কৈশোরের অপমৃত্যু। প্রতীকী ছবি।
সম্প্রতি এক বাংলা চলচ্চিত্রে রিয়ালিটি শো ও তাতে অংশগ্রহণকারী শিশু, কিশোরের জীবনের ওঠাপড়া, তার কঠোর বাস্তব উঠে এসেছে। কিছুটা হলেও, তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে সাফল্যের কাঠগড়ায় শৈশব, কৈশোরের অপমৃত্যু বা অপমৃত্যুর সম্ভাবনার কথা। আমরা কিছুটা একমত হই, কিছুটা হই না। বিপদ কোথায়, তা কিছুটা বুঝতে পারি, কিছুটা পারি না। বা হয়তো, বুঝেও না বোঝার চেষ্টা করি। কেন? অপ্রিয় কারণের অনেক পরত।
এই মরসুমে, শীতের ছুটি পড়ার ঠিক আগে অনেক স্কুলেই পরীক্ষার ফলাফল বার হয়, পেরেন্ট-টিচার মিটিং নামের বিষয়টিও অনুষ্ঠিত হয়। সন্তান, অভিভাবক উভয়ের জন্যই বিষয়টি বেশ চিন্তার, উদ্বেগের। ভীষণ ভাল ফলাফল করে হয়তো একটি সামান্য শতাংশের ছাত্রছাত্রী। মাঝারি, মাঝারি থেকে কম মানের ফলাফলের সংখ্যাই বেশি। এখন যারা স্কুলপড়ুয়া, তাদের অভিভাবকদের শৈশব, কৈশোর কেটেছে যে সময়ে, এই স্বাভাবিক মেধাবিভাজন যে তখনও ছিল না, তা নয়। কিন্তু সরকারি স্কুলেও অভিভাবক, শিক্ষিকা, এমনকি প্রধান শিক্ষিকার সঙ্গেও আলাপচারিতার সুযোগ ছিল। অভিভাবকদের বিভিন্ন প্রশ্নোত্তরের ধৈর্য ধরে উত্তর দিতেন শিক্ষিকারা, অভিভাবকরা তৃপ্ত হয়ে ফিরতেন— স্মৃতি তো এমনই সাক্ষ্য দেয়।
হঠাৎ কী হল? আমরা অভিভাবক হয়ে, শিক্ষিকা, অধ্যাপক হয়ে কী করে ফেললাম, যাতে ছবিটা একেবারে বদলে গেল? যদি চোখ রাখি স্মৃতির দূরবিনে, কী দেখতে পাই? আমরা, মানে ছাত্রছাত্রীরা কি প্রাপ্য বকুনিটুকু পেতাম না? অবশ্যই পেতাম। সময়বিশেষে শাস্তিও। সেই শাস্তি, যা কখনওসখনও প্রহার এবং কোনও বিষয়ে ততটা ভাল না হওয়ার ভর্ৎসনা, সহ্য হয়ে যেত কী ভাবে? এই শাস্তির মাঝে কিছুটা ঠাকুমা-দাদুর সুমধুর হস্তক্ষেপ, কখনও বড় দাদা বা দিদির কাছে এসে ফুঁপিয়ে নেওয়া।
একে মনস্তত্ত্ব কী বলে? বা সমাজবিজ্ঞান? ভাগ করে নেওয়ার মানুষ কমে গেল আমাদের সবারই। এও তো এক রকম ডিসপ্লেসমেন্ট। ব্রিটেনের অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্স ২০১৮-য় ব্রিটেন এবং কমনওয়েলথ দেশগুলিতে একটি সমীক্ষা করে, যার ভিত্তিতে আগামী কয়েক দশকে তারা শিশুদের মধ্যে ‘লোনলিনেস এপিডেমিক’ বা একাকিত্বের মহামারির পূর্বাভাস দেয়। ভারতের ১০ বছরের তলায় শিশুদের ১৪% নিজেদের সম্পূর্ণ একা মনে করে। যে শূন্যতার কোনও অস্তিত্বই রাখেননি আমাদের বাবা-মায়েরা, আমরা অভিভাবক হয়ে নিজেদের মধ্যেও কোথাও একটা গভীর গহ্বর তৈরি করলাম, আর সেই গহ্বরের শূন্যতাই চলে এল আমাদের সন্তানদের মধ্যে।
একাকিত্ব মানে কী? বাচ্চাটিকে একা থাকতে হচ্ছে, বাবা-মা দু’জনেই চাকরি করতে বেরোচ্ছেন— সেটাই একমাত্র কারণ? বাবা-মা দু’জনেই কর্মরত— এই রকম পরিবারের সংখ্যা আগে কম হলেও, একেবারে অমিলও ছিল না। তবু তারা তো এতটা একা ছিল না। দাদু, ঠাকুমা, দাদা, দিদি কিছুটা কারণ হয়তো। আরও বড় কারণ ছিল পাড়ার জেঠিমা, কাকিমা। মা-বাবা বাড়ি নেই, বোনের শরীর খারাপ হলে পাশের ফ্ল্যাটের কাকিমাকে ডাকতে হবে— এমনটাই যেন স্বতঃসিদ্ধ। তাই আমরা বাবা-মায়েরা তৈরি করেছি এই একাকিত্বের জগৎ। বিলাসবহুল ফ্ল্যাটবাড়িতে পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দার সঙ্গে দেখা হয় শুধুই পার্বণে। দেখার থেকে, দেখানোর চেষ্টা থাকে দু’তরফেই। আমরা নিজেরা একা হই, একা করে দিতে থাকি পরের প্রজন্মকেও। মনস্তত্ত্ববিদ, শিক্ষাবিদ আমাদের সতর্ক করেন, কিন্তু আমরা সতর্ক হই না। বিপরীতে, মানসিক ভাবে এই অসতর্ক অবস্থায় নিজেদের শূন্যতাকে ভরানোর চেষ্টা করি কিছু আপাত সাফল্য দিয়ে, সন্তানদের তাই শেখাই।
আমাদের অভিভাবকরা বলতেন, অঙ্কটা ব্যাকরণটা ভাল করে অভ্যাস করো, না হলে পরে অসুবিধায় পড়বে। আমরা বললাম, এতগুলো অঙ্ক এই সময়ের মধ্যে করা অভ্যাস করো। না হলে কোনও ভাল জায়গায় ঢুকতে পারবে না। অঙ্ক শিখল কি না, আসলে কোনও কিছুই শিখল কি না, জানার সময়টুকু আমাদের রইল না। কিন্তু ভাল জায়গায় ঢুকতে পারার লোভটা রয়ে গেল। এ ক্ষেত্রেও নিজেদের লোভ, না পাওয়া আর সবচেয়ে উপরে সেই গহ্বরটা আমরা আবারও চারিয়ে দিলাম ওদের মধ্যে। খারাপ করলে বললাম না, পরের বার চেষ্টা করিস। বরং আরও বেশি করে এর ছেলে, ওর মেয়ের সঙ্গে তুলনা করতে লাগলাম। সন্তানের পড়াশোনার উপর কতটা খরচ করেছি, সেটা ওই ছোট অসহায় চোখের সামনে জোর করে তুলে ধরলাম। কখনও তারা গুটিয়ে গেল, কখনও প্রতিবাদ করল, কখনও আরও মর্মান্তিক পথ বেছে নিল।
সোজা কথায়, সন্তান ও অভিভাবকের সম্পর্ককে, সন্তানের জীবনকে একটা রিয়ালিটি শো করে ফেলতে পারলাম। বিচারকের আসনে কে বসল জানা নেই, কে জিতল? জানা নেই। তবে হারল কারা— খুব বেশি করে স্পষ্ট আমাদের চার পাশে। আমার বা আপনার বাড়িতে।
সিনেমার পর্দায় তাদের দেখতে চাইনি আমরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy