বিভিন্ন: জওহরলাল নেহরু, মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধী ও বল্লভভাই পটেল
বারাণসীর শঙ্করাচার্য পরিষদ নাকি তৈরি করে ফেলেছে হিন্দুরাষ্ট্রের সংবিধান। সেই অখণ্ড ভারত রাষ্ট্রে বর্ণাশ্রম প্রথা থাকবে, এবং ভোটাধিকার থাকবে কেবল হিন্দুদেরই। সামনের মাঘ মেলাতেই এই সংবিধানের ঘোষণা হবে, শোনা গিয়েছে। বিজেপি নেতারা বলেছেন যে, এমন কোনও সংবিধানের কথা তাঁরা জানেন না। কিন্তু, কারও এমন সংবিধান তৈরি করার সাহস হয় কেন, সে কথা নিশ্চয়ই তাঁদের জানা আছে। শুধু এই কারণেই নয় যে, পরিষদের এই সংবিধানের চেষ্টার সামান্যতম নিন্দাও তাঁরা করেননি; এই কারণেও যে তাঁদের দলের প্রধানমন্ত্রী কেবল অযোধ্যায় মন্দিরে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন না, বা কাশীতে পুজো দিতে বসেন না, তিনি নতুন সংসদ ভবনে জাতীয় প্রতীক অশোক স্তম্ভ স্থাপনের সময়ও হিন্দুমতে পুজো দেন। অর্থাৎ, রাষ্ট্রের যে পরিসরটি সংবিধানমতে আবশ্যিক ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ, প্রধানমন্ত্রী তাকে হিন্দু ধর্মের পরিসর করে তুলতে দ্বিধা করেন না। ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানটি যখন কার্যত নাকচই করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, তার পরিবর্তে হিন্দুরাষ্ট্রের সংবিধান তৈরি করে ফেলতেই বা বাধা কোথায়?
হিন্দুদের স্বার্থরক্ষা করতে গেলে, অথবা হিন্দুধর্মের গৌরব রক্ষা করতে গেলে কি এমন হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ভিন্ন উপায় নেই? হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের কথাকে সত্য মানলে, নেই। শঙ্করাচার্য পরিষদের সংবিধানে যে কথাগুলো আছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে, তার কোনওটাই নতুন নয়, প্রায় এক শতাব্দী প্রাচীন। ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ বস্তুটা ঠিক কী, সেই ধারণা দানা বাঁধতে আরম্ভ করে ১৯৩০-এর দশক থেকে। তার মধ্যে হিন্দু ধর্মের ধর্মীয় উপাদান ছিল তুলনায় কম, অনেক বেশি ছিল জাতি-সংস্কৃতি-ভূগোলগত পরিচিতি। ভারত নামক ভৌগোলিক অস্তিত্বটিকে পুণ্যভূমি জ্ঞান করা, ভারতের সনাতন সংস্কৃতিকেই একমাত্র রীতি হিসাবে গণ্য করা, সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত ভাষায় কথা বলা— এ সবই ছিল সেই রাষ্ট্রকল্পনায় সম্ভাব্য নাগরিকের পরিচিতির উপাদান।
সেই পরিচিতি যতখানি না তৈরি হয়েছিল হিন্দু ধর্মের প্রবহমানতার ধারা অনুসরণ করে (‘হিন্দু ধর্ম’ বলে আদৌ কোনও একক অস্তিত্ব ছিল কি না, থাকা সম্ভব কি না, সে প্রশ্নও আছে), তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল রাজনৈতিক, যা প্রভাবিত হয়েছিল মুসলমান পরিচিতির দ্বারা। মুসলমানদের পুণ্যভূমি যে-হেতু মক্কা, হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রবক্তারা তাই বললেন, ভারতের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত হওয়া মুসলমানদের পক্ষে অসম্ভব। মুসলমানরা যে-হেতু আরবি ভাষায় ধর্মগ্রন্থ পাঠ করেন, তাই তাঁরা সংস্কৃতের উত্তরাধিকারকে ভারতীয়ত্বের অনতিক্রম্য শর্ত হিসেবে সাব্যস্ত করলেন। হিন্দুত্ববাদীরা যে হিন্দু ভারত কল্পনা করেছিলেন, মুসলমান, খ্রিস্টান, পার্সিরা সেই ভারতে থাকলেও তাঁদের থাকতে হবে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়েই, এমনও স্থির হল।
ভারতের ইতিহাস বলবে, হিন্দু ও মুসলমান, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক টানাপড়েন চলেছে বিশ শতকের সূচনা থেকেই; হিন্দুদের অবস্থান ঠিক কী হবে, তাদের কতখানি আধিপত্য থাকবে দেশের উপর— সেই তর্কও নেহাত কম দিনের নয়। কিন্তু, মুসলমান বা খ্রিস্টানদের নাগরিকত্ব সম্পূর্ণ অস্বীকার করে তৈরি হবে রাষ্ট্র, এই কথাটি হালে রাজনৈতিক পানি পাবে, এবং বৈধতা অর্জন করবে, ১৯৪৭-এর দেশভাগের আগে তেমন সম্ভাবনা তৈরি হয়নি। ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়া তৈরি করে দিল এমনই একটি পরিসর, যেখানে দাবি করা সম্ভব ছিল যে, দেশভাগের পর যে অংশটুকু ভারতের ভাগে থাকল, তা হিন্দুদের রাষ্ট্র হোক। পরিসরটি যে তৈরি হবে, সেই প্রত্যাশায় হিন্দুরাষ্ট্র আদায়ের জন্য প্রস্তুতিও সেরে রেখেছিল সঙ্ঘ।
কিন্তু, ১৯৪৭-এর সুযোগটি হাতছাড়া হয়েছিল। তার একটা বড় কারণ গান্ধীহত্যা। তার পরিপ্রেক্ষিতে দেশ জুড়ে নিষিদ্ধ হয় আরএসএস, জেলবন্দি হন গোলওয়ালকর। নেহরু আরও কড়া হন আরএসএস সম্বন্ধে। হিন্দুত্ববাদকে সূচ্যগ্র জমি না ছাড়া বিষয়ে নেহরুর অবস্থান প্রশ্নাতীত— সেই কারণেই উদারবাদীরা এখনও নেহরু-যুগের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, এবং বিজেপি নেতারা নেহরুকে আক্রমণ না করে ভাষণ শেষ করেন না। কিন্তু, নেহরু বনাম আরএসএস-এর দ্বন্দ্বকে উদারবাদী ধর্মনিরপেক্ষতা আর হিন্দু রাজনীতির দ্বৈরথের ছকে ফেলে দিলে একটা মুশকিল হয়— সে ক্ষেত্রে আরএসএস-কেই হিন্দু ধর্মীয় পরিচয়ের রাজনীতির একমাত্র প্রতিনিধি বলে ধরে নেওয়া হয়। অথচ, ১৯৩০-এর দশক থেকে হিন্দুরাষ্ট্রের কথা বলেও প্রথম সুযোগের জন্য ১৯৪৭ অবধি অপেক্ষা করতে হল, তার কারণ, বাকিদের বাদ দিয়ে হিন্দুদের রাষ্ট্র গড়তে হবে, এমন দাবি তোলেননি নিজেদের হিন্দু পরিচয় নিয়ে গর্বিত নেতাদের বেশির ভাগই।
তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ মহাত্মা গান্ধী। তিনি রামরাজ্যের কথা বলতেন, কিন্তু বারে বারেই জানিয়ে দিতেন, তা হিন্দুদের রাজত্ব নয়, প্রকৃত ধর্মের, ন্যায়ের রাজত্ব। তাঁর রাম এবং রহিম অভিন্ন। গান্ধীর ভারতকল্পনায় হিন্দুধর্ম প্রতিষ্ঠিত তার অতুল গৌরবে, কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলমান বা খ্রিস্টানদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তবে, গান্ধীর সঙ্গে কারই বা তুলনা চলে! যে বল্লভভাই পটেলকে গত কয়েক বছরে বিজেপি এবং সঙ্ঘ আত্মসাৎ করার মরিয়া চেষ্টা করেছে, কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে তাঁর অবস্থানই সঙ্ঘের রাজনীতির সবচেয়ে কাছাকাছি ছিল। পটেল নির্দ্বিধায় দেশভাগ চেয়েছিলেন; মুসলমানরা পাকিস্তানে চলে যেতে চাইলে নেহরুর মতো আপত্তি জানাননি, তাঁদের আশ্বস্ত করেননি, বরং সেটাকেই স্বাভাবিক বলেছিলেন; একাধিক বার আরএসএসকে আহ্বান করেছিলেন কংগ্রেসের সঙ্গে মিশে যেতে। কিন্তু, হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষা করতে হলে অন্যদের স্বার্থহানি করতে হবে, এমন কথা বলেননি পটেলও। দেশের ঐক্য বনাম আরএসএস-এর হিন্দুত্ববাদ, এই দ্বন্দ্বে পটেল কিন্তু দৃঢ় ভাবেই দাঁড়িয়েছিলেন দেশের পাশে।
পটেলের হিন্দু জাতীয়তাবাদের পাল্টা হিসাবে বারে বারেই আসে নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষতার কথা। ব্যক্তিগত ভাবে ধর্মের সঙ্গে নেহরুর সম্পর্ক ছিল না। ফলে, তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতাকে নাস্তিকতা ও ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাহীনতার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া সহজ। সেকুলাররা যাঁর কথা উল্লেখ করতে ভুলে যান, তিনি চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারি। ব্যক্তিগত জীবনে পরম ধার্মিক এই তামিল ব্রাহ্মণ ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি আনুগত্য থেকে কখনও সরেননি। ব্যক্তিগত গভীরতম ধর্মীয় বিশ্বাসও অন্য ধর্মের প্রতি বৈষম্য করার কারণ হতে পারে না— এই অবস্থানের দিক থেকে তিনিই সবচেয়ে কাছাকাছি ছিলেন গান্ধীর।
গান্ধী বা রাজাজির হিন্দু মনোভাব বা তার রাজনীতির সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ফারাক দেখতে পাওয়া সহজ। এমনকি পটেলের ক্ষেত্রেও— শেষ অবধি হিন্দুত্ব তাঁর জাতীয়তাবাদী সত্তাকে টপকাতে পারেনি। দেশভাগ-উত্তর সময়ে কংগ্রেসের পরিসরে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সবচেয়ে কাছাকাছি ছিলেন যাঁরা, তাঁদের ‘হিন্দু সনাতনী’ হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ, উত্তরপ্রদেশের কংগ্রেস নেতা পুরুষোত্তম দাস টন্ডন, গুজরাতের নেতা কানহাইয়ালাল মানেকজি মুনশির মতো নেতারা। তাঁদের বেশ কিছু অবস্থানে উচ্ছ্বসিত ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও। সোমনাথ মন্দির পুনর্নির্মাণের পর নেহরুর শত বারণ অমান্য করে তার উদ্বোধনে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ। গোহত্যা নিবারণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন টন্ডন। তবুও অন্য হিন্দু রাজনীতির সঙ্গে হিন্দুত্ববাদের যে ব্যবধানটি মোক্ষম, হিন্দু সনাতনীদের সঙ্গেও সেই ব্যবধানটি ছিল— সনাতনীরা হিন্দু গৌরবের পুনঃপ্রতিষ্ঠা চেয়েছিলেন বটে, কিন্তু তার জন্য ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ছেঁটে ফেলতে হবে রাষ্ট্রকল্পনা থেকে, তাঁদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নিতে হবে, এমন দাবি করেননি।
বিজেপি-আরএসএস’এর রাজনীতি এখানেই অন্যান্য হিন্দু রাজনীতি থেকে পৃথক। মনে হতেই পারে যে, তাদের কাছে হিন্দুস্বার্থ রক্ষার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মুসলমানদের স্বার্থহানি করা। ভারতের পরিসর থেকে তাদের মুছে দেওয়া। এই রাজনীতি বিদ্বেষের। লড়াইটা অতএব হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়, বিদ্বেষের বিরুদ্ধে, নাগরিকদের একাংশকে বাদ দিয়ে দেশের কথা ভাবার বিরুদ্ধে। এই কথাটা বারে বারে স্মরণ করা এবং করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy