এক সপ্তাহ আগে পালিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাংলায় যা বঙ্গভাষার উদ্যাপন। এবং সে-দিনই শোনা গেল, কলকাতা পুরসভা অবিলম্বে সাইনবোর্ড ও বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংয়ে বাংলা লেখা ‘বাধ্যতামূলক’ করতে অভিযানে নামছে।
আমরা জানি, ১৯৪৮-এ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন থেকে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সেখানেই ‘ভাষা শহিদ’ হয়েছিলেন পাঁচ জন। মাতৃভাষার বৃহত্তর মর্যাদার দাবি ছিল বহু দিনের। অবশেষে ২০০২ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ এই দিনটিকে মান্যতা দেয়। সেই থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি সকল ভাষাভাষির জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নামে চিহ্নিত।
নানা ভাষার দেশ আমাদের ভারতবর্ষে এই দিনটি কতটা গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয়? ঐতিহাসিক তথা রাজনৈতিক কারণে মূলত বাংলায় এবং অসমে (কাছাড়ের আন্দোলন) মানা হয়। আজ তার কতটা নিয়মরক্ষা, কতটা আন্তরিক সে-সব আলোচনা বাদ রেখেও এটুকু বলা যায়, কিছু অন্তত করা হয়। অনেকটা পয়লা বৈশাখে ‘বাঙালি’ হয়ে ওঠার মতো মনে হলেও দিনটি ভাবনায় থাকে।
মাতৃভাষা তো সকল রাজ্যে আছে। তবে অন্যত্র ২১ ফেব্রুযারি কোনও বিশেষ ‘মাহাত্ম্য’ বহন করে বলে জানা নেই। চাইলে গুজরাত, ওড়িশা, অন্ধ্র, কেরল, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু ইত্যাদি সবাই ২১ ফেব্রুয়ারি নিজ নিজ মাতৃভাষার উদ্যাপন করতেই পারে। করা, না-করা, যার যার সিদ্ধান্ত বটে। ইদানীং অবশ্য কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষ উদ্যোগে ১৪ সেপ্টেম্বর দিনটি ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ হিসাবে সর্বত্র গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হচ্ছে। ১৯৪৯ সালের ওই তারিখে সংবিধান সভায় হিন্দি-কে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত হয়। সম্প্রতি রাজভবনগুলিও ওই দিনটি পালনে যথেষ্ট তৎপর।
তা হোক। মাতৃভাষা দিবস এবং রাষ্ট্রভাষা দিবসের মধ্যে কোনও বিতর্কের জায়গা থাকবেই বা কেন? কিন্তু প্রশ্নের পরিসর তৈরি হয় তখনই, যখন দেখা যায় এই বাংলায়, এই কলকাতায় বঙ্গভাষার প্রসারকল্পে সহসা ‘ফরমান’ জারি করতে হচ্ছে। এ সব কথা বলার জন্য কোথাও সঙ্কীর্ণ প্রাদেশিকতার অভিযোগ শুনতে হলেও নিরুপায়! কারণ বিষয়টির অন্তর্নিহিত অর্থ স্পষ্ট করার সময় এসেছে। অন্য কোনও রাজ্যে যদি এমন নির্দেশ জারির প্রয়োজন না হয়, তবে এখানেই বা হচ্ছে কেন?
দোকানের সাইনবোর্ডে অন্য ভাষা থাকলেও সঙ্গে বাংলায় লেখা বাধ্যতামূলক করতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-রা এক বার ধর্মতলা পাড়ায় পথে নেমেছিলেন। তখন বাম-আমল। জ্যোতি বসু প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি তুলে দেওয়ার হঠকারী পথ নিয়েছেন। নাগরিক মহলে একাংশের মনে হয়েছিল, এটাও মূলত ইংরেজির বিরুদ্ধে অভিযান। যদিও তার লক্ষ্য ছিল বাংলা ভাষাকে দাবিয়ে দিয়ে অন্য কোনও ভাষার আধিপত্যে ‘রাশ’ টানা। সেই আন্দোলন কিছুটা লাগামছাড়াও হয়েছিল। সে অন্য কথা।
তবে এখন কলকাতা পুরসভার একই রকম তৎপরতায় প্রমাণ হয়ে যায়, সে-দিন যা চাওয়া হয়েছিল, আজও তা কার্যত অধরা। পুর-কর্তৃপক্ষ বলছেন, নভেম্বরেই এই বিষয়ে দু’মাসের সময় বেঁধে নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছিল। এ বার হবে সরেজমিন অভিযান। কিন্তু প্রশ্ন থাকে, যদি করাই হল, তা হলে এত দেরিতে ঘুম ভাঙল কেন?
এই রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ বঙ্গভাষী নিশ্চিত ভাবে অনেক বেশি উদারমনস্ক, ভাষা-ধর্ম নির্বিশেষে অপরের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন, সকলকে নিয়ে চলতে স্বচ্ছন্দ। শ্রীচৈতন্যের কাল থেকেই বঙ্গভূমি এই ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অনেকটা পথ হেঁটে এসেছি আমরা। বদলেছে অনেক কিছু। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আজকের ভারতবর্ষেও অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান দৃঢ়।
তাই চাপ এলেও কারও স্বাধীন ধর্মাচরণে হস্তক্ষেপ, রান্নাঘরের হাঁড়িতে উঁকি দেওয়া কিংবা পোশাক নিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারির মতো কোনও যুক্তিহীন দখলদারিতে অধিকাংশ বাঙালি সায় দিতে পারে না। আবার তামিলনাড়ুর মতো জাতীয় শিক্ষানীতির সরাসরি বিরোধিতা করে ‘হিন্দি শিখব না’ বলে গোঁ ধরে থাকাও পশ্চিমবঙ্গের নীতি নয়। কিন্তু এই রাজ্যের দৈনন্দিনতায় বাংলা-কে যদি কোথাও পিছিয়ে ফেলার চেষ্টা হয়, তা হলে তার প্রতিবাদ করা বঙ্গজ বাঙালির সঙ্গত কর্তব্য।
বিশেষ করে গত এক দশকের দিকে তাকালে এটা বলতে দ্বিধা হয় না যে, বঙ্গসমাজ ক্রমশ ‘হিন্দির বলয়গ্রাসে’। এই ‘গ্রাস’ নিছক হিন্দি বুলিতে সীমিত নয়। গড়পড়তা শহুরে বাঙালি কবে আর রিকশাচালক বা মালবাহকের মতো শ্রমজীবীদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলেছেন! কিন্তু এখন যেটা টের পাওয়া যাচ্ছে সেটা হল, বঙ্গদেশে হিন্দি বলয়ের রাজনীতির বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এক ধরনের অ-বাঙালিসুলভ ব্যবহারিক যাপনেও দ্রুত রপ্ত হয়ে ওঠা।
সর্বভারতীয় রাজনীতি নিশ্চয় এর একটি বড় কারণ। যেখানে ‘হিন্দুয়ানা’ এবং ‘হিন্দিয়ানা’ দুই-ই তীব্র ভাবে ক্রিয়াশীল। ওই ঘরানার বঙ্গজ নেতাদেরও কথাবার্তা, খাওয়া-পরা সব কিছুর মধ্যে সেটা ভালই পরিস্ফুট হয়। বলা চলে, এটা তাঁদের এক প্রকার ‘ব্র্যান্ডিং’!
বাম ও কংগ্রেসের দ্রুত ক্ষয় যে রাজ্যে বিজেপির কলেবর বৃদ্ধিতে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর ফল যা হওয়ার, তা-ই হচ্ছে। এক দিকে যেমন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষবৃক্ষ পুষ্ট হচ্ছে, অন্য দিকে তেমনই বাঙালির একটি অংশের জীবনে বদলের ছায়াপাত ঘটছে।
যদিও সবটাই শুধু বিজেপির ‘হিন্দুত্ববাদী’ রাজনীতির জয় বলে ভাবলে হয়তো অতিসরলীকরণ হবে। কারণ জনমতের একাংশ সর্বদাই শাসকের বিরুদ্ধে থাকে। প্রকৃতি যেমন শূন্যস্থান রাখে না, রাজনীতিতেও তেমনই বিরোধী তার পরিসর করে নেয়। সিপিএম এবং কংগ্রেসকে মানুষ বর্জন করছে বলেই শাসক তৃণমূলের বিরোধী হিসাবে একা বিজেপি উঠে আসতে পেরেছে। তারই ফলে বাংলার রাজনীতি আজ সাম্প্রদায়িক ভাগাভাগি ও ভাষা-সঙ্কটের অন্ধ গলিতে ঢুকে পড়েছে। ‘হিন্দুত্ব’ এবং ‘হিন্দিত্ব’-র অঙ্কে ভোটে হারজিতের হিসাব কষতে হয়। শাসক, বিরোধী, সবার ক্ষেত্রে এটা সত্যি।
সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে ’২৬-এর বিধানসভা নির্বাচন হতে অন্তত এক বছর। ধর্মীয় বিভাজনের বিষাক্ত হাওয়া ইতিমধ্যেই যে-ভাবে পাক খাচ্ছে, তাতে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কী আকার নিতে পারে, ভাবলে শিহরিত হতে হয়। বিজেপির মোকাবিলায় বিধানসভায় দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এখন নিজের ‘হিন্দু’ পরিচিতি জাহির করতে হচ্ছে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী তিন বারের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী মমতার দিকে আঙুল তুলে অকুতোভয়ে বলতে পারছেন, “ওঁর সঙ্গে ভারত-বিরোধী সন্ত্রাসবাদীদের যোগাযোগ আছে”! এমন চলতে থাকলে পরিণতি ভয়াবহ হতে বাধ্য।
সাংবাদিকতায় চার দশকেরও বেশি সময় কাটানোর পরে এখন প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে উপলব্ধি হচ্ছে, এগুলি কোনও বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। বরং এক ধারাবাহিকতা। চিরকাল মূল স্রোতের সঙ্গে কলুষ এই ভাবেই একাকার হয়ে আসছে। লঙ্কা এবং রাবণের পারস্পরিক সম্পর্কের মতো যা অবিচ্ছেদ্য। লঙ্কার গদি তার নিজগুণে ‘রাবণ’ তৈরি করে নেয়। বদলায় শুধু সময়, পতাকার রং, আর মুখচ্ছবি। তাই আজ গেলাসে জল অর্ধেক ভর্তি যতটা সত্যি, কাল অর্ধেক খালিও ততটাই।
২০১৯-এর লোকসভা ভোটে বিজেপির কাছে ধাক্কা খাওয়া তৃণমূলের সামনে ’২১-এর বিধানসভা ভোট ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। ২০০-র দাবি করা বিজেপি তাতে ৭৭ আসনে আটকে যায়। গত লোকসভাতেও বিজেপির অগ্রগতি রুদ্ধ হয়েছে। তবে বিধানসভা আসনের নিরিখে তারা এগিয়ে ৯২টিতে।
২০২৬-এর জন্য তৃণমূলকে তাই দু’টি পথই খোলা রাখতে হচ্ছে। এক, কিছুটা নরম (সফ্ট) হিন্দুত্ব। দুই, বাঙালির জাত্যভিমান উস্কে বিজেপির গায়ে ‘হিন্দি’র তক্মা সেঁটে দেওয়া। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন, ২০২১-এর বাংলা ‘নিজের মেয়েকেই’ চেয়েছিল!