হাজার হাজার রাক্ষস নিধন করলেন, লঙ্কা নগরী পুড়িয়ে দিলেন। রাক্ষস? কাদের রাক্ষস বলছি? নিজের ভাইকে, যে ভাই কালো? যে ভাই অনার্য? দলিত? রামের রণসফলতা আসলে আর্য দিয়ে অনার্যের জেনোসাইড। আজকের উন্নত ভারত, আজকের উন্নত আমেরিকার পিছনে সেখানকার আসল অধিবাসীদের রক্তের দাগ সভ্যতার পায়ের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। রক্তের দাগ মুছে দিলেও মোছে না। মাইকেল রামকে ‘হিরো’ না করে রাবণকে ‘হিরো’ বানিয়ে অ্যারিস্টটলের থুতনি নেড়ে দিয়ে যে ‘স্পর্ধা’কে ক্লাসিক্যাল করে তুলেছিলেন, তাকে দেখিয়ে আমরা বলব, ভিতরে বসে রয়েছে একটি আধুনিক রামমন্দির। হিন্দুত্বের গর্ভগৃহ। সেটা দেখিয়ে ভোট চাইব আমরা। আমরা কাদের টাকায় মন্দির বানালাম? ওই টাকায় কয়েকশো রুটির কারখানা বানাতে পারতাম। সেই সব কারখানায় হাজার হাজার রাম রুটি বানাত। লক্ষ্মণ আটা মেখে দিত। রহিম উনুন ধরাত। ধর্ম দিয়ে ভোট হয় যে গরিব দেশে, সেখানে রুটি দেখালে রুটির জামানত বাজেয়াপ্ত হতে পারে।
মসজিদ ভেঙে এসেছিলাম, মন্দির বানিয়ে আবার আসছি— এই ফর্মুলা কখনও হিন্দুধর্মের সম্মান বাড়াতে পারে না, যে সম্মান এক দিন শিকাগো থেকে নিয়ে এসেছিলেন বিবেকানন্দ। আপনারা স্বামীজিকে ‘অ্যাপ্রোপ্রিয়েট’ করবেন আর স্বামীজির কথাকে হাতে নিয়েও গরম আলুর মতো ফেলে দেবেন, সেটা কী করে হয়? ভগবান রামচন্দ্র কি বলেছেন, এখানেই মন্দির করে দাও আমাকে? মাইকেল দ্রষ্টা। সব কবিরা দেখতে পান না, মাইকেল পেতেন। পেতেন বলেই, রামায়ণের আর একটি গোরক্ষপুর এডিশন লেখেননি। তিনি রামভজন লিখতে আসেননি, তিনি ভারতবর্ষকে কলকাতার নবজাগরণ থেকে একটা পাল্টা ন্যারেটিভ ছুড়ে দিয়েছিলেন। সে জন্যই ভারতের দলিত মাইকেলকে আভূমি প্রণাম জানাচ্ছে আজ। দলিত আর এলিট মিশে গেল মাইকেলের শোণিতে।
মাইকেল রামায়ণের বিনির্মাণ করে উপনিবেশ তত্ত্বকে চাবকে দিলেন। খেলা তোমার, বল তোমার, ব্যাট তোমার, কিন্তু সচিন তেন্ডুলকর আমার। নাটক হোক, কবিতা হোক, এপিক হোক, তিনি নিচ্ছেন ওদের থেকে, কিন্তু নবজাগরণ হচ্ছে আমার মেধায়, আমার মননে। মাইকেল রামকে কোনও মন্দির বানিয়ে দেননি। তাতে রামের এক চুলও ক্ষতি হয়নি। মেঘনাদবধ কাব্য ভারতীয় সাহিত্যে যত বড় মাইলস্টোনই হোক, সেই পাথরে একটা বানরের কপালও ফাটবে না। শিব আছে দুর্গা আছে ইন্দ্র আছে বরুণ আছে নিকুম্ভিলা আছে, এ সব হল ‘সুপারন্যাচারাল মেশিনারি’। সব মহাকাব্যেই থাকে। সেই মেশিনারি এখন ভোট মেশিনারি হয়ে উঠেছে, ‘ভগবান রাম’ সেই মেশিনারির মুখ ও মহোৎসব।
ইউরোপ তুলে এনে বাংলা কবিতায় লাগিয়েছিলেন মাইকেল, তাঁর নিজের ভিতরে ছিল ভারতমৃত্তিকা, সেখানেই এসে পড়েছিল এক উল্কাপিণ্ড, তার ভিতর থেকে লেখা হয়েছিল মেঘনাদবধ কাব্য, তার বাইরে বসে লেখা হয়েছিল চতুর্দশপদী। সেই যে আরম্ভ হল, আজও তার শেষ নেই। আজ ইউরোপ ছাড়া ভারতীয় সাহিত্য বাঁচতে পারবে না, আবার এ-ও সত্যি, ভারতভূমি ছাড়া ভারতসাহিত্য তৈরি হতে পারে না। মাইকেল এখন প্রাচ্যে একটা পা রেখে হাতে ইউরোপ নিয়ে ভারতীয় সাহিত্যের সিংহদরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। তলায় বড় বড় করে লেখা, ‘রেখো মা দাসেরে মনে’।
পুরুলিয়ার যে ছেলেটি সনেট লিখছে আজ, সে আসলে আপনাকেই লিখছে, কেরলে বসে যে তরুণ কবি রাবণের পুত্রশোক লিখছে, সে আপনাকেই লিখছে। বইমেলা ধরে হেঁটে চলেছেন আপনি, আপনার দু’শো বছরের দীর্ঘ ছায়া, আপনার কোনও রামমন্দির নেই, প্রতিটি বইমেলা আপনার মন্দির।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy